বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা তাদের দপ্তরে যোগ দিয়েছেন। নিজেদের কাজকর্ম গুছিয়ে নিতে রবিবার প্রথম সচিবালয়ে যান তারা।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নিলে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সরকারের দায়িত্ব নিতে রাজি হন শান্তিতে নোবেলজয়ী বাংলাদেশি ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়।
তারপরই রবিবারই প্রথম অফিস করলেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা। প্রথম দিনের অফিস শেষে উপদেষ্টারা সাংবাদিকদের সঙ্গেও কেথা বলেন।
এম সাখাওয়াত হোসেন
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন এম সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি বলেন, “পুলিশের যেসব সদস্য এখনও কাজে যোগ দেননি, তাদের জন্য শেষ সময় হচ্ছে আগামী বৃহস্পতিবার। এর মধ্যে যদি কেউ যোগ না দেন, তাহলে ধরে নেওয়া হবে তারা চাকরিতে ইচ্ছুক নন।”
বক্তব্যে দেশের সবগুলো রাজনৈতিক দলের উদ্দেশে কড়া বার্তা দেন তিনি। আওয়ামী লীগের যে পরিণতি সেদিকে তাকানোর কথাও বলেন তিনি।
সাখাওয়াত বলেন, “এত বড় একটি ঐতিহ্যবাহী দলের সদস্যদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। যদি আপনি মনে করেন আমি এলাম, আমি দখল করব, চাঁদাবাজি করব…সেনাপ্রধানকে অনুরোধ করেছি আপনাদের পা ভেঙে দিতে।”
তৌহিদ হোসেন
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, “আমরা ভারতের সঙ্গে যেমন সম্পর্ক রাখতে চাই, একইভাবে চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক বজায় রাখতেও আগ্রহী। এমনকি পশ্চিমাদের সঙ্গেও একই রকম সম্পর্ক রাখতে চাইবে আমাদের দেশ।”
দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং কিছু বিষয় সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন দেওয়াই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ বলেও জানান তিনি।
যেকোনও কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
ভারতের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, “দুই সরকারের মধ্যে অবশ্যই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তবে ব্যত্যয় যেটা ছিল, সেটা হলো মানুষের মাঝে কতটা সোনালি সম্পর্ক ছিল? আমাদের মানুষ যেন ভাবে, ভারত আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমরা চাইব, ভারত আমাদের সহযোগিতা করবে।”
বক্তব্যে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের স্মরণ করেন। যারা এসব ঘটিয়েছে তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে, প্রয়োজনে জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করা হতে পারে বলেও জানান তিনি।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেন, “আমি সারাজীবন পরিবেশের ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে কাজ করে গেছি। আমি কাজ করতে চাই। লক্ষ্য রেখে এগোতে চাই।”
এরপর মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, “পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে অধিকতর জনবান্ধব মন্ত্রণালয়ে পরিণত করা হবে। বিভিন্ন প্রকার দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা হবে।”
মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। মন্ত্রণালয় ও অধীন দপ্তরসমূহের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজে গতিশীলতা বৃদ্ধিতে মোটিভেশনাল কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
প্রথম দিনের বক্তব্যে পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ব্যবহার রোধ, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ, গাড়ির হর্নজনিত শব্দদূষণ বন্ধ, নদীদূষণ রোধে উদ্যোগ গ্রহণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের উন্নয়ন, পাহাড় রক্ষা, বন সংরক্ষণ, জলাশয় ভরাট রোধ, উচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন ইত্যাদি কার্যক্রম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হবে।
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, “দেশ একটি কঠিন সময় পার করছে। এখন আমাদের কাছে অগ্রাধিকার হচ্ছে জাতীয়ভাবে আইনশৃঙ্খখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা। সচিবালয়ে এসেও তাই দেখতে পাচ্ছি। আজকে সচিবালয়ে এসে কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্দীপনা দেখে অনেক ভালো লাগছে।”
‘শেখ হাসিনা জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ এর নাম পরিবর্তনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন উপদেষ্টা। এটার নাম দিতে চান জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউট।
তার মতে, “যেহেতু বাংলাদেশে একটা ম্যাসাকারের সঙ্গে শেখ হাসিনার নাম জড়িয়ে আছে। সহস্র ছাত্র জনতার মৃত্যুর সঙ্গে তিনি সরাসরি যুক্ত। এটা প্রতিটি মন্ত্রণালয়েই করা হবে।”
খেলাধুলায় সংস্কার প্রসঙ্গে আসিফ বলেন, “নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বিষয়ে বিসিবির সঙ্গে কথা হয়েছে। সিকিউরিটি এনশিউর করার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনেক কিছু করার আছে। আজকে আমি ইউনূস স্যারের (প্রধান উপদেষ্টা) সঙ্গে কথা বলব। তিনি একজন ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ। আমরা ইউএনের সঙ্গেও কথা বলব যাতে তারা সহযোগিতা করে। কিছু দেশে ট্র্যাভেল রেসট্রিকশন আছে, সেগুলো যাতে সমাধান করা যায়।”
বিসিবিতে পরিবর্তন আনার বিষয়ে তিনি বলেন, “যেহেতু এটা একটা অটোনমাস প্রতিষ্ঠান, তাই সেখানে আমরা কিছু করতে পারব না। আমরা বিসিবি থেকে সাজেশান নিতে পারব, তাদেরকে সাজেশান দিতে পারব।”
নাহিদ ইসলাম
ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “কথায় কথায় ইন্টারনেট বন্ধ করা চলবে না। ইন্টারনেট ব্যবহার মানবাধিকার। এটা লঙ্ঘন করা যাবে না।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে সহিংসতা শুরু হলে দেশব্যাপী ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ আরও বেশি তীব্র হয়।
সেই সময়ে ইন্টারনেট শাটডাউনে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং দুর্নীতি প্রশ্রয় দেওয়া হবে না বলেও জানান নাহিদ ইসলাম।
হাসান আরিফ
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ সিটি মেয়রসহ জনপ্রতিনিধিদের সেবা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, “দ্রুত আগের মতো কাজ শুরু করতে হবে।”
অন্তর্বর্তী সরকার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়নি। তাই এই সরকারের পুরো কাজটিই চ্যালেঞ্জের বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, “আমাদের অন্যতম দায়িত্ব হলো একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সবগুলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করা।”
স্থানীয় সরকারে কাজগুলোকে চ্যালেঞ্জ মনে না করলেও এর সঙ্গে দুর্নীতি হওয়ার প্রবণতা বেশি। এ ক্ষেত্রে মনোযোগ দিয়ে কাজ শুরু করার কথাও বলেন তিনি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ কত দিন হবে তা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে বলেও জানান তিনি। কেন স্থানীয় সরকারের কাজে এত বেশি মামলা সংঘটিত হয়, তা নিয়ে কাজ করবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
ফরিদা আখতার
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, ডিম, দুধ, মাছ ইত্যাদি জিনিসপত্রের দাম কমাতে হবে।
“দেশের মানুষ ইলিশ পাবে না, আর বিদেশে রপ্তানি হবে, এটা হতে পারে না। আগে দেশকে গুরুত্ব দিতে হবে। এরপর রপ্তানি করা হবে। দেশের মানুষ যাতে ইলিশ মাছ পায় এবং দাম কমে, সেই উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে বাজার সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজিকে দায়ী করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। ফরিদা আখতার বলেন, “এ সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। সেইসঙ্গে বাজারে সরবরাহ বাড়াতে হবে। পণ্যের সরবরাহ বাড়ালে দাম কমে আসবে।”
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে সকল খাদ্যপণ্য ভেজালমুক্ত করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ।
শারমিন মুরশিদ
অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ বলেন, “চ্যালেঞ্জ মনে করলে অনেক কিছু। তবে কাজ করতে চাই। যে পরিবর্তনের কথা বলেছি সেটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।”
সালেহউদ্দিন আহমেদ
অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “গভর্নর নিয়োগের ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবো। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষেত্রেও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, যদি কেউ অস্থিরতা তৈরি করে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে শিগগিরই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নিজে এককালে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “ধরপাকড় তো কম করিনি আমরা। যে করেছে তাকে ধরবো। এ ধরনের কর্মকাণ্ড কাউকে করতে দেওয়া হবে না।”
এটিএম বুথে গিয়ে টাকা না পাওয়ার কথাও জানিয়েছেন অনেকে। তিনি বলেন, “টাকা নেই বিষয়টি কিন্তু তা না। এটা করা হয়েছে বর্তমান সময়ের কারণে, কেউ কেউ টাকা নিয়ে চলে যাবে। এটা ঠেকানোর জন্য। এটিএম বুথে তো ঝামেলা নেই।”