Beta
মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০২৫

ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা হলে কী হবে

২০২৩ সালের এপ্রিলে স্যাটেলাইট থেকে তোলা ইরানের নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রের এই ছবিতে সেখানে একটি ভূগর্ভস্থ ভবন নির্মাণের তৎপরতা দেখা যায়। ছবি: প্ল্যানেট ল্যাবস পিবিসি/এপি।
২০২৩ সালের এপ্রিলে স্যাটেলাইট থেকে তোলা ইরানের নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রের এই ছবিতে সেখানে একটি ভূগর্ভস্থ ভবন নির্মাণের তৎপরতা দেখা যায়। ছবি: প্ল্যানেট ল্যাবস পিবিসি/এপি।
[publishpress_authors_box]

ইরানের মধ্যাঞ্চলীয় শহর ইস্পাহানের একটি বিমানবন্দরের কাছের আকাশে শুক্রবার ভোর রাতে বিকট শব্দে পরপর তিনটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ইরান বলেছে, বাইরে থেকে তাদের ভূখণ্ডে আসা তিনটি কোয়াডকপ্টার বা ড্রোনকে তারা গুলি করে ধ্বংস করেছে। এ ছাড়া বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর ইরানের তাবরিজ শহরসহ সিরিয়ার কিছু সামরিক স্থাপনাতেও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

এসব থেকে ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েল গত সপ্তাহে তার ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার জবাবে ইরানের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রও তেমনটিই ইঙ্গিত দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে বলেছিল ইসরায়েল ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে।

ইস্পাহান ইরানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও শিল্প নগরী। এই শহরেই ইরানের প্রধান পারমাণবিক স্থাপনা নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্র অবস্থিত। তবে সেখানে কোনও হামলা হয়নি।

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থাও (আইএইএ) নিশ্চিত করেছে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো অক্ষত রয়েছে।

শুক্রবার ভোর রাতের ওই বিস্ফোরণের পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কয়েক ঘণ্টা ধরে পরস্পরবিরোধী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছিলেন, ইসরায়েল ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। কিন্তু ইরান দাবি করে, কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি এবং তারা শুধু তিনটি ছোট চালকবিহীন আকাশ যান বা ড্রোন গুলি করে ধ্বংস করেছে। ইসরায়েল অবশ্য এ বিষয়ে কিছুই বলেনি।

গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের বিমান হামলায় তিন জ্যেষ্ঠ কমান্ডারসহ ইরানের সাত সামরিক উপদেষ্টা নিহত হয়।

ওই হামলার ১২ দিন পর ১৩ এপ্রিল রাতভর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে তিনশর বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ওই হামলায় ইসরায়েলের তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও আশঙ্কা করা হচ্ছিল, যেকোনও মুহূর্তে ইরানে পাল্টা হামলা চালাতে পারে ইসরায়েল।

ইসরায়েলও ওই হামলার যথাযথ জবাব দেওয়ার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করে। ইসরায়েলের পাল্টা হামলার হুমকির জবাবে ইরানও ফের ইসরায়েলে বড় ধরনের হামলা চালানোর হুমকি দেয়।

আক্রমণাত্মক বাগাড়ম্বর

বৃহস্পতিবার সকালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) পারমাণবিক কমান্ডের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমাদ হাগতালাব হুঁশিয়ারি দেন, ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালালে ইরানও পাল্টা ইসরায়েলের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালাবে। ওই হুঁশিয়ারির ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই শুক্রবার ভোর রাতে ইরানের ইস্পাহানে ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটে।

ইসরায়েল হামলা চালালে ইরান পারমাণবিক বোমা বানানোর বিষয়টিও পুনর্বিবেচনা করবে বলেও হুমকি দেন জেনারেল আহমাদ হাগতালাব।

এপ্রিলের শুরু থেকেই ইরান তার পারমাণবিক স্থাপনাসহ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করে। শুক্রবারের হামলাটি ইরানের নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রের কাছাকাছি ছিল। এর আগেও ইসরায়েল সফলভাবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ব্যাপক নাশকতামূলক হামলা চালিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, ইসরায়েল কি এবার ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সরাসরি হামলা করবে? অন্তত বর্তমান পরিস্থিতিতে এই প্রশ্নের উত্তর, সম্ভবত না।

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালানো কি আদৌ সম্ভব

এমন হামলা চালাতে চাইলে ইসরায়েলকে তা একাই করতে হবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সতর্ক করেছে, ইরানের উপর হামলায় তারা সক্রিয়ভাবে অংশ নেবে না। শুক্রবারের হামলায়ও যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করেনি।

তেহরান থেকেও ওয়াশিংটনকে স্পষ্টভাবে ইরানে হামলা না চালানোর ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে।

গত ১৩ এপ্রিল ইসরায়েলে ইরানের হামলার পরপরই তেহরান সুইস দূতকে তলব করে। সুইস দূত ইরানে ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু তাকে তলব করার ক্ষেত্রে ইরান এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ নেয়। নিয়ম অনুযায়ী তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করার কথা ছিল। কিন্তু সেটা না করে তাকে আইআরজিসিতে তলব করা হয় এবং ইরানে কোনও আক্রমণের বিরুদ্ধে সতর্ক করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার অনুপস্থিতিতে ইসরায়েল একাই ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার স্তরগুলোর মধ্য দিয়ে ভূগর্ভস্থ বা পাহাড়ের গভীরে থাকা স্থাপনাগুলোতে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে।

কিন্তু স্যাটেলাইট থেকে তোলা নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রের ছবিগুলো থেকে জানা যায়, ইরান সেখানে মাটির প্রায় ১০০ মিটার গভীরে একটি নতুন ভূগর্ভস্থ স্থাপনা নির্মাণ করেছে। ভূগর্ভস্থ ওই স্থাপনাতেই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ হল এবং পারমাণবিক গবেষণার স্থাপনাগুলো স্থানান্তর করা হয়েছে।

মাটির এতো গভীরে ইসরায়েলের পক্ষে হামলা চালানো সম্ভব না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বাঙ্কার বাস্টার বোমা দিয়েও কিছু করা সম্ভব হবে না।

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং তা সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা

ইসরায়েল বলেছে, ইরান যেন কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র না পায় তা নিশ্চিত করার জন্য বিশ্বকে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। ইসরায়েল এমনকি তা ঠেকানোর জন্য সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিজ্ঞাও করেছে।

অন্যদিকে, ইরান বরাবরই বলে আসছে যে তারা পারমাণবিক বোমা চায় না। তবে ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালে একতরফাভাবে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি জোরদার করে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ছয় শক্তির সঙ্গে ওই চুক্তিতে ইরান তার ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিনিময়ে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ৩.৭ শতাংশে সীমাবদ্ধ করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় ইরানও আর সেই চুক্তি মেনে চলেনি।

২০২০ সালে এক নাশকতামূলক হামলার জবাবে ইরান নাতাঞ্জে ওই ভূগর্ভস্থ স্থাপনা নির্মাণ শুরু করে। এরপর ২০২১ সালের আরেকটি নাশকতামূলক হামলার পর ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়। ওই হামলাগুলোর জন্য তেহরান ইসরায়েলকেই দায়ী করে।

আইএইএ বলেছে, ইরানের কাছে বেশ কয়েকটি পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ রয়েছে, তবে দেশটি এখনো বোমা তৈরি করা শুরু করেনি। আইএইএ তার গত ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলেছে, ইরান গত বছরের শেষ থেকে তার ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের গতিও কিছুটা মন্থর করেছে।

ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সরাসরি হামলা চালালে বরং হিতে বিপরীতই হবে। এতে ইরান আরও কঠোর পদক্ষেপ নেবে এবং পারমাণবিক বোমা বানানোও শুরু করতে পারে। ১৯৬৮ সালের পারমাণবিক অস্ত্র সম্প্রসারণ রোধ চুক্তি থেকেও বেরিয়ে যেতে পারে ইরান।

আর ইসরায়েল ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ভেদ করে নাতাঞ্জ বা অন্য কোনও শীর্ষ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালাতে সক্ষম হলে তাতে পরিবেশগত বিপর্যয়ের ঝুঁকিও রয়েছে। এতে বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধেও নিন্দার ঝড় উঠতে পারে।

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ইরান তার পারমাণবিক গবেষণা এবং জ্ঞানগত উন্নয়নে ব্যাপকভাবে অগ্রগতি করছে। বোমা মেরে বা কোনও বিজ্ঞানী ও প্রকল্প পরিচালককে হত্যা করে এই জ্ঞান ধ্বংস করা সম্ভব না।

ব্যাপক ও অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েল হামলা চালালে তা হবে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। কারণ এতে ইরানের সর্বোচ্চ মূল্যবান রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় পূর্ণাঙ্গ সামরিক আক্রমণ হবে।

এমন হামলা সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেটে হামলার চেয়েও অনেক বেশি উত্তেজনা তৈরি করবে। এমন হামলা হবে আন্তর্জাতিক আইনের অভূতপূর্ব লঙ্ঘন। কনস্যুলেটে হামলাও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ছিল, যার ফলেই ইসরায়েলে সরাসরি হামলা চালায় ইরান।

এমন হামলা কেবল ইরানকেই আরও ব্যাপক সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য করবে না বরং ইরাক, লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো তথা ‘প্রতিরোধের অক্ষ’কেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ পর্যায়ের পদক্ষেপ নিতে উস্কানি দেবে।

গাজায় যুদ্ধের জন্য ইসরায়েল ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক নিন্দার মুখে রয়েছে, যা ক্রমেই বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে ইরানের উপর বিশেষ করে পারমাণবিক স্থাপনায় সরাসরি আক্রমণের ন্যায্যতা প্রমাণ করাও তাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে। এমনকি এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্রদের সমর্থনও হারাতে পারে ইসরায়েল।

এ ছাড়া এই হামলার জন্য ইরান মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সমর্থক রাষ্ট্রগুলোকেও দায়ী করে তাদের ওপরও পাল্টা হামলা চালাতে পারে। এতে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল এবং তার বাইরেও সামরিক সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে, যদি সর্বাত্মক যুদ্ধ নাও হয়।

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত