২০১৪ সালের জুলাই মাসে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের ‘অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ’ নামের সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পরপরই ডেনিশ সাংবাদিক নিকোলাজ ক্রাক ইসরায়েল থেকে কোপেনহেগেনের পত্রিকা দাগব্লাড এর জন্য একটি লেখা পাঠিয়েছিলেন। ৫১ দিনের ওই ইসরায়েলি অভিযানে ৫৫১ শিশুসহ ২২শ ৫১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়।
নিকোলাজ ক্রাক তার প্রতিবেদনে গাজা সীমান্তের কাছের ইসরায়েলি শহর সেদরোতের উপকণ্ঠের একটি পাহাড়ের দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছিলেন। এতে ক্রাক উল্লেখ করেন, এলাকাটি দৃশ্যত যুদ্ধ নিয়ে বানানো কোনও রিয়ালিটি শো’র সিনেমা হলে পরিণত হয়েছিল। ইসরায়েলিরা ওই পাহাড়ের চূড়ায় ক্যাম্পিং চেয়ার আর সোফা পেতে তামাশা দেখতে বসেছিল। কারও হাতে ছিল পপকর্নের ঠোঙা। কেউবা বসেছিল হুক্কার নল নিয়ে। চলছিল দিলখোলা আড্ডা। অদূরেই গাজায় মুহুর্মূহু বিমান হামলা যখন উৎপাদন করছিল আগুনের গোলা আর দুনিয়া কাঁপানো শব্দ তখন উল্লাসে ফেটে পড়ছিল ওই দর্শকরা।
এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, ইসরায়েলিরা বরাবরই হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য উপভোগ করে এসেছে। যে জাতির অস্তিত্বের ভিত্তিতেই ছিল গণহত্যা তাদের জন্য এটা মোটেই আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু নয়। তবে সঙ্গত কারণেই এই তাণ্ডবের শিকার যখন হয় ইসরায়েলিদের প্রাণ তখন আর করতালিতে খুব জোর থাকে না।
ইসরায়েলের গত ১১ মাসের যুদ্ধের ‘রিয়ালিটি শোতে’ গাজা উপত্যকায় চলছে সর্বাত্মক গণহত্যা। সেখানে সরকারিভাবে মৃতের সংখ্যা প্রায় ৪১ হাজারে উঠেছে। তবে জুলাই মাসে প্রভাবশালী পশ্চিমা মেডিকেল বিষয়ক প্রকাশনা ল্যানসেট-এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ১ লাখ ৮৬ হাজারের ওপরে হতে পারে। হত্যাযজ্ঞ শিগগিরই শেষ না হলে তা আরও বাড়বে।
এখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার যাতে গাজায় বন্দি অবশিষ্ট একশ বা তার কিছু বেশি জিম্মিকে মুক্ত করার জন্য হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করে সেই দাবিতে ইসরায়েল জুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। সপ্তাহ দুই আগে ইসরায়েলি সেনারা গাজায় ছয় বন্দির লাশ উদ্ধার করার পর সারা দেশে প্রায় সাত লাখ বিক্ষোভকারী রাস্তায় নেমেছিল। ইসরায়েলের প্রধান শ্রমিক ইউনিয়নের ডাকে সফলভাবে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ভাষ্যকারদের মধ্যে কিছু শান্তিবাদী ভাবের লোকজন এই প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পেছনে রক্তপাত বন্ধ করার আকাঙ্খা দেখলেও বাস্তব ঘটনা তা নয়। সত্যি কথাটা হচ্ছে , ফিলিস্তিনিদের রক্ত নিয়ে কখনোই কারও তেমন মাথাব্যথা নেই বা ছিল না। বরং অবরুদ্ধ, বিধ্বস্ত এবং গণহত্যা-পীড়িত গাজা উপত্যকায় শুধু ইসরায়েলি জিম্মিদের জীবনই গুরুত্বপূর্ণ তাদের কাছে। এ জিম্মিদের বন্দিদশার জন্য ইসরায়েলের নীতি আর গাজায় তাদের নিরন্তর নির্মমতাই দায়ী।
খোদ ইসরায়েলি বিশ্লেষক নিমরোদ ফ্লাসচেনবার্গ সম্প্রতি আল জাজিরার সঙ্গে আলাপকালে বর্তমান বিক্ষোভের লক্ষ্য সম্পর্কে বলেন, জিম্মিদের ফিরিয়ে আনাই আসল দাবি। তিনি স্বীকার করেন, চুক্তি হলে যে সংঘাতের অবসানও ঘটবে এটাও বিবেচনায় থাকলেও মুখে তা বলা হয়েছে খুব কমই। ফ্লাসচেনবার্গ জোর দিয়ে বলেন, প্রতিবাদের নেতৃত্বের কথা যদি বলেন, তাদের কাছে জিম্মিদের বিষয়টাই আসল।
কিছু ইসরায়েলির জন্য বর্তমানের গণহত্যা স্পষ্টতই যথেষ্ট নয়। ইংরেজি ভাষার জনপ্রিয় ইসরায়েলি পডকাস্ট ‘টু নাইস জুই্যশ বয়েজ’-এর এক সাম্প্রতিক পর্বে মন্তব্য করা হয়, শুধু একটি বোতাম টিপেই গাজা ও পশ্চিম তীরের ‘‘প্রতিটি জীবন্ত প্রাণীকে’’ নিশ্চিহ্ন করা গেলে দারুণ ব্যাপার হবে! ফিলিস্তিনিদের তুলনায় ইসরায়েলি জিম্মিদের প্রাণের মূল্য অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বেশি ধরার এই মানসিকতা ইসরায়েলের চিহ্নিত একগুঁয়েমিরই আরেক নমুনা। এই দৃষ্টিভঙ্গীতে ইসরায়েলিদের ধরা হয় ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসের চিরস্থায়ী শিকার হিসেবে। অথচ ফিলিস্তিনিরাই অনেক বেশি হারে হত্যার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। উদাহরণস্বরূপ, গাজায় ২০১৪ সালের ‘অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ’ অভিযানে দুই হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হলেও ইসরায়েলি পক্ষে বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা ছিল মাত্র ৬জন। এরপরও ইসরায়েল নিজেরা হামলার শিকার হওয়ার ঢোল বাজিয়েই যাচ্ছে। এ বছরের জুন মাসে ইসরায়েলি সেনারা গাজায় একটি উদ্ধার অভিযান চালায় যাতে চার বন্দিকে মুক্ত করতে গিয়ে ২১০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়। নিঃসন্দেহে এটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ শক্তিপ্রয়োগের এক জ্বাজল্যমান উদাহরণ।
গত সপ্তাহে ছয় বন্দির মৃতদেহ উদ্ধারের পর নেতানিয়াহু তাদের মৃত্যুর জন্য হামাসকে দায়ী করে ঘোষণা করে বলেন: ‘‘যারা জিম্মিদের হত্যা করে তারা চুক্তি চায় না।’’ কিন্তু হামাসের শীর্ষ যুদ্ধবিরতি আলোচককে হত্যা করা এবং পদে পদে একটি চুক্তির সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করার মাধ্যমে যারা গণহত্যাকে দীর্ঘায়িত করে চলেছে তাদের ব্যাপারে কী বলবেন তিনি?
ইসরায়েলি বিক্ষোভকারীদের অনেকের ক্রোধের লক্ষ্যবস্তু এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। কিন্তু আবারও বলতে হয়, এসব প্রতিবাদের ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হলো গণহত্যা এখানে মূল বিবেচ্য বিষয় নয়।
এমনকি নেতানিয়াহুর বিরোধিতাকারীদের মধ্যেও ইসরায়েলি প্রাণের একতরফা পবিত্রতা সম্পর্কে একটি সাধারণ ঐকমত্য এখনও বহাল। ফিলিস্তিনিদের নির্বিচারে হত্যা করার ব্যাপারে ইসরায়েলিদের অবিচ্ছেদ্য অধিকার থাকার কথাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ।
ইসরায়েলের যুদ্ধ বিষয়ক ‘রিয়েলিটি থিয়েটার’-এর সাম্প্রতিকতম পর্বটি আর তাই শেষ হচ্ছেই না। পশ্চিম তীর এবং লেবাননের রঙ্গমঞ্চেও ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞ চলে আসছে অনেকদিন ধরে। সবমিলিয়ে শো’টি পুরানো হয়ে এসেছে। আশা করা যায়, ইসরায়েলি দর্শক-শ্রোতারা শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে টিভির সামনে থেকে উঠে যাবে। কিন্তু আপাতত নিরন্তর রক্তগঙ্গার এই দৃশ্য এক নিশ্চিত ব্লকবাস্টার।
লেখক: আল জাজিরা’র নিয়মিত কলামিস্ট। আল জাজিরা অনলাইন থেকে অনুবাদ: আবু ইউসুফ।