Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫
Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫

ইসরায়েলের হামলা ঠেকাতে ইরানের সক্ষমতা কতটা

গত ১৭ ফেব্রুয়ারি তেহরানে ইরানি সামরিক বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শনী। ছবি: রয়টার্স।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি তেহরানে ইরানি সামরিক বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শনী। ছবি: রয়টার্স।
[publishpress_authors_box]

ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ‘যথাযথ জবাব’ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে ইসরায়েল। গত শনিবারের ওই হামলার পর থেকে ইসরায়েলের যুদ্ধ মন্ত্রিসভা কীভাবে এর পাল্টা জবাব দেওয়া যায় তা ঠিক করতে বেশ কয়েকবার বৈঠকও করেছে। ইসরায়েলি সেনাপ্রধান হার্জি হালেভি বলেছেন, ইরানের হামলার একটি সামরিক পাল্টা জবাব নিশ্চিত।

ইরানও তার মাটিতে ইসরায়েল সরাসরি সামরিক হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিলে ‘ব্যাপক ও কঠোর জবাব’ দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বুধবার এই হুমকি দিয়েছেন।

এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েল হামলা চালালে ইরান কতটা কার্যকরভাবে আত্মরক্ষা করতে পারবে বা ইসরায়েলের হামলা ঠেকানোর সক্ষমতা ইরানের কতটা আছে- তা নিয়ে চলছে আলোচনা।

ইরান প্রধানত স্থানীয় প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্রের উপর নির্ভরশীল

গত কয়েক দশক ধরে ইরান তার অর্থনীতির ক্ষেত্রে স্থানীয় সক্ষমতার উপর নির্ভর করার জন্যই জোর দিয়ে আসছে। একই ধরনের প্রবণতা দেশটির সামরিক খাতেও দেখা যায়।

ইরানের এই প্রবণতার মূলে রয়েছে প্রতিবেশী ইরাকের সঙ্গে আট দীর্ঘ বছরের যুদ্ধ, যা উপসাগরীয় যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯৮০ সালে ইরাকের তৎকালীন শাসক সাদ্দাম হোসেন ইরান আক্রমণ করেছিলেন। সেসময় বাগদাদ সামরিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু বিদেশি শক্তির সমর্থন পেয়েছিল।

১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে কয়েক দশক ধরে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান শক্তিশালি বিমান বাহিনীও গড়ে তুলতে পারেনি। দেশটির বেশিরভাগ যুদ্ধবিমান শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির যুগের, যিনি ১৯৪১ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ইরানের শাসক ছিলেন।

এফ-৪ ও এফ-৫ এর মতো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পুরোনো কিছু যুদ্ধবিমান রয়েছে ইরানের বিমানবাহিনীতে। বর্তমানে ইরানের যুদ্ধবিমানগুলোর বেশিরভাগই রাশিয়ার সুখোই ও মিগ সিরিজের। সেগুলোও সোভিয়েত যুগের।

এছাড়া ইরানের বিমানবাহিনী তাদের নিজস্ব যুদ্ধবিমানও তৈরি করেছে। যেমন, সায়েকেহ ও কাউসার, যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন যুদ্ধবিমানের নকশার নকল করে বানানো হয়েছে। তবে এসব যুদ্ধবিমানও ইসরায়েলের কাছে থাকা এফ-৩৫ এর মতো উন্নত নয়।

অবশ্য রাশিয়ার কাছ থেকে দুই ডজন এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার চেষ্টা করছে ইরান। রাশিয়ার তৈরি উন্নত যুদ্ধবিমানগুলো পেলে ইরানের বিমানবাহিনী হয়তো ইসরায়েলের বিমানবাহিনীকে মোকাবেলার কিছুটা শক্তি অর্জন করবে। কিন্তু শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অভাবে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানগুলোর হামলা প্রতিহত করা বেশ কঠিনই হবে ইরানের জন্য।

দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র

উচ্চাভিলাষী ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির মাধ্যমে ইরান তার যুদ্ধবিমানের অভাব পূরণের চেষ্টা করেছে। ইরান বিশেষভাবে তার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করার দিকে মনোনিবেশ করেছে।

এজন্য দেশটি তার বিমানঘাঁটি, ক্ষেপণাস্ত্র ডিপো ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে পাহাড়ের গভীরে স্থাপন করেছে। ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া বাঙ্কার বাস্টার যুদ্ধাস্ত্র থেকে নিজের ঘাঁটিগুলোকে রক্ষার জন্যই ইরান এই ব্যবস্থা নিয়েছে। হামাসের বিরুদ্ধে গাজায় গত সাত মাস ধরে চলমান যুদ্ধেও ইসরায়েল ব্যাপকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া বাঙ্কার বাস্টার বোমা ব্যবহার করেছে।

ইরানের সবচেয়ে দূরপাল্লার বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হলো বাভার-৩৭৩। এক দশক ধরে তৈরি ও পরীক্ষার পর ২০১৯ সালে ক্ষেপণাস্ত্রটি ইরানের সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়। তারপর ক্ষেপণাস্ত্রটি আরও উন্নত করা হয়েছে।

২০২২ সালের নভেম্বরে ইরানি কর্মকর্তারা একটি উন্নত বাভার-৩৭৩ প্রদর্শন করেন। সেসময় তারা বলেছিলেন, এটির রাডার সনাক্তকরণের পরিসীমা ৩৫০ কিলোমিটার থেকে ৪৫০ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে এবং এখন এটি মাটি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য উন্নত সায়াদ ৪বি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সজ্জিত।

এটি দূর-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও শব্দহীন যুদ্ধবিমানসহ ৪০০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুকে টার্গেট করতে পারে। এছাড়া একসঙ্গে ৬০টি লক্ষ্যবস্তুকে সনাক্ত এবং একবারে ছয়টি লক্ষ্যবস্তুকে টার্গেট করতে পারে। এরপর ক্ষেপণাস্ত্রটি ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়ে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।

ইরানের রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার দাবি, বাভার-৩৭৩ কিছু দিক থেকে রাশিয়ার তৈরি এস-৩০০ থেকেও উন্নত এবং এমনকি আরও উন্নত এস-৪০০ ব্যাটারির সঙ্গে তুলনীয়, যা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে একটি। বাভার-৩৭৩ এখনও ইরানের সামরিক অনুশীলনের বাইরে কোনও যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা এটিকে বিশ্বের ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ বিমান প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করেন।

ইরানের কাছে রাশিয়ার টর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি এস-৩০০ও রয়েছে। এস-৩০০ রাশিয়ার সোভিয়েত আমলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা ১৯৭০ এর দশকের শেষ দিকে তৈরি করা হয়। এটি দিয়ে যুদ্ধবিমান, ড্রোন এবং আগত ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ১৫০ কিলোমিটার দূর থেকে ধ্বংস করা সম্ভব। আর টর মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূর থেকে তা করতে পারে।

ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার স্তর

ইরান স্থানীয়ভাবে নিজেও বিভিন্ন ধরনের উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছে, যেগুলো দূরপাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পেছনে প্রতিরক্ষার একাধিক স্তর গড়ে তোলে।

আরমান, সায়াদ, আজারাকশ ও খোরদাদ-১৫ সহ একাধিক মাঝারিপাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে ইরানের। এসব ক্ষেপণাস্ত্র বিভিন্ন উচ্চতায় ২০০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত ইরানের আকাশকে রক্ষা করতে পারে। এসব দিয়ে ইরান স্বল্প দূরত্ব থেকে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানসহ ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকেও ধ্বংস করতে পারবে।

ইরান এবছর আরও কিছু ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্মোচনের পরিকল্পনা করছে বলে গত মাসের শেষদিকে দেশটির একজন সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তা জানান।

ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) ও সেনাবাহিনীর কাছে ২ হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম এমন অনেক ধরনের ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। আছে অনেক গোয়েন্দা এবং অ্যাটাক ড্রোনও।

এসবের মধ্যে বেশ কয়েকটি গত শনিবার ইসরায়েলে হামলার সময় ব্যবহৃত হয়। ইসরায়েলের দিকে ৩০০টিরও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল ইরান।

বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, শনিবারের হামলায় ১৭০টি ড্রোন, ৩০টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্তত ১১০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। তবে সেসবের মধ্যে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি ইসরায়েলের মাটিতে আঘাত হানে। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনও দেশে আঘাত হানতে সক্ষম।

গোপন নাশকতা ও সাইবার হামলা হলে কী করবে ইরান

ইরানের সঙ্গে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ‘ছায়াযুদ্ধে’ ইসরায়েল অপ্রচলিত যুদ্ধ কৌশলের উপর নির্ভর করেছে বলেই মনে করা হয়।

ইসরায়েল বহুবার ইরানের প্রধান পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় গুপ্ত হামলা করেছে। গোপন বোমা হামলা এবং পিক-আপ ট্রাকে বসানো স্যাটেলাইট-নিয়ন্ত্রিত মেশিনগান দিয়ে গুলি করে পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে। সামরিক স্থাপনায় বিস্ফোরক-বোঝাই কোয়াডকপ্টার পাঠিয়ে হামলা করেছে এবং একটি গ্যাস পাইপলাইন উড়িয়ে দিয়েছে।

ইরানের উপর একাধিক বড় আকারের সাইবার হামলার পেছনেও ইসরায়েলের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ইরানের প্রধান প্রধান বন্দর, বিমানবন্দর ও পেট্রোল স্টেশনগুলো পরিচালনাকারী জাতীয় নেটওয়ার্কগুলোতে বহু সাইবার হামলা হয়েছে। ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে এসব হামলার জন্য ইসরাইলকে দায়ী করেছে।

বছরের পর বছর এসব হামলায় ক্ষতির শিকার হলেও ঘুরে দাঁড়াতে এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে শিখেছে ইরান।

সাইবার হামলা মোকাবেলার দায়িত্ব ইরানের প্রধান রাষ্ট্রীয় সংস্থা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর প্যাসিভ ডিফেন্সের। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, ইরানে প্রতিদিন শত শত সাইবার হামলা হয়, আর এসব হামলা তারাই প্রতিহত করেন।

ইরানি হ্যাকাররাও ইসরায়েলে প্রায়ই সাইবার হামলা চালায়। ইসরায়েলের সংবাদপত্র হারেৎজ গত মঙ্গলবার জানিয়েছে, এপ্রিলের শুরু থেকে ইসরায়েলের পারমাণবিক স্থাপনাসহ বিভিন্ন গোপন সরকারি তথ্য হ্যাক করে ইরানি একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হচ্ছে। এর পেছনে ইরানের ভাড়া করা আন্তর্জাতিক হ্যাকারদের একটি দল কাজ করছে।

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, বিবিসি

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত