Beta
বুধবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৫

ইসরায়েলে ইরানের হামলার কী প্রভাব পড়বে বিশ্বে

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে অশোধিত তেলের দাম বাড়বে।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে অশোধিত তেলের দাম বাড়বে।
[publishpress_authors_box]

প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের ভূখণ্ডে সরাসরি হামলা চালালো ইরান। শনিবার মধ্যরাতে বিমান হামলার সাইরেন বেজে ওঠে পুরো ইসরায়েলজুড়ে। নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে অনুরোধ করা হয় এবং গর্জে উঠে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

ইসরায়েল ও তার মিত্ররা ইরানের ছোড়া বেশিরভাগ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের ভূখণ্ডে পৌঁছানোর আগেই গুলি করে ধ্বংস করতে নামে। এতে একের পর এক বিস্ফোরণে আলোকিত হয়ে ওঠে রাতের আকাশ।

এমনকি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরেও ইরানের ছোড়া একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র গুলি করে ধ্বংস করার ঘটনা ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জর্ডান ইসরায়েলকে এই হামলা প্রতিহতে সহায়তা করে।

৩০০টিরও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল ইরান। এর মধ্য দিয়ে ইরানের ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ পেলেও ইসরায়েলে জান-মালের কোনও ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।

বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামলায় ১৭০টি ড্রোন, ৩০টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্তত ১১০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান, যার মধ্যে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি ইসরায়েলের মাটিতে আঘাত হানে।

নজিরবিহীন এই হামলার পর এখন বিশ্ব ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। ইসরায়েল কি পাল্টা হামলা চালিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাবে, নাকি যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সংযমী হবে?

ইসরায়েলের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষার মধ্যেই একটি সম্ভাব্য যুদ্ধ কীভাবে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি ও বৈশ্বিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে তা দেখে নেওয়া যাক। আসুন আমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজি- বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হওয়া দুটি জাতির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বের সাধারণ মানুষ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে?

জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়বে

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে তেল ও গ্যাসের ওপর। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, দুই দেশের মধ্যে যে কোনও উত্তেজনা অপরিশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে পারে, যার ফলে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও ঊর্ধ্বমুখী হবে।

নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মাইকেল ওয়াল্ডেন ইউএসএ টুডেকে বলেছেন, তেল ও গ্যাসের দামের উপর কী প্রভাব পড়বে, তা দেশ দুটির পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করছে।

তিনি বলেন, “সামনে ঠিক কী ঘটতে চলেছে তা আমরা নিশ্চিত নই। সামনে যা ঘটবে তার ওপরই নির্ভর করছে কী প্রভাব পড়বে।”

বাজার পর্যবেক্ষকরাও বলছেন, ইসরায়েল ইরানে হামলা চালালে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার বা তারও বেশি বেড়ে যেতে পারে। ইরান ওপেকের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ এবং দেশটির তেল উৎপাদনে যে কোনও বাধা বিশ্ববাজারে বড় প্রভাব ফেলবে।

লিপো অয়েল অ্যাসোসিয়েটসের প্রেসিডেন্ট অ্যান্ডি লিপো সিএনবিসিকে বলেছেন, “ইরানের তেল উৎপাদন বা রপ্তানি সাইটগুলোর ওপর যে কোনও হামলা ব্রেন্ট অশোধিত তেলের দাম ১০০ ডলারে নিয়ে যাবে। আর হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে তা ১২০ থেকে ১৩০ ডলারে উঠবে।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, পারস্য উপসাগরের হরমুজ প্রণালী দিয়ে বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ ও পশ্চিমাদের ৩০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল সরবরাহ হয়। ইরান হরমুজ প্রণালী দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিলে পশ্চিমাদের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে।

তবে ইরানের হামলার পর তেলের দাম এখনও বাড়েনি। ব্রেন্ট ক্রুড অয়েল সোমবারও ব্যারেলপ্রতি ৯০ ডলারে বিক্রি হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি ও বাণিজ্য ঘাটতি আরও বাড়বে এবং টাকার মান কমবে।

বাণিজ্য ও ভ্রমণ বাধাগ্রস্ত হবে

জ্বালানি তেলের দাম প্রভাবিত হওয়ার পাশাপাশি ইসরায়েল-ইরান সর্বাত্মক যুদ্ধের সম্ভাবনা বাণিজ্য ও ভ্রমণেও আঘাত হানতে পারে। আকাশ পথে বিমান ও জলপথে জাহাজ চলাচল ব্যাহত হতে পারে।

শনিবারের হামলার সময় ইরান, জর্ডান, ইরাক, লেবানন ও ইসরায়েল সহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ সাময়িকভাবে তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়। পরে খুলে দিলেও বিধি-নিষেধ আরোপ করে।

অনেক এয়ারলাইন্স বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়াতে বিকল্প রুটের কথা ভাবছে। ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইটগুলো ইরানের আকাশসীমা থেকে কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, সৌদি আরব ও মিশরের দিকে বিমান ঘুরিয়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছে।

কিন্তু দীর্ঘ বিমান রুট মানে বিমান চালনায় জ্বালানি বেশি খরচ হওয়া, যার অর্থ হল আরও ব্যয়বহুল বিমান ভ্রমণ। এতে ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে বিমানে ভ্রমণের ভাড়া অনেক বেড় যাবে। ফলে পর্যটন বাণিজ্যেও ধস নামবে।

সার্বিক বাণিজ্যেও প্রভাব পড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন করে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ এশিয়া থেকে ইউরোপে রপ্তানি ব্যাহত হবে। তাদের আরও আশঙ্কা ইউরোপে বিমানে মাল পরিবহনের খরচ ১০-১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং লজিস্টিকস ও বীমা খরচ বাড়বে।

চা ও বাসমতি চালের ভারতীয় রপ্তানিকারকরা আশঙ্কা করছেন, উত্তেজনা বাড়লে এই দুটি পণ্যের রপ্তানি ব্যাহত হতে পারে। এমনকি ভোজ্য তেল আমদানিকারকরাও বলছেন, সূর্যমুখী তেলের দাম বাড়তে পারে। কারণ ভারতের চাল রপ্তানির একটি বড় অংশ যায় ইরানে। গত বছরের প্রথম ১১ মাসে, ভারতের বাসমতি চাল রপ্তানিতে ইরানের অবদান ছিল ৫৯৮ মিলিয়ন ডলার। তাছাড়া ইরান, ইসরায়েল ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলো বাসমতি চালের প্রধান ভোক্তা। যদি অঞ্চলটি একটি সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয় তবে ভারতীয় রপ্তানি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতে পারে।

একইভাবে চা রপ্তানিকারকদের মধ্যে যারা ইরানের সঙ্গে তাদের ব্যবসা বাড়ানোর দিকে তাকিয়ে ছিল তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

স্বর্ণের দামে উর্ধ্বগতি

পশ্চিম এশিয়ায় উত্তেজনা বাড়ায় বিনিয়োগকারীরা আরও সতর্ক হবেন এবং ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ থেকে স্বর্ণে সরে যাবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, সোনার দাম ইতিমধ্যেই লাফিয়ে উঠেছে। মানিকন্ট্রোলের এক প্রতিবেদন মতে, প্রতি আউন্স সোনার দাম ইতিমধ্যেই ২৪১০ ডলার ছাড়িয়েছে।

ভারতের মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জে (এমসিএক্স) সোমবার (১৫ এপ্রিল) প্রতি ১০ গ্রাম সোনার দাম ৭২২১৪ রুপিতে উঠেছে এবং খোলার ঘণ্টা বাজানোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সর্বোচ্চ ৭২,৩৬২ রুপি ছুঁয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে, সোনার দাম ট্রয় আউন্স প্রতি ২,৩৬০ ডলারে লেনদেন হচ্ছে, যা শুক্রবারের থেকে প্রায় ০.৭০ শতাংশ বেশি।

কোটাক সিকিউরিটিজের বুলিয়ন অ্যান্ড এনার্জি রিসার্চের রয়েস ভার্গিস জোসেফ লাইভ মিন্টকে বলেন, “চলমান মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মধ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ায় সোনার দাম বাড়ছে। এই ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অনেক বিনিয়োগকারীকে নিরাপদ আশ্রয়ের সম্পদের দিকে চালিত করায় স্বর্ণের দাম ১.৬০ শতাংশ বেড়ে গেছে। তবে, এই দ্রুত বৃদ্ধি সত্ত্বেও সোনার সামগ্রিক প্রবণতা স্বাভাবিক রয়েছে, প্রতি ১০ গ্রাম সোনার দাম ৭০ হাজার রুপির আশেপাশেই রয়েছে।”

ভারতের শেয়ার বাজারে অস্থিরতা

স্টক মার্কেট বিশ্লেষকরা বলছেন, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ভারতের সেনসেক্স ও নিফটিতে প্রভাব ফেলবে এবং বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকতে হবে। জিওজিৎ ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস-এর গবেষণা প্রধান বিনোদ নায়ার সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, “মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা সরবরাহ উদ্বেগ বাড়ানোর পাশাপাশি, অপরিশোধিত তেলের মূল্যকে ঊর্ধ্বমুখী করেছে, সামগ্রিক বাজারের মনোভাবকে প্রভাবিত করেছে।”

কোটাক সিকিউরিটিজের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট শ্রীকান্ত চৌহান বলেছেন, “ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা বাজারের জন্য ইতিবাচক হবে না। তবে যদি অন্য দেশ জড়িত না হয় তাহলে হয়তো বাজারে এর প্রভাব পড়বে না।”

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার উত্তেজনা বিশ্বের অর্থনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে অর্থনৈতিক পন্ডিতদের মধ্য মতভেদ রয়েছে। তবে তারা একটি বিষয়ে একমত। ইনফোমেরিক্স রেটিংস এর প্রধান অর্থনীতিবিদ মনোরঞ্জন শর্মা যেমন বলেছেন, “এই সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র কী অবস্থান নেয় তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।”

তথ্যসূত্র: ফার্স্টপোস্ট

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত