জুলাই অভ্যুত্থানের আঁচ লেগেছে শর্ট ফিল্ম ফোরামে; উৎসব আয়োজন করতে গিয়ে দেখা দিয়েছে দ্বন্দ্ব; তাতে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সংগঠনটিতে বিভক্তির রেখা দেখা যাচ্ছে।
১৯৮৬ সালে সালে যাত্রা শুরুর পর ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছরই শর্ট ফিল্ম ফোরাম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করে আসছে।
জুলাই অভ্যুত্থানে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পালাবদলের পর এবার ডিসেম্বরে উৎসবের সপ্তদশ আয়োজন করা নিয়ে দেখা দিয়েছে মতভিন্নতা।
এই ফোরামের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম তানভীর মোকাম্মেল, মানজারে হাসীন মুরাদকে সম্প্রতি জুরি বোর্ড থেকে বাদ দেওয়ার পর ফোরামের এক জরুরি সাধারণ সভায় উৎসব স্থগিতের সিদ্ধান্ত হয় এবং তা সংবাদমাধ্যমকে জানানোও হয় ফোরামের প্যাডে দেওয়া বিবৃতিতে।
এদিকে ফোরামের একটি অংশ উৎসব আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে আবার সমর্থন দিচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
ফোরামের সভাপতি জহিরুল ইসলাম কচি জানান, শুক্রবার উৎসব উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পর্যাপ্ত সহযোগিতা ও অনুদানও পাওয়া গেছে।
তারা উৎসব আয়োজনের দিকে এগোলেও তা নিয়ে আবার প্রশ্ন তুলেছেন তানভীর মোকাম্মেলরা। তারা বলছেন, ‘অদৃশ্য শক্তির চাপে’ সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত না মানলে তা বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের উৎসব হিসাবে গণ্য হবে না।
স্থগিতের সিদ্ধান্ত এল যেভাবে
গত ১৭ ডিসেম্বর ফোরামের জরুরি বৈঠক হয়। সেখানে ফোরামের সভাপতি জহিরুল ইসলাম কচিও ছিলেন। ৪১ সদস্যের উপস্থিতিতে সেই সাধারণ সভায় উৎসব স্থগিতের সিদ্ধান্ত আসে।
ফোরামের অনুষ্ঠান ও কর্মশালা বিষয়ক সদস্য অপরাজিতা সংগীতা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কোনও এক মহলের চাপে নির্বাহী কমিটি গুণী নির্মাতা ও সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও ফেস্টিভ্যাল চেয়ারম্যান তানভীর মোকাম্মেল এবং মানজারে হাসীন মুরাদকে জুরি চেয়ার থেকে বাদ দেয় নভেম্বরে অনুষ্ঠিত এক সভায়। কেননা ওই মহলটি মনে করে, তাদের দুজনকে অপসারণ না করলে ফেস্টিভ্যাল করা যাবে না।
“এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্র যথাযথভাবে মানা হয়নি। কেননা, সে মিটিংয়ে পর্যাপ্ত উপস্থিতি ছিল না।”
তার পরিপ্রেক্ষিতেই ১৭ ডিসেম্বর জরুরি সাধারণ সভা হয়। এই অবস্থায় উৎসব আয়োজন করা যাবে কি না, তা নিয়ে ভোটাভুটিও হয়।
সভায় থাকা সংগীতা বলেন, “সভায় ২০ থেকে ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪-এ অনুষ্ঠিতব্য ১৭তম বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য এবং মুক্ত চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ে সদস্যদের মধ্যে মতদ্বৈততা তৈরি হলে ভোটের আয়োজন করা হয়।
“সভায় উপস্থিত ৪১ সদস্যের মধ্যে ২৮ জন সদস্য চলচ্চিত্র উৎসবটি এই মুহূর্তে স্থগিত করার পক্ষে, ৫ জন সদস্য নির্ধারিত সময়ে চলচ্চিত্র উৎসবটি হওয়ার পক্ষে ভোট দেন এবং ৮ জন সদস্য ভোটদানে বিরত থাকেন।”
সভার ওই পর্যায়ে কচি বৈঠক থেকে উঠে গেলে সহ-সভাপতির সভাপতিত্বে সভা চলতে থাকে। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে উৎসব স্থগিতের সিদ্ধান্ত হয়।
সেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি আসে তানভীর মোকাম্মেল, মানজারে হাসীন মুরাদ ও মোরশেদুল ইসলামের স্বাক্ষরে। তারা তিনজনই ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উৎসব স্থগিতের সিদ্ধান্ত না মেনে কেউ উৎসব করলে তা বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের উৎসব নয় বলে গণ্য হবে।
এরপর পাল্টা বিবৃতিতে কচি স্বাক্ষরিত আরেকটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “শর্ট ফিল্ম ফোরামের প্যাড ব্যবহার করে এ ধরনের বিবৃতি বা উৎসব স্থগিত করার এখতিয়ার তাদের নেই। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই যে উৎসব যথারীতি চলবে।”
তানভীর মোকাম্মেল কেন বাদ?
উৎসব কমিটির প্রস্তাবিত চেয়ারম্যান তানভীর মোকাম্মেলের দেওয়া এক সাক্ষাৎকার নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়।
বিবৃতিতে জহিরুল ইসলাম কচি বলেন, “বিবৃতিতে তারা বলেছেন, উৎসব আয়োজনে অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে তারা উৎসব বয়কট করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেলের কটূ মন্তব্য উৎসবকে সংকটে ফেলে।
“তানভীর মোকাম্মেল নাগরিক নামের ভারতীয় পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে এটি ছিল ছাত্র-জনতার একটি গণ-আন্দোলন। কিন্তু নেপথ্যে তা ছিল শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানোর জন্য আমেরিকার সিআইএ ও পাকিস্তানের আইএসআই দ্বারা পরিকল্পিত, মার্কিন প্রশাসনের অর্থায়ন ও সহযোগিতায় জামায়াতে ইসলামী, হিযবুত তাহরীর এবং অন্যান্য ইসলামিক শক্তিগুলোর এক ইসলামি অভ্যুত্থান।”
তানভীর মোকাম্মেলের ওই সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর সরকারি, বেসরকারি সব মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয় বলে কচি জানান।
“তার পরিপ্রেক্ষিতেই সভা ডেকে তাদের (তানভীর ও মুরাদ) কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।”
তবে অপরাজিতা সংগীতা বলেন, “নির্বাহী কমিটি সভা ডেকে তাদের বাদ দিতে পারে না। গঠনতন্ত্রে আছে, যদি বাদ দিতেই হয়, তবে বার্ষিক সাধারণ সভা বা জরুরি সাধারণ সভার মাধ্যমে এটি সকল সদস্যের উপস্থিতিতে ও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যা মানা হয়নি।”
পাল্টা অভিযোগ কচির
তানভীর মোকাম্মেলসহ এক পক্ষ উৎসব স্থগিত করতে চাপ দিয়ে যাচ্ছিল বলে অভিযোগ করেন কচি।
তিনি বিবৃতিতে বলেন, “ফোরামের একটি অংশ নানা টালবাহানা করে উৎসব বাতিল করার জন্য নির্বাহী কমিটি ও পুনর্গঠিত ফেস্টিভ্যাল কমিটিকে চাপ দিতে থাকে। এমনকি তারা এমনও বলেছেন যে উৎসব আয়োজনে তাদের সমর্থন পাওয়া যাবে যদি দুজন উপদেষ্টাকে উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠান থেকে তাদের বাদ দেওয়া হয়।
“বিগত উৎসবগুলোতে তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রীদের নিয়ে উৎসব আয়োজন করলেও তারা এ ধরনের প্রস্তাব দিয়ে তাদের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ব্যাপারে তাদের অবস্থানকেই তুলে ধরেছেন।”
তানভীর ও মুরাদকে বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্রের বিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে কচি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তারা একটি কাল্পনিক গঠনতন্ত্রের কথা বলছেন। বাস্তবের গঠনতন্ত্রটি আমার মুখস্থ আছে। সে অনুযায়ী নিয়ম মেনেই যথাযথভাবে তাদেরকে পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। কেননা গঠনতন্ত্র নির্বাহী কমিটিকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার দিয়েছে।
“বরং তারা যে বিশেষ জরুরি সভাটি ডেকেছেন, তাতে কোরাম পূর্ণ হয়নি। আমাদের দুই আড়াইশ সদস্য আছে। তাদের মধ্য থেকে মাত্র অল্প কিছু সদস্যের সরাসরি উপস্থিতি ও ভার্চুয়াল উপস্থিতির মধ্য দিয়ে সভাটি হয়, যা মূলত তাদের আহ্বান করারও এখতিয়ার ছিল না। তবু আমরা উপস্থিত ছিলাম, মতবিনিময় সভার মতো করে ভেবে নিয়েই। মূলত তাদের আপত্তি উৎসবে বর্তমান সরকারের দুই উপদেষ্টার উপস্থিতি নিয়ে।”
শুক্রবার উদ্বোধন
কচি বলেন, “স্বাভাবিকভাবেই আগামীকাল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে উৎসব।”
উৎসবের আয়োজন নিয়ে কচি স্বাক্ষরিত বিবৃতিটি সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার ফেইসবুক পাতায় শেয়ারও করেছেন।
সূচি অনুযায়ী, শুক্রবার বিকাল ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। বিশেষ অতিথি থাকবেন আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন ও কথা সাহিত্যিক মাসরুর আরেফিন।
১০১টি দেশের ২৭৬টি চলচ্চিত্র নিয়ে এবারের উৎসবের আয়োজন হয়েছে বলে কচি জানান।