Beta
শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

চীনের ঋণজালে উন্নয়নশীল অনেক দেশ, পাওনা ১.১ ট্রিলিয়ন ডলার

Developing countries owe China at least
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে চীন এখনও কমপক্ষে ১.১ ট্রিলিয়ন ডলার পায়। গত ২০ বছর ধরে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দেওয়া ঋণের অর্ধেকেরও বেশি এখনও ফিরে পায়নি দেশটি। চীনের ঋণ নেওয়া সব দেশ অর্থনৈতিক দূরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ফলে তারা চীনের ঋণও পরিশোধ করতে পারছে না।

অন্যদিকে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চীনের ঋণ পরিশোধ করতে না পারা দেশের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। এমনকি চীনের ঋণ নেওয়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৮০ শতাংশই বর্তমানে আর্থিক সংকটে রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ল্যাব এইডডেটার গবেষণায় এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

বহুবছর ধরেই চীন দরিদ্র দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে প্রচুর ঋণ দিয়ে আসছে। যার মধ্যে ২০১৩ সালে শুরু হওয়া ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পও রয়েছে। গত মাসে বিআরআই প্রকল্পের এক দশক পূর্ণ হয়।

লাতিন আমেরিকা থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোকে চীন উদারহস্তে ঋণ দেয়। রাস্তা, বিমানবন্দর, রেলপথ এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উন্নয়নে এই ঋণ দেওয়া হয়। এতে অনেক দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ঋণ সহায়তা পেয়ে অনেক দেশের সরকারই চীনের সঙ্গে ঘণিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। আর চীন বিশ্বের বৃহত্তম ঋণদাতা দেশ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। তবে, চীনের বিরুদ্ধে দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ঋণ দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।

এইডডেটার তথ্য মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দেওয়া চীনের ঋণের ৫৫ শতাংশ পরিশোধের সময় চলে এসেছে। গত বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চীন বিশ্বের ১৬৫টি দেশে ঋণসহায়তা দেয়। সেসব ঋণচুক্তির তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেই এই খবর দিয়েছে এইডডেটা।

তবে, চীনের ঋণ পরিশোধের সময় হয়েছে এমন এক সময়ে এসে যখন বিশ্বজুড়ে চ্যালেঞ্জিং অর্থনৈতিক আবহাওয়া বিরাজ করছে। উচ্চ সুদের হার, স্থানীয় মুদ্রার দরপতন এবং প্রবৃদ্ধির গতি মন্থর হয়ে যাওয়ায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নেই।

“এই ঋণের অনেকগুলোই ২০১৩ সালে শুরু হওয়া বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের অধীনে ইস্যু করা হয়েছে। ঋণগুলো পরিশোধে পাঁচ থেকে ছয় বা সাত বছর পর্যন্ত সময়ও বাড়ানো হয়েছিল। তারপরে করোনা ভাইরাসের মহামারী চলাকালীন আরও দুই বছর সময় বাড়ানো হয়।”

“কিন্তু সেই চিত্র বদলে যাচ্ছে … গত এক দশক ধরে চীন ছিল বিশ্বের বৃহত্তম সরকারী ঋণদাতা। আর এখন চীন হতে চলেছে বিশ্বের বৃহত্তম সরকারী ঋণ সংগ্রাহক দেশ।” এইডডেটার নির্বাহী পরিচালক এবং গবেষণা প্রতিবেদনের লেখক ব্র্যাড পার্কস সিএনএনকে এসব কথা বলেন।

এই ডেটার গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০-২০২১ সালের মধ্যে চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ১.৩৪ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। নিম্ন এবং নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সরকারি এবং বেসরকারি খাতে এই ঋণ দেওয়া হয়।

২০২১ সাল পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণগ্রহীতারা চীনের কাছ থেকে মোট ১.১ থেকে ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। সুইজারল্যান্ডে ব্যাংক অফ ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টের সদর দফতরে ঋণদাতাদের পেশ করা প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে এই তথ্য জানা গেছে।

‘আন্তর্জাতিক সংকট ব্যবস্থাপক’

এইডডেটার গবেষণা মতে, ২০০৮ সাল পর্যন্ত চীনের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ দেশের সংখ্যা ছিল মাত্র ১০টি। কিন্তু ২০২১ সাল সেই সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৫৭টিতে। এর ফলে চীন তার ঋণসহায়তার কৌশল পরিবর্তন করে। বড় অবকাঠামো উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। তার পরিবর্তে ‘জরুরি উদ্ধার ঋণ’ দেওয়া শুরু করে।

তবে, চীন ঋণ দেওয়া বন্ধ করেনি। এখনো চীন বিশ্বের উন্নয়ন অর্থায়নের একক বৃহত্তম সরকারি উৎস। সবচেয়ে শক্তিশালি অর্থনীতির দেশগুলোর জোট গ্রুপ অফ সেভেন (জি-সেভেন) এর মতো বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের চেয়েও চীন বেশি ঋণ দেয়।

চীনের প্রভাব কমাতে যুক্তরাষ্ট্র এবং জি-সেভেন অংশীদাররা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ঋণসহায়তা দেওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী ৮৪ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা দিয়ে সে বছর চীনকে ছাড়িয়ে যায় তারা।

এইডডেটার গবেষণা প্রতিবেদন মতে, করোনা মহামারীর শুরুতে চীনের ঋণসহায়তার পরিমাণ কমে আসে। ২০১৬ সালে চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ১৫০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল। যা এক বছরে সর্বোচ্চ। কিন্তু করোনা মহামারীর সময় বিশ্বব্যাপী চীনের বার্ষিক ঋণসহায়তার পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। ২০১৪ সালের পর থেকে ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো তা ১০০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। সে বছর বিশ্বকে চীন মোট ৭৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়।

তবে বিশ্বের প্রতি চীনের ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতির পরিমাণ খুব বেশি কমেনি। ২০২১ সালে চীন বিশ্বকে ৭৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়। তুলনায়, সে বছর বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল দেশগুলোকে মাত্র ৫৩ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেল।

কিন্তু অনেক দেশ সময় মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় চীন অবকাঠামো প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। ২০১৪ সালে চীন উন্নয়শীল দেশগুলোকে যে ঋণ দেয় তার ৬৫ শতাংশই ছিল অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য। কিন্তু ২০১৭ সালে তা কমে ৫০ শতাংশে নেমে আসে। ২০১৮ সালে যা ছিল ৪৯ শতাংশ। আর ২০২১ সালে তা আরও কমে মাত্র ৩১ শতাংশে নেমে আসে।

২০২১ সালে চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যে ঋণসহায়তা দেয় তার ৫৮% ছিল জরুরি উদ্ধার ঋণ। এই ঋণ মূলত সংকটের সময় টিকে থাকতে, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ এবং ক্রেডিট রেটিং বাড়াতে বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের ঋণ পরিশোধে ব্যবহৃত হয়।

তার মানে, চীন ক্রমবর্ধমানভাবে ‘আন্তর্জাতিক সংকট ব্যবস্থাপক’ হিসেবে আবির্ভুত হচ্ছে। আর্থিক সংকটে থাকা ঋণগ্রহীতা দেশগুলোর সংকটমুক্তি নির্ভর করছে চীনা ব্যাংকিং খাতে তারা কতটা ঝুঁকি তৈরি করতে তার উপর। ঝুঁকি বেশি হলে চীন তাদেরকে জরুরি উদ্ধার ঋণ দেবে। আর নয়তো দেবে না।

পার্কস বলেন, “তবে এমন নয় যে, যারা ঋণ নিয়ে সংকটে আছে তারা সবাই চীন থেকে জরুরি উদ্ধার ঋণ পায়। তার পরিবর্তে আমরা দেখতে পাই যে, চীন এই ঋণ মূলত বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতাদেরকেই দেয়, যেখান থেকে চীনা ব্যাঙ্কগুলো সবচেয়ে বেশি ঋণ উদ্ধার করতে পেরেছে।”

“বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, চীন যেন ঋণগ্রহীতাদেরকে সংকট থেকে উদ্ধার করছে। কিন্তু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে, চীন আসলে তার নিজের ব্যাঙ্কগুলোকেই উদ্ধার করছে।”

‘বলপ্রয়োগ’

চীনের ব্যাংকগুলো ইতিমধ্যেই অভ্যন্তরীণ ঋণের সমস্যায় জর্জরিত। তার ওপর এই সমস্যাযুক্ত বৈদিশক ঋণগুলো চীনের নিজস্ব ব্যাঙ্কিং খাতে কী প্রভাব ফেলতে পারে তা এখনো স্পষ্ট নয়।

জাম্বিয়া এবং ঘানার মতো সংকটে থাকা ঋণগ্রহীতাদের উদ্ধারের বিষয়ে চীন বিশ্বের অন্যান্য ঋণদাতাদের স ঙ্গে যৌথ আলোচনায় যোগ দিয়েছে, তা সত্য। তবে এইডডাটার গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো ঋণগ্রহীতা সময় মতো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে চীন নিজের ক্ষতিপূরণে চুক্তিতে থাকা জামানতের বাইরেও ঋণগ্রহীতার সম্পদ জব্দ করার মতো শর্ত দেয়। এতে ঋণগ্রহীতাকে সংকট থেকে উদ্ধারের যে সমন্বিত প্রচেষ্টা নেওয়া হয় তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। দেরিতে ঋণ পরিশোধের কারণেও চীন ঋণগ্রহীতাদের বাড়তি জরিমানা করে।

তবে, চীন ধারাবাহিকভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলছে, তারা বহুপাক্ষিক প্রচেষ্টায় ‘ইতিবাচক’ এবং ‘গঠনমূলক’ ভূমিকা পালন করছে। গত মাসে চীন বলেছে যে, বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে ‘ঋণ স্থায়িত্বের উন্নতিও অব্যাহত রয়েছে’।

এ ছাড়া চীন সিন্ডিকেট ভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থার দিকেও এগিয়ে গেছে। পশ্চিমা বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে চীন প্রকল্পগুলো পরীক্ষা করে এবং ভবিষ্যতের ঝুঁকি কমায়।

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে চীনের সাধারণ ঋণসহায়তার অর্ধেক এখন সিন্ডিকেট ভিত্তিক ঋণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে চীনের দেওয়া ৮০%-রও বেশি ঋণের সঙ্গে এখন পশ্চিমা বা বহুপাক্ষিক অংশীদাররাও যুক্ত থাকে।

সম্প্রতি চীন বিআরআই প্রকল্পে তদারকি জোরদার এবং ঝুঁকি কমানোর লক্ষ্যে প্রকল্পটি ভিন্নভাবে ঢেলে সাজাচ্ছে। বিআরআই প্রকল্প নিয়ে বিশ্বজুড়ে পরিবেশগত, সামাজিক এবং শ্রম উদ্বেগের প্রেক্ষিতে চীন এই পদক্ষেপ নিয়েছে।

বিআরআই প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ দূর করতে চীন প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে। গত মাসে বেইজিংয়ে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নিয়ে আয়োজিত ফোরামে চীনের কর্মকর্তারা বলেন, বিআরআই প্রকল্প নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। এই প্রকল্পে এখন ‘উচ্চ মানের’ উন্নয়নের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পের এই নতুন পর্যায়ের প্রশংসাও করছিলেন তারা।

এদিকে, যেসব দেশ ইতিমধ্যেই ঋণের মধ্যে রয়েছে এবং সেই ঋণ পরিশোধের জন্য চীনের জরুরি উদ্ধার ঋণ নিতে চাইছে এইডডেটার গবেষকরা তাদের সতর্ক করেছেন । এইডডেটার গবেষকরা তাদের উদ্দেশে বলেন, “কম ব্যয়বহুল ঋণ পরিশোধের জন্য আরও ব্যয়বহুল ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ার বিপদ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত