দেশের সড়কগুলোয় চলাচলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের জন্য আলাদা গতিসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে ও দুর্ঘটনায় প্রাণহানী কমাতে গতিসীমা বেঁধে নির্দেশনা জারি করে সংস্থাটি।
গত ৭ মে এই নির্দেশনা জারির পর থেকে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হলো পৌরসভা, সিটি করপোরেশন কিংবা জেলা সদরের অভ্যন্তরীণ সড়কে মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ ৩০ গতি কিলোমিটার ঠিক করে দেওয়া।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ বলছে, এই খাতের বিশেষজ্ঞসহ অংশীজনদের পরামর্শ অনুযায়ীই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নির্দেশিকা কোনোভাবেই বিজ্ঞানসম্মত নয়।
মোটরযান গতিসীমা নির্দশিকায় যা বলা আছে
কী বলছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে পরামর্শ করেই যানবাহনের এই গতিসীমা নির্ধারণ করেছি। বুয়েটের অধ্যাপকের পরামর্শ নিয়েছি, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলোর পরামর্শ নিয়েছি। সবার পরামর্শ নিয়েই যৌক্তিক একটা গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। যারা এটা নিয়ে সমালোচনা করছেন তারা অযৌক্তিক কথা বলছেন।”
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই শহরাঞ্চলে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার উল্লেখ করে তিনি বলেন, সে অনুযায়ীই এবার গতিসীমা ঠিক করা হয়েছে। অতিরিক্ত গতির কারণে এপ্রিলেও দেশের সড়কে ২০০ জনের প্রাণ গেছে বলে জানান তিনি।
সমালোচনার প্রসঙ্গে এই সচিব বলেন, “গতি কম থাকলে এত প্রাণহানি হতো না। এখন আপনাদের কথায় গতিসীমা বাড়িয়ে দিলে যখন কোনও দুর্ঘটনা ঘটবে, তখন আপনারাই আবার বলবেন গতির কারণে সড়কে মৃত্যু বেড়ে গেছে।”
সড়কে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রতিনিয়ত কাজ করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, গতিসীমা নির্ধারণ ছাড়াও সড়কের অব্যবস্থাপনা রোধে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পুলিশ, বিআরটিএর ম্যাজিস্ট্রেটরা প্রতিদিন অভিযান চালাচ্ছেন, প্রতিদিনই হাজার হাজার মামলা হচ্ছে।
শিগগিরই সড়কের শৃঙ্খল চিত্র দেখা যাবে, এমন প্রত্যাশাই তার।
পরামর্শ নেওয়া হয়েছে, মানা হয়নি
নতুন এ নির্দেশিকা জারির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের কোনও পরামর্শ মানা হয়নি বলে অভিযোগ করলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এআরআইয়ের পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক।
তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমাদের কোনও পরামর্শ আমলে নেওয়া হয়নি। এটাতো একটা বৈজ্ঞানিক বিষয়। তারা যাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন তাদের কয়জন বিজ্ঞানটা জানেন সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। তবে না জানা লোকের দলই যখন ভারি হয়ে যায়, তখন তাদেরটাই বাস্তবায়ন হয়ে যায়।”
গতিসীমা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনায় এআরআই এর একজন প্রতিনিধি ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, কিন্তু সেই প্রতিনিধিন পরামর্শের কোনও মূল্যায়নই করা হয়নি।
গতিসীমা নির্ধারণের মতো বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে কেন একজন সচিব কথা বলবেন, সে প্রশ্নও তোলেন এই অধ্যাপক।
বৈজ্ঞানিক উপায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে ১০০ জনকে ডেকে কথা বলে তাদের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন পড়ত না বলেও মন্তব্য করেন এআরআইয়ের পরিচালক।
তিনি বলেন, “পুরো পৃথিবীতেই শহর এলাকায় যানবাহনের গতি কম থাকে। সেটা ঠিক, কিন্তু কোথাও একই রাস্তায় গতির এত বৈচিত্র্য থাকে না। অর্থাৎ একই সড়কে গাড়ি চলবে বেশি গতিতে, মোটরসাইকেল চলবে কম গতিতে এমনটা কখনও হয় না। কারণ এটা তো তখন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।”
শহরের সড়কে গতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে তা সব যানবাহনের জন্যই করতে হবে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। তাহলে গতি নিয়ন্ত্রণও সহজ হবে, যাদের গতিসীমা মানতে তাদের জন্যও সহজ হবে।
একই সড়কে ভিন্ন ভিন্ন যানবাহনের জন্য আলাদা গতিসীমা বাস্তবায়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয় বা বিজ্ঞানসম্মতও নয়, বললেন তিনি।
কোনও দেশেই এখন দূরপাল্লার সড়কে গতি কমানো হয় না, বরং বাড়ানো হয় বলে জানান শামসুল হক।
তিনি বলেন, “ভারতে এখন ১২০-১৩০ কিলোমিটার গতিতে মহাসড়কে গাড়ি চলে। শ্রীলংকা-নেপালে চলে ১১০ কিলোমিটার গতিতে। কেন? কারণ এটা বিজ্ঞানের যুগ, গতির যুগ। মহাসড়কের সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত, সেখানে পথচারী কিংবা পার্কিং এলাকা কম। সেজন্য গতিও বেশি রাখা হয়।”
আমাদের দেশের মহাসড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় হাইওয়ে পুলিশের সক্ষমতা সীমিত, সে প্রসঙ্গটিও মনে করিয়ে দিলেন তিনি।
কেন এ যুক্তি দিচ্ছেন, সকাল সন্ধ্যার পাঠকদের জন্য তা বুঝিয়েও দিলেন।
শামসুল হক বলেন, ধরা যাব একটি সড়কের সর্বোচ্চ গতি ৮০ কিলোমিটার। সেখানে ৯০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চললে সেটিকে আটকানো হবে। কিন্তু সেই সড়কেই যদি ৬০ কিলোমিটার গতিতে কোনও গাড়ি চলে তাহলে তার দিকে নজর দেওয়ার উপায় থাকে না। অথচ মহাসড়কে দুর্ঘটনার জন্য কিন্তু ৯০ কিলোমিটার গতিতে চলা গাড়ির চেয়ে ৬০ কিলোমিটার গতিতে চলা গাড়িটি বেশি দায়ী। নির্ধারিত গতির চেয়ে কম গতিতে চলার কারণে ওই গাড়িকে যখন অন্যরা ওভারটেক করতে যায় তখনই বেশি দুর্ঘটনা ঘটে।
কেবল বেশি গতির গাড়ি শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়াকে পরিবহন ব্যবস্থার অক্ষমতা বলেই মনে করেন তিনি।
অতিরিক্ত গতির কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে, এ কথার সঙ্গে একমত নন এই বিশেষজ্ঞ।
তার মতে, দুই চাকার এই যানটি অন্য যানবাহনের তুলনায় এমনিতেই ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এটা যদি ৩০ কিলোমিটার গতিতেও চলে তারপরও দুর্ঘটনা হবে। চলার পথে মোটরসাইকেলের চাকা গর্তে পড়তে পারে, সড়কে পিচ্ছিল কিছু থাকলে, বালি থাকলেও পড়ে যেতে পারে। আবার বাতাসের গতিবেগের কারণেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়তে পারে।
মোটরসাইকেলকে পুরো পৃথিবীতেই এলার্জিক হিসেবে দেখা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সে কারণে এটাকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অন্যদিকে আমাদের দেশে মোটরসাইকেল কারখানা স্থাপন সহজ করা হয়েছে, রেজিস্ট্রেশন ফি অর্ধেক করা হয়েছে। এতে মোটরসাইকেলের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
সাড়ে ৩০০ সিসির মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমোদন দেওয়ার পর বলা হচ্ছে আপনি ৩০ কিলোমিটার গতিতে চালাবেন, এটা কোনোভাবেই বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত নয়।
এভাবে কোনও দিনই মোটরসাইকেলের গতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না বলে মত দেন তিনি।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমানও বললেন একই ধরনের কথা।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমাদের কোনও পরামর্শ মানা হয়নি। সড়কে গতি নিয়ন্ত্রণ হোক সেটা আমরাও চাই। কিন্তু একই সড়কে ভিন্ন ভিন্ন যানবাহনের জন্য আলাদা গতিসীমা নির্ধারণ উদ্ভট সিদ্ধান্ত। এতে দুর্ঘটনা কমার পরিবর্তে আরও বাড়বে।”
যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তাদের পরামর্শ চাওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা মানা হয় না, অভিযোগ করলেন তিনি। বললেন, এবারও অন্য সব সময়ের মতো সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।