Beta
বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০২৫

এত সংস্কারের ভিড়ে কোটা সংস্কার গেছে হারিয়ে

সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে শাহবাগে অবস্থানে আন্দোলনকারীরা। ফাইল ছবি : হারুন অর রশীদ রুবেল
সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে শাহবাগে অবস্থানে আন্দোলনকারীরা। ফাইল ছবি : হারুন অর রশীদ রুবেল
[publishpress_authors_box]

আন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে, সেই আন্দোলনে সরকারই গেল পড়ে; এরপর যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলো, সেখানে আন্দোলনকারীদের দুই নেতাও রয়েছেন, তারা নানা সংস্কারে হাতও দিয়েছেন; কিন্তু কোটা নিয়ে আর কোনও কথা হচ্ছে না।

আন্দোলনের মুখে আদালতের নির্দেশে আওয়ামী লীগ সরকার কোটার যে অনুপাত ঠিক করে গিয়েছিল, তা থাকবে কি থাকবে না, তা নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না আন্দোলনকারীদের নেতা কিংবা সরকারের কাছ থেকে।

সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা আছে এখন ৭ শতাংশ। তার ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য, ১ শতাংশ নৃ গোষ্ঠির জন্য এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য।

এই কোটার অনুপাত নিয়ে আপত্তি রয়েছে নৃ গোষ্ঠীর মধ্যে। আবার নারী কোটা বাদ পড়ায় তা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে নারী অধিকারকর্মীদের।

ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোটার অনুপাত আসলে কী হবে, তা নিয়ে সবার কৌতূহল থেকেই যাচ্ছে।

বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তনের পর ২০১৮ সালের আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৫ শতাংশ পদ কোটায় সংরক্ষিত ছিল।

বিন্যাস ছিল এই রকম- মুক্তিযোদ্ধা ৩০ শতাংশ (ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনি), নারী ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ ও নৃ-গোষ্ঠী ৫ শতাংশ।

এই ৫৫ শতাংশ কোটায় পূরণযোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে ১ শতাংশ পদে প্রতিবন্ধী নিয়োগের নিয়মও ছিল।

২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদে (নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড পর্যন্ত) নিয়োগে কোটা বাতিল করেছিল সরকার।

সেই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালে ২০২১ সালে হাইকোর্টে আবেদন করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।

গত ৫ জুন হাইকোর্ট সেই মামলার রায়ে সব কোটা পুনর্বহালের আদেশ দেয়। তবে রায়ে বলা হয়, সরকার চাইলে কোটার হার পুনর্বিন্যাস করতে পারবে।

শাহবাগে অবরোধকারী শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, কোটার কারণে চাকরিতে নিয়োগে মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে। ফাইল ছবি : হারুন অর রশীদ

আদালতের ওই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় নতুন করে আন্দোলন শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ব্যানারে। ১ জুলাই রাজপথে কর্মসূচিতে নামে শিক্ষার্থীরা। তাদের মিছিলে-সমাবেশে স্লোগান কোটার বিরুদ্ধে হলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা জানান, তারা চান কোটার ‘যৌক্তিক সংস্কার’।  

প্রথমে শাহবাগকেন্দ্রিক কর্মসূচি চলতে থাকলেও ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার পর প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। তার আগের দিন আন্দোলনকারীদের নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক বক্তব্যও আন্দোলনের গতি বাড়িয়ে দেয়।

পরদিন ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ৬ জন নিহত হওয়ার পর আন্দোলন নতুন দিকে মোড় নেয়। তখন কোটা সংস্কারে সরকারের আশ্বাসেও কাজ হচ্ছিল না।

আন্দোলন দমনে সরকারের কঠোর অবস্থানে কয়েকশ মানুষের মৃত্যুর পর ২১ জুলাই সর্বোচ্চ আদালত কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে। সেই সঙ্গে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ পদ রেখে বাকি ৭ শতাংশ পদ কোটার জন্য রাখতে বলা হয়।

সেই নির্দেশনার আলোকে পরদিনই সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে নিয়োগে ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে, ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য, ১ শতাংশ নৃগোষ্ঠীর জন্য এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য কোটা রেখে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি হয়।

তবে ততদিনে পরিস্থিতি বদলে গেছে। হতাহত ও নেতাদের আটকের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আট দফা দাবি তুলে ২৪ জুলাই ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনকারীরা, সেখানে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ ছিলেন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় ‘সন্তানের পাশে অভিভাবক' ব্যানারে মৌন অবস্থান কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনার প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন অভিভাবকরাও। ফাইল ছবি : সকাল সন্ধ্যা

সেদিন তাদের উত্থাপিত ৮ দফা কিংবা জরুরি ৪ দফায় কোটা নিয়ে কোনও কথা ছিল না। ইন্টারনেট সচল, কারফিউ প্রত্যাহার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া, সমন্বয়কদের নিরাপত্তা ছিল তাদের জরুরি চারটি দাবি।

আট দফা দাবির মধ্যে ছিল-  খুনের ঘটনা তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিচার, শহীদদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা, মাসিক ভাতা ও তাদের পিতা-মাতার মতামতের ভিত্তিতে একজন সদস্যকে চাকরির নিশ্চয়তা দেওয়া, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রশাসনিকভাবে সিট বরাদ্দ, সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করা এবং ছাত্র সংসদ চালু করা, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সব শিক্ষার্থীকে সব ধরনের রাজনৈতিক, আইনি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের মাধ্যমে একাডেমিক হয়রানি না করার নিশ্চয়তা দেওয়া।

এই আট দফা দাবি নিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সরকারের তিনজন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখাও করে এসেছিলেন দুজন সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ এবং সহ-সমন্বয়ক তানভীর আহমেদ।

নাহিদ আটক থাকার মধ্যে মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করা নিয়ে সমন্বয়কদের মধ্যে মতবিরোধের খবরও তখন এসেছিল। সমন্বয়কদের একজন আব্দুল কাদের আবার ৯ দফাও ঘোষণা করেছিলেন অজ্ঞাত স্থান েথকে।

কোটা সংস্কারের পর আন্দোলন স্থগিত করতে সরকারের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে ২৬ জুলাই নাহিদের নামে এক বার্তা আসে সরকারের ওপর আর আস্থা না রাখার।

সরকারের কথায় কেন ভরসা রাখছেন না, তার ব্যাখ্যায় নাহিদ ফেইসবুকে লিখেছিলেন, “২০১৮ সালেও আন্দোলনের চাপে পরিপত্র জারি করা হয়েছিল। ৬ বছরেই সেটা বাতিল করা হয়৷ আমরা এই পরিপত্র বা প্রজ্ঞাপনের খেলায় আর বিশ্বাস করি না।”

গত ১৪ জুলাই রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে স্মারকলিপি জমা দিয়ে গুলিস্তানে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ফাইল ছবি : সকাল সন্ধ্যা

এরপর দিন যতই গড়াতে থাকে সংঘাত-সহিংসতায় মৃত্যুর মিছিলও বাড়ে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন রূপ নেয় গণআন্দোলনে। শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের আলোচনার প্রস্তাব দিলেও তা প্রত্যাখ্যান করে ৩ আগস্ট শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে সরকারের পদত্যাগের ১ দফা দাবি তোলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

আন্দোলনের চাপে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা, অবসান ঘটে তার দেড় দশকের শাসনের।

৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে সেই সরকারে উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেন আন্দোলনকারী দুই নেতা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া।

সেই সরকারের কর্তা-ব্যক্তি এবং পরামর্শকরা এখন রাষ্ট্র সংস্কারের ওপরই জোর দিচ্ছেন। গত ১১ সেপ্টেম্বর ড. ইউনূস বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠনের েঘাষণা দেন।

নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কারে গঠিত এই ছয় কমিশনের অক্টোবর থেকে কাজ শুরুর কথা।

এছাড়া আরও সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা উঠলেও কোটা নিয়ে আর উচ্চবাচ্য নেই এখন।

বহুল আলোচিত কোটার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া অনুপাতই কি থাকবে- সকাল সন্ধ্যা এই প্রশ্ন রেখেছিল জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর কাছে।

হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তিনি এবিষয়ে এখন কোনও মন্তব্য করতে পারছেন না।

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সংযুক্ত উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারেরও কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি এই বিষয়ে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলমের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, তাদেরও এনিয়ে সুস্পষ্ট কোনও অবস্থান নেই।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পরিস্থিতি বিবেচনায় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ যদি মনে করে যৌক্তিক সংস্কার প্রয়োজন। সেই সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করা যেতে পারে।”

গত জুলাই মাসে সকাল সন্ধ্যাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাহিদ বলেছিলেন, “আমরা কোটা বাতিল চাচ্ছি না। আমরা সংস্কারই চাচ্ছি। একটি কমিশন গঠন করে কোটার একটি যৌক্তিক সংস্কারের মাধ্যমে এটিকে যেন সংশোধন করা হয়।”

কোটা ১০ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখার কথা তখন বলেছিলেন নাহিদ, তবে আদালতের নির্দেশে সরকার তা আরও কমিয়ে ৭ শতাংশে এনেছিল।

সারজিস এখন বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষপাতি।

তিনি বলেন, “বিগত সরকারের যে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে সরকারের যে কোনও চাকরির পরীক্ষায় এটা যাতে প্রয়োগ করা হয়।”

তবে কোটা এই অনুপাত নিয়ে ক্ষুব্ধ নারী সংগঠনগুলো মনে করে, ৫ শতাংশ নারী কোটা তুলে দেওয়ায় নারীদের পিছিয়ে পড়ার একটি ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কারণ রাষ্ট্র ও সমাজে এখনও নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

অন্যদিকে আদিবাসী সংগঠনগুলো বলছে, এমন কোনও বাস্তবতা তৈরি হয়নি যাতে পিছিয়ে থাকা নৃগোষ্ঠীর কোটা ৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে নামিয়ে আনার পক্ষে যুক্তি দেওয়া যায়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত