সকাল সন্ধ্যা: ২০১৮ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে তৎকালীন নির্বাচন নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, আশাবাদের ওপর ভরসা রাখাও কঠিন হয়ে পড়ছে। এবারের নির্বাচন নিয়ে কী বলবেন?
শারমীন মুরশিদ: আমার নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার অভিজ্ঞতা প্রায় ২২ বছরের বেশি হয়ে গেল। ২০০১ সাল থেকে আমি এ কাজটি শুরু করেছি। এ দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আমরা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছি একটা সুব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে। এরপর সেটিকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সূচক ধরে ধরে দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। মনে রাখতে হবে, ২০০১ সালে নির্বাচন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। অর্থ্যাৎ মানগত পরিবর্তনের একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখতে পেয়েছি, যদি মোটা দাগে বলি— আমাদের নির্বাচনগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বলি, আর দলীয় সরকারের অধীনে বলি, ত্রুটিমুক্ত কখনোই হতে চায় না— হয় না। দলীয় সরকারে অধীনে অত্যন্ত বেশি ক্রটি থাকে— সহিংস থাকে। এ ধারার মধ্যেই আমরা চলে এসেছি। আমরা যদি দেখি, ২০০৮-এর নির্বাচনের একটা মান— সেটা বেশ উৎকৃষ্ট একটা মান, সেটাকে আমরা ব্যাখ্যা করে বলতে পারি কেন ভালো। ২০১৪-এর নির্বাচন আমাদের জন্য একটা হতাশা তৈরি করল। মেনে নিয়েছিলাম আমরা। এটাও বলা প্রয়োজন, আমরা সরকারের সাংবিধানিক যুক্তি মেনে নিয়েছিলাম।
এখন আমাদের মনে হয়, ওই নির্বাচন নিয়ে আমাদের আরও বেশি সমালোচনা করা দরকার ছিল। সেই সময় সরকার নিজেও বলেছে, এটা একটা ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন। এটা ভালো নির্বাচন নয়। খুব শিগগিরই একটা ভাল নির্বাচন হবে। আসলে আমরা রাজনীতিবিদদের ঠিক ওইভাবে বিশ্বাস করতে পারি না। তাদের আর সময় হলো না দ্বিতীয়বারের মতো ভালো নির্বাচন আয়োজন করার। ২০১৮-এর পরিকল্পনাটা হয়ে গেল সম্পূর্ণ অন্যরকমভাবে। নাটকীয়ভাবে এ নির্বাচনটি হয়েছে। আমরা যারা প্রশাসনের বাইরে, নির্বাচন ব্যবস্থাপনার বাইরে থেকে, নাগরিক জায়গা থেকে দেখেছি— এটার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। কিছু লক্ষণতো দেখেছিই। নির্বাচন কমিশনের আচরণ দেখেছি। নির্বাচন কমিশন আমাদের মতো পর্যবেক্ষক দলকে পর্যবেক্ষণ করতে দেয়নি। এছাড়া আলামতগুলো ছিল স্পষ্ট। সহিংস ঘটনা ছিল প্রচুর। অনাস্থা ছিল আরও বেশি। এ নির্বাচনটি যে কোনও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্যে হয়নি সেটি স্পষ্ট হয়ে গেল। এর ফলে যা ঘটল সেটি অবিশ্বাস্য।
সকাল সন্ধ্যা: ২০২৪-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন দোরগোড়ায়। এ নির্বাচন সম্পর্কে কী ভাবছেন?
শারমীন মুরশিদ: ২০১৮ সালের নির্বাচন একটি কৌশলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই নির্বাচন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কৌশলে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
সকাল-সন্ধ্যা: আপনি সম্প্রতি একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলছেন, ‘এই নির্বাচনটাকে তো মানুষ গ্রহণ করতে পারছে না। এটার প্রস্তুতিটাই এমন যে সাধারণ মানুষ থেকে বড্ড বিচ্ছিন্নভাবে জিনিসটা ঘটেছে।’ মানুষ কেন নির্বাচন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবছে? কেনইবা সম্পূর্ণ ভিন্ন কৌশলে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এ নির্বাচন?
শারমীন মুরশিদ: বাংলাদেশ অনেকগুলো নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত। এখানে মূল কতগুলো রাজনৈতিক দল আছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আমাদের প্রতিনিধিত্ব করে। আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে গিয়ে আমাদের কথাগুলো বলে। আমাদের প্রতিনিধিই যদি না থাকে তাহলে আমাদের সেই কাঠামোটি আর পাচ্ছি না। এ নির্বাচনে সরকার ও সরকারি দল গণতন্ত্র এবং অংশগ্রহণকে নিজেদের মতো সংজ্ঞায়িত করে নিয়েছে। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয় যে সকল বড় রাজনৈতিক দল এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। তারা মনে করছে, কিছু দল অংশগ্রহণ করলেই এটাকে যেন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যায়।
সকাল-সন্ধ্যা: ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগসহ ১৭টি দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ২০১৮ সালে অংশগ্রহণ করেছিল ৩৯টি দল। এবার অংশ নিচ্ছে ২৭টি দল। বিএনপিসহ ২০টির মতো দল এবারের নির্বাচনে নেই। এই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না বলে কথা রয়েছে। আপনি কী মনে করেন?
শারমীন মুরশিদ: অনুষ্ঠিতব্য এ নির্বাচনকে আমরা অংশগ্রহণমূলক বলতে পারি না। এর জন্য যে নির্বাচনী পরিবেশের প্রয়োজন ছিল সেটিই তৈরি হয়নি। সাধারণত আমরা যেটি করি, নির্বাচনের আগ থেকেই পর্যবেক্ষণ করা শুরু করি। এবার আমি এক অনুষ্ঠানে বলেছি, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ আমরা কোথা থেকে শুরু করব? কারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রতিহত করা শুরু হয়েছে কয়েক বছর আগে থেকেই। এটা কিন্তু এই মুহূর্তে নির্বাচনে অংশগ্রহণে প্রতিহত করা নয়। ক্রমান্বয়েই রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রান্তিক করে দেওয়া হয়েছে। এই প্রান্তিকতাটার কারণেই আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ পাচ্ছি না। আমার প্রশ্ন, কেন মূল দলগুলো আস্থা রেখে আসতে পারছে না। এর জন্য আওয়ামী লীগ বিএনপিকে দোষ দিবে— বিএনপি আওয়ামী লীগকে দোষ দিবে— এমন পরিস্থিতিতে এ আলোচনা একদমই অপ্রাসঙ্গিক। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এ নির্বাচনে মানুষের কোনও আস্থা নেই। প্রচণ্ড ভয়ের একটা রাজত্ব আমরা তৈরি করেছি। এ ভয়ের রাজত্বে বিএনপিও কুঁকড়ে যাচ্ছে। গণমাধ্যমও অস্বচ্ছ থাকছে। সিভিল সোসাইটি টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন প্রচণ্ড একপেশে আচরণ করছে, সরকারের একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
সকাল-সন্ধ্যা: সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের কতটা ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে? যদি থাকে সেক্ষেত্রে বর্তমান নির্বাচন কমিশন তা রেখেছে কি না?
শারমীন মুরশিদ: নির্বাচন কমিশন ভূমিকা রাখতে পারবে না। এটা আমি আগেও বলেছি। এখনও বলছি। নির্বাচন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরের একটি বিষয়— রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটি বিষয়। যদি রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভেতর কোনও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ না করে, তাহলে কী করে রাষ্ট্রের ভেতর নির্বাচন কমিশন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে থাকবে? আমাদের গণতান্ত্রিক স্তম্ভগুলো টেকসই নয়। প্রথা মাফিক সাংস্কৃতিকভাবে যারাই নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বপালন করেছে— দু’একজন ছাড়া তাদের ঘাড়ের ওপর চেপে বসেছে শাসকদল। তাদের নির্দেশমতোই নির্বাচন কমিশনকে কাজ করতে হয়েছে। রকিবউদ্দীনই বলেন, নূরুল হুদাই বলেন— মেরুদণ্ডহীনভাবে তারা কমিশনকে চালিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কখনও সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ আসেনি। যেটা নূরুল হুদার কমিশনের বিরুদ্ধে এসেছে। এ কারণেই বলছি, আমাদের কাঠামো পচে গিয়েছে। তাই আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কোনওদিন দাঁড়ায়নি।
আমরা গণতন্ত্রের যে যাত্রাটা ১৯৯১ সালে শুরু করেছিলাম, এটাকে প্রতিহত করা হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের যাত্রাপথে উঠতেই পারেনি। এর কারণ হচ্ছে, প্রতিটি রাজনৈতিক দল তারা ক্ষমতায় গিয়ে কীভাবে স্বৈরাচারী শাসকের মতো টিকে থাকবে সেটির প্রতি তাদের ছিল গভীর মনোযোগ। তারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলেনি।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, যখন নব্বইয়ের দশকে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল তখন আইন মন্ত্রী ছিলেন প্রয়াত ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ। বিচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে ওঠেছিল সেই সময়ে। কতবার যে প্রবিধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তারপরও বিএনপির শাসনকালের মেয়াদই শেষ হয়ে গেল। বিচার ব্যবস্থা আর কখনোই স্বায়ত্তশাসিত হওয়ার সুযোগ পেল না।
প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল দুটি বিষয় করেছে। সেটা হচ্ছে ক্ষমতায় এসেছি— এখন ক্ষমতায় থাকব কী করে, সেই কৌশলটি খোঁজার চেষ্টা তারা করেছে। সেই কৌশলটা নিতে গিয়ে নির্বাচন কমিশনকে তারা শক্ত জায়গায় দাঁড়াতে দেয়নি। বিচার ব্যবস্থাকেও শক্ত জায়গায় দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। ভারত প্রচণ্ড দুর্নীতিগ্রস্ত একটা দেশ। সেখানে তো নির্বাচনে মানুষ মারা যায়। সহিংস ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেই দেশের মানুষ নির্বাচনগুলো মেনে নেয়। কারণ একটাই— তাদের আছে শক্তিশালী বিচার ব্যবস্থা ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। আমাদের দেশে এগুলোর কোনওটাই নেই।
সকাল সন্ধ্যা: নির্বাচন আয়োজন করা নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু তা আয়োজনের ক্ষেত্রে কমিশনকে অনেকাংশেই প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু প্রশাসনের উপর রাজনৈতিক প্রভাব থাকার বিষয়টি বরাবরই থাকে আলোচনায়। এই অবস্থায় নির্বাচনটি নিরপেক্ষভাবে আয়োজনে ইসির সাংবিধানিক ক্ষমতার প্রয়োগ আসলে কতটা সম্ভব হয়? যদি না হয় তবে কমিশনকে কার্যকর ও শক্তিশালী করার উপায় কী?
শারমীন মুরশিদ: শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রটা পরিচালনা করে। নির্বাচন কমিশন সেই বলয়ের মধ্যেই পরিচালিত হয়। তাই সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি তার মতো কাজ করতে পারে না। একটি হলো যাদেরকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তারা আজ্ঞাবহ হয় বলেই নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া মেধাবীদের এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। নিয়োগ দেওয়া তাদের, যারা ক্ষমতাসীনদের পক্ষে আছে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন এতটাই সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাবান যে, সরকার থেকেও এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা তার আছে। এ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনই বিরাজমান সরকার। এ প্রতিষ্ঠানটির বলার ক্ষমতা রয়েছে। তারা বলতে পারে, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল বিএনপির ২২ হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে রয়েছে। প্রশাসনকে আদেশ করতে পারে, যাদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ অভিযোগ রয়েছে— তাদের রেখে বাকি সবাইকে ছেড়ে দিতে। তাদের না ছাড়লে আমাদের নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন এ নির্দেশ দিতে পারে। নির্বাচনকালীন প্রশাসনকে তছনছ করে দিতে পারার সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে। রাষ্ট্র, সংবিধান, সংসদ পরিপূর্ণ আইনগত ক্ষমতা দিলেও নির্বাচন কমিশন কিছু করছে না। নির্বাচন কমিশনকে নীতিগতভাবে তার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়, না হলে তাকে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এখন যেটি হচ্ছে, একটি বিশেষ নির্দেশে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। পত্রিকায় দেখেছি, স্কুলের শিক্ষকদের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে ভোটকেন্দ্রে ভোটার নিয়ে আসার জন্য। এমন কাজ আমরা কোনওদিন হতে দেখিনি। এ কাজ তারা কার জন্য করবে? এটাতো সম্পূর্ণভাবে নির্বাচনী বিধিমালার লঙ্ঘন।
সকাল সন্ধ্যা: অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা আপনি পর্যবেক্ষক হিসেবে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শারমীন মুরশিদ: অবাধ-সুষ্ঠু শব্দ দুটি এখন আর প্রাসঙ্গিক নয়। অবাধ হওয়ার আর কোনও সম্ভাবনাই নেই। কারণ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আসলে অবাধ আর অংশগ্রহণ বিষয়টি দুই জায়গায় আছে। একটি হলো ভোটারদের অংশগ্রহণ। আরেকটি হলো প্রার্থীদের অংশগ্রহণ। সবাই সমানভাবে এ সুযোগ পাবে। যদিও সমানভাবে সবাই সে সুযোগ পায়নি। আসলে বিষয়টি বহুত্ববাদ নিশ্চিত করা।
সকাল সন্ধ্যা: নির্বাচনে প্রতিরক্ষা তথা সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে আলোচনা বারবারই আসে। আগের মতো এবারও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন নিয়েছে। ভোটের নিরাপত্তায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আনা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে দুই মতই রয়েছে। আপনি কী মনে করেন?
শারমীন মুরশিদ: আমরা দেখছি, শুধু একটি দল নির্বাচন করছে। এ দলটির সঙ্গে আছে বেশ কয়েকটি শরিক দল। তারা সবাই একে অপরের ‘আপনজন’। তারা সবাই একটি রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। তারা সবাই একত্র হয়ে নির্বাচন করছে। এ নির্বাচনে বহু দল-মতের অংশগ্রহণ নেই। বলা যেতে পারে, একটি কাঠামোর ভেতরে একটি দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এখানে তাহলে সংঘর্ষের ভয়টা কোথায়? এ অবস্থার আমি একটি চরিত্র দেখতে পাচ্ছি। স্থানীয় নির্বাচনে বিশেষ করে যখন দলীয়করণ হলো— আমাদের সংঘর্ষের ঘটনা অনেক বেড়ে গেল। এখন দেখা যাচ্ছে, নিজেদের মধ্যে দলে দলে মারামারি সংঘর্ষ করে গত কয়েকদিনে তিনজন মারা গিয়েছে। এখন নিজেরাই নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বি। বাইরের কোনও দল আর প্রতিদ্বন্দ্বি নয়। এখানে আপন স্বার্থ রক্ষা করা, ক্ষমতা আর জায়গা দখল করা।
এখন যেটা হয়েছে, এখন তারা এমনভাবে নিজেদের মধ্যে ‘যুদ্ধ’ করছে। এ পরিস্থিতিকে এখন থামাবে কে? এখন কাকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনীকে মোতায়েন করা হবে? আমি এখানে দুটি বিষয় দেখতে পাচ্ছি। সরকার অথবা নির্বাচন কমিশনের ‘ভয়’ হচ্ছে— যারা নির্বাচনকে ব্যাহত করবে, তারাই সহিংস ঘটনা ঘটাবে। তাই তাদেরকে আটকাতে হবে। তাই আমরা ধরে নিই, বৃহৎ দল বিএনপি নির্বাচন ব্যাহত করবে। তাদেরকে দমন হবে। আরেকটি হলো, যেটি আমি দেখতে পাচ্ছি, নিজেদের মধ্যে তারা মারামারি কাটাকাটি করবে। তাদেরকে আটকাতে হবে।
সকাল সন্ধ্যা: সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন দাবি করেছেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ৬০ শতাংশ মানুষের আগ্রহ নেই’। সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার মানুষের নির্বাচন বিমুখতা নিয়ে নানা সময়ে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে ভীতি ও সংশয়ের কথা আপনিও বলেছিলেন। মানুষের মধ্যে ভোট নিয়ে অনাগ্রহ থাকলে তার কারণ কি নিরাপত্তা নিয়ে সংশয়, না নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা?
শারমীন মুরশিদ: নিশ্চিতভাবে বলা যায়, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে যাবে না। প্রাণ হারানোর ভয়েও যাবে না একটি দল। অনীহার কারণেও যাবে না আরেকটি দল। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দলের ভোট দেওয়ার লোকটি নির্বাচনে নেই। তাই তারা ভোট দিতে যাবে না। কিন্তু বড় একটি অংশ নির্বাচনে ভোট দিতে যাবে। যে দলটি বর্তমান নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে তাদের তো বড় একটি ভোটার গোষ্ঠী রয়েছে।
সকাল সন্ধ্যা: বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) এক জরিপ চালিয়ে দেখেছে, আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ৭২ শতাংশ তরুণ-তরুণী ভোট দিতে ইচ্ছুক। সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ভোটারদের বাধা দিলে অবশ্যই সংকট দেখা দিবে। তার এই আশ্বাস মানুষকে ভোট কেন্দ্রমুখী করার ক্ষেত্রে প্রভাব রাখবে বলে কী মনে করেন?
শারমীন মুরশিদ: আমরা এত দুর্ভাগ্যের জায়গা আছি যে, আমরা যে কোনও রাজনৈতিক বিবৃতি বা গবেষণার দুই ধরনের অর্থ খুঁজে পাই। তাই আমরা সংশয়ের ভেতরে পড়ে যাই। যে প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা করে এ তথ্য দিয়েছে তাদের গবেষণা করার পদ্ধতি কী? নাকি তারা বিশ্বাসযোগ্য ও স্বীকৃত একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান? মানুষ আজ যে কোনও কিছু সন্দেহের চোখে দেখে। ইতিমধ্যে কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে ৪০ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে যাবে। তাহলে আমাকে সঠিক তথ্যটি জানতে অপেক্ষা করতে হবে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যা বলছেন এটা কিন্তু সত্যি কথা। একটি বিষয় আপনি দেখবেন, যে এলাকায় বিএনপির সমর্থক বেশি তারা কিন্তু আওয়ামী লীগের কোনও প্রার্থীকে ভোট দিতে যায় না। একইভাবে যে এলাকায় আওয়ামী লীগের সমর্থর্কের বেশি সেই এলাকায় ভোটাররা বিএনপির কোনও প্রার্থীকে ভোট দিতে যায় না। এ প্রবণতা বরাবরই ছিল। কিন্তু এ অবস্থা আর আজকের অবস্থা এক নয়। বরং স্পষ্টই পার্থক্য দেখা দিয়েছে।
সকাল সন্ধ্যা: সাধারণভাবে মনে করা হয়— অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, সহিংস ঘটনা না হওয়া, ভোটারদের সরব উপস্থিতি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ফলাফল মেনে নেওয়া একটি ‘ভালো’ নির্বাচনের লক্ষণ মনে করা হয়। একজন নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে আপনি কোন কোন নির্দেশককে বিবেচনায় নিয়ে থাকেন নির্বাচন পরিবেশকে সমুন্নত রাখতে?
শারমীন মুরশিদ: আপনি মূলত ‘আদর্শিক গণতন্ত্র’র কথা বলছেন। যদি এ প্রশ্নটি এবারের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ধরে হয়, তাহলে সত্যিই আমাদের এ বিষয়টি বুঝতে প্রচণ্ড বেগ পেতে হচ্ছে। কোনওভাবেই অনুষ্ঠিতব্য এ নির্বাচনকে গ্রহণ করা যাচ্ছে না। কোনওভাবেই এ নির্বাচন সুসংগঠিত নয়। অনেক মৌলিক ও নৈতিক ভিত্তির ওপর এ নির্বাচন দাঁড়িয়ে নেই। আমরা নির্বাচনী পরিবেশ নয়টি ধারার ভিত্তিতে বিবেচনা করি। এর প্রত্যেকটি ধাপের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রত্যেকটি ধাপে নানা অংশ আছে। আমরা এ বিষয়টিও বিবেচনা করি, কোন অবস্থার সৃষ্টি হলে ভোটাধিকার হরণ করা হয়। ছোট ছোট অনেক তথ্যের মধ্যে দিয়ে আমাদের কাছে নির্বাচনী পরিবেশ প্রতীয়মান হয়। আমরা নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এমন অবস্থায় উপনীত হয়েছি।
সকাল-সন্ধ্যা: রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান-সংস্থা, নির্বাচন আয়োজক ও একাডেমিয়ায় নির্বাচনের পরিবেশ বিবেচনার বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি ও সূচকের ক্ষেত্রেও পার্থক্য দেখা যায়। তাহলে কোনটি নির্বাচনের ‘আদর্শ’ পরিবেশ বিবেচনা করা যায়? নাকি এ বিষয়টি দেখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনকেই প্রাধান্য দিতে হয়?
শারমীন মুরশিদ: এ বিষয় একটি কথা বলা দরকার, বিভিন্ন পক্ষ এসব বিষয় বিবেচনা নিতে গিয়ে ভুল করতে পারে। আমি সবসময় বলি, ১৯৯১ সালের নির্বাচনটা আমাদের কাছে চমৎকার একটি মুহূর্ত হয়ে গিয়েছিল। সবগুলো রাজনৈতিক দল একমত হয়েছিল। যার ফলে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলো। এটা ছিল একটি গণতান্ত্রিক মুহূর্ত। বাংলাদেশের খুব বেশি গণতান্ত্রিক মুহূর্ত নেই। সেই সময় কোনও বিদেশি শক্তির কোনও মতামত নেই, কোনও হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়নি। এমনকি তারা আগ বাড়িয়ে মতামত দেওয়ার চেষ্টাও করেনি। কারণ আমরা সেই সময় একত্র ছিলাম— ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আমাদের মধ্যে। তাই বাইরের মতামত গৌণ হয়ে গিয়েছিল।
২০০১ সালের নির্বাচন যদি আমরা দেখি, জয়ী দল দেশ জুড়ে সংখ্যালঘু, নারী ও পরাজিত কর্মীদের ওপর আক্রমণ করল, হামলা চালাল, নারীরা ধর্ষিত হলো, মানুষ আহত হলো, মারা গেল। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলের কাছে এ নির্বাচন কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা পেল। আমরা সেই সময় বললাম, জয়ী দলের সহিংস ঘটনা নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করেছে। আমি তখন তৎকালীন তত্ত্ববধায়ক সরকারের এক উপদেষ্টাকে বললাম, ‘এমন ঘটনা ঘটছে চারদিকে, আপনারা কোনও পদক্ষেপ নিবেন না।’ জবাবে তিনি বললেন, ‘নির্বাচনে একটি দল জয়ী হয়ে যাওয়ায় আমাদের কথা প্রশাসন আর শুনছে না— তাদের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে গিয়েছে’। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার তখনও নয় দিন বাকি ছিল। সহিংস এ ঘটনা আমাদের প্রতিবেদন দেওয়ার তিন মাস পর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এ বিষয়ে কথা বলল। যদিও আজকের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা এখন এত বিভক্ত যে, স্বাভাবিকভাবেই বিদেশি শক্তি নানাভাবে কথা বলছে, সুযোগ নিয়েছে, চেপে ধরছে।
সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে ধন্যবাদ।
শারমীন মুরশিদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।