Beta
বুধবার, ৯ জুলাই, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৯ জুলাই, ২০২৫

কঠিন সময় থেকে বের হবে বাংলাদেশ : বিশ্বব্যাংক এমডি

বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন) আনা বেয়ার্দের সঙ্গে রবিবার বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন) আনা বেয়ার্দের সঙ্গে রবিবার বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

বাংলাদেশ কঠিন সময় থেকে বেরিয়ে আসবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন) আনা বেয়ার্দ।

বর্তমানের সময়টাকে সারা বিশ্বের অর্থনীতির জন্যই ‘কঠিন’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেছেন, “দুই বছর ধরে বিশ্ব অর্থনীতি একটার পর একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই দুঃসময়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। তবে আমরা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী যে বাংলাদেশ এই কঠিন সময় থেকে বেরিয়ে আসবে।”

বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসাও করেন বেয়ার্দ। বলেন, “দারিদ্র্য থেকে ব্যাপকভাবে জনসংখ্যাকে বের করে আনতে প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের রেকর্ড অত্যন্ত সফল বলে আমরা মনে করি।”

একদিনের সফরে শনিবার রাতে ঢাকায় আসেন বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন) আনা বেয়ার্দ। রবিবার রাতেই তিনি ঢাকা ছাড়েন। এর আগে সারাদিন তিনি ব্যস্ত সময় কাটান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারসহ ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, সুশীল সমাজ ও বেসরকারি খাতের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

মূল্যস্ফীতি কমানোর তাগিদ

বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক এখন মূল্যস্ফীতি, যা প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি। এটি কমানোর পথ খোঁজার তাগিদ দিয়েছেন আনা বেয়ার্দ।

তবে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, এটি রাতারাতি কমানো সম্ভব নয়।

রবিবার দুজনের বৈঠকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানোর পরামর্শও উঠে আসে। মূল্যস্ফীতি কমানোর ‘লড়াইয়ে’ বিশ্বব্যাংক সহযোগিতা করবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়।

ঢাকার শেরেবাংলা নগরের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) মন্ত্রীর দপ্তরে বৈঠক শেষে আনা বেয়ার্দ সাংবাদিকদের বলেন, “বৈঠকে আমরা বাংলাদেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছি। চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কিছু সংস্কার দরকার বলে আমরা মনে করছি।”

তিনি বলেন, “বিশেষ করে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতই বাংলাদেশকে অবশ্যই মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় মনোযোগী হতে হবে এবং মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমানো যায় সেই পথ তৈরি করতে হবে।”

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। তবে সেই লক্ষ্যের চেয়ে অনেক দূরে বাংলাদেশ।

দুই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির সমস্যায় পড়ে। ২০২৩ সালে বছরজুড়েই মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের কাছাকাছি। সেটি কমিয়ে আনার অঙ্গীকার আছে ক্ষমতাসীন দলের।

বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন) আনা বেয়ার্দের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানুয়ারির মাসের মূল্যস্ফীতির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, এই মাসে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে।

এর মানে হচ্ছে— ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, তা এই বছরের জানুয়ারিতে পেতে ১০৯ টাকা ৮৬ পয়সা ব্যয় করতে হয়েছে।

এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে বিশ্বব্যাংকও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে আশ্বাস দিয়ে বেয়ার্দ বলেন, “কোন কোন বিষয়ে সহযোগিতা দরকার হবে, তা আমাদের দুই পক্ষের মূল্যায়নেই নির্ধারণ করতে হবে।”

বাংলাদেশ কী কী করতে পারে, সে বিষয়ে এক প্রশ্নে সামাজিক নিরাপত্তা খাত সংস্কারের তাগিদ দেন বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, “যেসব মানুষ মূল্যস্ফীতিতে বেশি আক্রান্ত, তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছি আমরা।”

পরে অর্থমন্ত্রী বলেন, “উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলার সকল ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার। তার সুফলও পাওয়া যাবে।”

রাতারাতি কিছু করা সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, মূল্যস্ফীতি রাতারাতি কমবে না। রমজানের পর থেকে বিশেষ করে মে-জুন মাসের দিকে কমে আসবে বলে আমরা আশা করছি।”

বৈঠকে ছিলেন অর্থ সচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদারও। তিনি সাংবাদিকদেরকে বলেন, “আগামী রমজান মাস ও ঈদুল ফিতরের পর সাধারণ মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে কমে আসবে এবং জুনের মধ্যে তা ৭ দশমিক ৫ শতাংশে থাকবে।”

বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা

বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের সবচেয়ে কম সুদের তহবিল এআইডিএ তহবিলের সবচেয়ে বড় অংশীদার উল্লেখ করে আনা বেয়ার্দ বলেন, “এখন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চলমান প্রায় ৫০টি প্রকল্পের বিপরীতে ১৬ বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে।”

অর্থমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশ এখন যে চ্যালেঞ্জ ও সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তা নতুন নয়। বাংলাদেশ যেভাবে এই সমস্যা মোকাবিলা করছে বিশ্বব্যাংক তার প্রশংসা করেছে।”

আলোচনায় মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেলের মতো মেগা প্রকল্পের কথাও উঠে এসেছে জানিয়ে মাহমুদ আলী বলেন, “এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তারা (বিশ্বব্যাংক) শেখ হাসিনা সরকারের প্রশংসা করেছেন।”

অর্থসচিব বলেন, “বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল ও উন্নতিতে সরকারের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক খাতে সরকারের পদক্ষেপ ও কর্মসূচিকে ‘রাইট অন ট্র্যাক’ বলে অভিহিত করেছে।”

পাইপলাইনের অর্থ কার্যকরভাবে ব্যবহার প্রসঙ্গ

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী জানান, পাইপলাইনে থাকা অর্থ নিয়েও আলোচনা হয়েছে দুই পক্ষে।

গত বছর প্রধানমন্ত্রীর ওয়াশিংটন সফরের সময় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ২২৫ কোটি ডলারের অর্থায়ন চুক্তি সই হয়েছিল। এ বছর সংস্থাটির সঙ্গে ২৬০ কোটি ডলারের অর্থায়ন চুক্তিও হয়েছে।

ইআরডি সচিব বলেন, “পাইপলাইনে থাকা অর্থকে কীভাবে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায় এবং কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায় সে বিষয়েও আমরা কথা বলেছি। তারা আমাদের সর্বোচ্চ সম্ভাব্য সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।”

বৈঠকে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার এবং বাংলাদেশে সংস্থাটির আবাসিক প্রতিনিধি আব্দুলায়ে সেকও উপস্থিত ছিলেন।

খেলাপি ঋণ কমানোর তাগিদ

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে এবং আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে তাগিদ দিয়েছেন আনা বেয়ার্দ।

রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেন বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল।

বৈঠকে আর্থিক খাতের সংস্কারে নেওয়া ১৭ দফার ‘রোডম্যাপ (কর্মকৌশল)’ নিয়ে কথা হয় বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

এই সংস্কারের উদ্দেশ্য অর্জনে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা।

বৈঠকের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, আর্থিক খাতের সংস্কারে নেওয়া ‘রোডম্যাপ’ এর বিষয়গুলোকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশ্বব্যাংক এমডি।

তিনি বলেন, ‘‘সংস্কারের এজেন্ডাগুলো (পদক্ষেপ) বাস্তবায়িত হলে আর্থিক খাতে করপোরেট গর্ভন্যান্স (প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন) নিশ্চিত হবে, খেলাপি ঋণ কমিয়ে এনে ব্যাংকিং খাতে তার প্রভাব আনতে পারব আমরা; এটি তাদের জানানো হয়েছে।”

“সংস্কারের কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়িত হলে আর্থিক শৃঙ্খলা কাঙ্ক্ষিত জায়গায় আসবে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। আমাদের এ সংস্কারের পদক্ষেপকে তারা এপ্রিশিয়েট (স্বাগত জানানো) করেছেন।”

আর্থিক শৃঙ্খলা ফেরাতে বিশ্বব্যাংকের কোনও সহযোগিতা লাগলে তা তারা দিতে চেয়েছে বলেও জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র। বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংস্কারের কার্যক্রম বাস্তবায়নের কোনও পর্যায়ে সহযোগিতা লাগলে জানানো হবে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে দেশে খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। গত এক বছরেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত