গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ভারত গিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। উঠেছিলেন কলকাতার উত্তর শহরতলী বরাহনগরে পারিবারিক বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে।
১৪ মে’র পর থেকে পরিবারের সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগ ছিল না। গত ১৯ মে ঢাকায় ডিবি কার্যালয়ে সেকথা জানিয়েছিলেন তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। নিখোঁজ বাবার সন্ধানে এরপর ভারতে যান তিনি।
তার দুদিন পর ২২ মে বুধবার কলকাতার শহরের নিউ টাউন এলাকার একটি ফ্ল্যাটে আনারের লাশ পাওয়ার খবর এসেছে ভারতের সংবাদমাধ্যমে। তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
নিউ টাউনের সেই ফ্ল্যাটে রক্তের দাগ পাওয়া গেলেও সেখানে আনারের লাশ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্যের প্রতিবেশী দেশটিতে অপমৃত্যুর বিষয়টি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্নও। তার মোবাইল ফোনের নানা রাজ্যে অবস্থানও রহস্য তৈরি করেছে।
পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে প্রথমে যার বাড়িতে উঠেছিলেন আনার, সেই ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাস আনার নিখোঁজ হওয়ার কথা জানিয়ে ১৮ মে বরাহনগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি বিবিসি বাংলার সঙ্গেও কথা বলেছিলেন।
যেভাবে আনারের সঙ্গে সম্পর্ক
কলকাতার সিঁথি অঞ্চলের বাসিন্দা, ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাস জানান, আনারের সঙ্গে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তার পারিবারিক সম্পর্ক।
কলকাতার গোপাল বিশ্বাসের গহনা রপ্তানির ব্যবসা আছে। তবে তার বাড়ি ওই রাজ্যের মাছদিয়ায়।
দুই দশক আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আনার ভারতে পালিয়ে মাঝদিয়ায় থাকার সময় তার সঙ্গে পরিচয় বলে গোপাল জানান।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বাংলাদেশে বিএনপির জমানায় ও ভারতে থাকত। আমাদের বাড়ি মাঝদিয়ায়। সেখানে সুভাষ আগরওয়ালের বাড়িতে থাকত আনার। আমার সঙ্গে সেখানেই পরিচয়, তারপরে বন্ধুত্ব। সম্পর্কটা এখন পারিবারিক স্তরে চলে গেছে।”
সেই বন্ধুত্বের সূত্রেই এবার আনার চিকিৎসা করাতে এসে তার বাড়িতে উঠেছিলেন বলে গোপাল জানান। তিনি জিডিতে লিখেছেন, ১২ মে সন্ধ্যা ৭টার দিকে তার বাড়িতে ওঠেন আনার।
গোপালের বাড়ি ছাড়েন ১৩ মে
গোপাল বিবিসি বাংলাকে জানান, চিকিৎসক দেখাতে আসার পরদিন ১৩ মে তার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন আনার। তারপর তিনি আর তাকে দেখেননি।
তিনি বলেন, “এবার তিনি (আনার) এসে আমাকে বলেছিলেন যে স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাবেন। কোন ডাক্তার ভালো হবে- সেটাও জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার জানাশোনা কোনও স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ নেই, তাই আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম সল্ট লেকের অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে পারেন।
“আমরা একসঙ্গে সকালের জলখাবার খেয়েছিলাম। তারপরে এটাও তাকে বলেছিলাম যে আমার গাড়ি সেদিন নেই, উনি যেন গাড়ির বন্দোবস্ত করে নেন। এরপরে আমি বাড়ির একতলায় অফিসে চলে আসি।”
“এরপর আমি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দুপুরে বেরোনোর সময়ে আমাকে বলে যান যে তিনি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবেন। তার খোঁজ না পাওয়ার পরে আমি যখন সিসিটিভি ফুটেজ দেখি, তখন জানতে পারি যে উনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন দুপুর একটা ৪১ মিনিটে।”
বরাহনগর থানায় যে জিডি করেন গোপাল। সেখানে তিনি লিখেছেন, তার বাড়ির কাছে বিধান পার্ক এলাকা থেকে ভাড়া করা একটি গাড়িতে ওঠেন আনার। তাকে গাড়িতে উঠতে দেখেছেন শুভজিৎ মান্না নামে এক ব্যক্তি।
সন্ধ্যায় ফিরে আসার কথা থাকলেও আনার ফেরেননি বলে জানান গোপাল।
দিল্লি যাচ্ছি- হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা
সেদিন বাড়িতে না ফিরে আনার হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ পাঠিয়ে দিল্লি যাচ্ছেন বলে খবর দিয়েছিলেন বলে গোপাল জানান।
তার ভাষ্য অনুযায়ী, ১৩ মে পাঠানো সেই মেসেজে লেখা ছিল- “বিশেষ কাজে দিল্লি চলে যাচ্ছি এবং পৌঁছে ফোন করবো, তোমাদের ফোন করার দরকার নেই।”
এরপর দুদিন বাদে ১৫ মে সকালে গোপাল বিশ্বাস আরেকটি মেসেজ পান হোয়াটসঅ্যাপে আনারের কাছ থেকে। তাতে তিনি জানেন, আনার দিল্লি পৌঁছেছেন এবং তার সঙ্গে ‘ভিআইপিরা’ আছেন।
এবারও তাকে ফোন করতে আনার নিষেধ করেছিলেন বলে জানান গোপাল।
এর দুদিন পর ১৭ মে গোপাল বিশ্বাসকে বাংলাদেশ থেকে ফোন করেন আনারের মেয়ে ডরিন। তিনি জানান যে বাবার সঙ্গে তারা কোনও যোগাযোগ করতে পারছেন না।
গোপাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সে খবর জানতে পেরে কলকাতায় ওর যত ঘনিষ্ঠ মানুষ আছেন বলে আমি জানি, সবাইকে বিষয়টা জানাই। তারাও খোঁজ-খবর করতে শুরু করেন। কিন্তু কোনোভাবেই তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।”
এরপর ১৮ মে বরাহনগর থানায় যান গোপাল। তিনি বলেন, “সেখানে আমাকে সারাদিন বসিয়ে রাখা হয়। পুলিশ আমার বাড়িতে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। সেসব খতিয়ে দেখে আমার নিখোঁজ ডায়েরি নেওয়া হয়।”
পুলিশ তখন ভাড়া করা গাড়িটির নম্বরও পেয়ে যায়। তার সূত্র ধরে চালকের সন্ধান বের করে।
“ওই চালক নাকি পুলিশকে জানিয়েছে যে সংসদ সদস্যের সঙ্গে একজন বাংলাদেশি নাগরিক ছিলেন। এদের দুজনকে তিনি কলকাতা সংলগ্ন নিউ টাউন এলাকায় ছেড়ে দেন,” বলেন গোপাল।
কিন্তু সেই বাংলাদেশি নাগরিক কে, তা জানা যায়নি। আর চিকিৎসক দেখানোর জন্য বেরিয়ে কেন আনারকে দিল্লি ছুটতে হলো, সেই প্রশ্নও অমীমাংসিত এখনও।
আনারের মেয়ে ডরীন সাংবাদিকদের বলেন, তার বাবা নিয়মিতই ভারতে যান। এবার গিয়েছিলেন কানের চিকিৎসার জন্য।
মোবাইল লোকেশন বিভিন্ন স্থানে
গত ১৩ মে আনার গোপালের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর তার মোবাইল ফোনের অবস্থান গোয়েন্দারা বিভিন্ন জায়গায় পায় বলে জানিয়েছে বিবিবি বাংলা।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আনারের খোঁজ করতে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তার মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করে। তারা জানতে পারে, কলকাতায় বন্ধুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তার মোবাইলের লোকেশন একবার পাওয়া গিয়েছিল নিউ মার্কেট এলাকায়। এরপর ১৭ মে তার ফোন কিছুক্ষণের জন্য সচল ছিল বিহারের কোনও জায়গায়। এটাও জানতে পেরেছে তারা যে মোবাইল সেট থেকে সিম কার্ডটি আলাদা করে রাখার কারণে সঠিক অবস্থান খুঁজে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
ঢাকায় ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদও খোঁজ নিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “তার (আনার) দুটি বাংলাদেশি নম্বর আছে, আর একটি ভারতের নম্বর। আমরা ভারতীয় পুলিশের সহযোগিতায় তার ভারতীয় নম্বরটি দেখলাম মুজাফফরাবাদ অর্থাৎ বিহারের দিকে।”
বিবিসি বাংলা লিখেছে, বিহারে মুজাফফরাবাদ নামের জায়গা নেই। পাকিস্তান শাসিত জম্মু-কাশ্মীরের রাজধানীর নাম মুজাফফরাবাদ, আর প্রায় কাছাকাছি যে নামের জায়গা বিহারে আছে, সেই জায়গার নাম মুজফ্ফরপুর।
সংসদ সদস্য আনারের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) আব্দুর রউফ গত রবিবার স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, ১২ মে দর্শনা স্থলবন্দর দিয়ে চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার পর ১৪ মে পর্যন্ত পরিবারের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। ১৬ মে তার মোবাইল ফোন থেকে একটি মিসড কল আসে। তবে তার থেকে ফোন করে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল।
১৬ মে যখন মিসড কলটি আসে, তখন মোবাইল ফোনটির অবস্থান বাংলাদেশের বেনাপোল সীমান্তে ছিল, এমনটা গোয়েন্দাদের কাছে জানতে পেরেছেন বলে দাবি করেন রউফ।
৩ বারের এমপি আনার
আনোয়ারুল আজীম আনার ঝিনাইদহ-৪ আসনে টানা তিনবার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। ২০১৪ সালে তিনি প্রথম এমপি হন। এরপর ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পুনর্নির্বাচিত হন।
আনারের পৈত্রিক বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মধুগঞ্জ বাজার এলাকায়। ১৯৯৬ সালের দিকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর সর্বশেষ কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে ছিলেন তিনি।
দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিদের সঙ্গে আনারের সম্পর্কের অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে এসেছে। মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালানসহ নানা অভিযোগে তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলাও ছিল।
চারদলীয় জোট সরকার আমলে যৌথবাহিনীর অভিযানের সময় তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন ভারতে। তখনই তার সঙ্গে পরিচয়ের কথা গোপাল বিশ্বাসের জবানীতে পাওয়া যায়।