ভোর হতেই নিজ আসনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চান কলিমুল্লা লোন। জনগণের প্রাত্যহিক জীবনের নানা সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিধানসভায় যাওয়ার জন্য তাকে ভোট দিতে বলেন।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের ল্যানগেট আসন থেকে কলিমুল্লা এবার বিধানসভা নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
ভোটারদের কাছে উপত্যকার স্বাস্থ্য সমস্যা, বেকারত্ব বৃদ্ধি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মতো বিষয়গুলো তুলে ধরে ভোট চাইছেন তিনি। উপত্যকার একাধিক জায়গায় তার ছবি সম্বলিত পোস্টারও দেখা যায়। নির্বাচনের এই মৌসুমে তাকে বলা হচ্ছে ‘পোস্টার বয়’।
কলিমুল্লার বাবা হলেন কাশ্মিরের নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক গুলাম কাদির লোন। বাবার মতো তিনিও জামায়াতে ইসলামীর সদস্য। দলের তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে তিনি এবারের নির্বাচনে লড়ছেন।
২০১৯ সালে ভারত সরকার জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করায় দলটি এবার নির্বাচন করতে পারছে না। ফলে কৌশল হিসাবে দলটির প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটে নেমেছে। কাশ্মীরের এবারের বিধানসভা নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামকে ‘গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর’ও বলা হচ্ছে।
কাশ্মীরের বিধানসভার আসন সংখ্যা ৯০। আর এই আসনগুলোর দখল নিতে লড়াই করছে ওই অঞ্চলের প্রধান ১৩ রাজনৈতিক দল। প্রায় প্রত্যেকটি দলই জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের বিপক্ষে এবং ভোটে জিতে তারা ‘পূর্ণ অঙ্গরাজ্যের’ মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে চায়।
ব্যতিক্রম হলো জামায়াতে ইসলামী। তারা পূর্ণ অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার চেয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সামনে এনে ভোটারদের মন জয় করতে চাইছে। ভোটে জিতে তারা বিশেষ মর্যাদা বাতিলের বিষয়টি নিয়ে লড়াই করতে চাইছে।
নির্বাচনে জামায়াত নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াইকে ইতিবাচক লক্ষণ হিসেবে দেখছেন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইংয়ের (র) সাবেক প্রধান অমরজিৎ সিং দুলাত।
বিধানসভা নির্বাচনে জামায়াত সমর্থিতরা কেমন করবে, তা নির্ভর করছে কয়েকটি বিষয়ের ওপর। এরমধ্যে অন্যতম ‘ইঞ্জিনিয়ার রশিদ ফ্যাক্টর’।
কে এই ইঞ্জিনিয়ার রশিদ
আওয়ামী ইত্তেহাদ পার্টির প্রধান হলেন শেখ আবদুল রশিদ। পেশায় ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। সেই থেকে তার নামের সঙ্গে শব্দটি জুড়ে গেছে। কাশ্মিরে ভারতবিরোধী হিসেবে তার পরিচিতি আছে। সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের একটি পুরনো মামলায় তাকে বন্দি করা হয়েছিল ২০১৭ সালে। ছিলেন দিল্লির তিহার জেলে।
মজার বিষয় হলো তার সাজা শেষ না হতেই এবারের নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে জামিন পেয়েছেন তিনি। কারাগার থেকে বের হয়েই তিনি সোজা নির্বাচনী প্রচারে যোগ দেন। কীভাবে তিনি জামিন পেলেন, তা নিয়ে তুমুল বিতর্কের মধ্যেই চালান প্রচার।
রশিদের দল এবার হাতেগোনা কয়েকটি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। রাজ্যের যেসব আসনে দলটি প্রার্থী দিতে পারেনি, সেখানে জামায়াত সমর্থিতদের সমর্থন দিচ্ছে দলটি।
জামায়াতকে সমর্থন দেওয়া প্রসঙ্গে রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, “জামায়াতের সঙ্গে আমাদের বহু বিষয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের মধ্যে মিল একটাই, আমরা চাই একটি শান্তিপূর্ণ কাশ্মির।”
তবে রশিদ ও জামায়াতকে তার দলের সমর্থন নির্বাচনে কতটা ভালো ফল করবে, তা নিয়ে ভিন্নমতও আছে।
কাশ্মিরের সাবেক পুলিশ প্রধান আলি মোহাম্মদ ওয়াতালি মনে করেন, তারা ১০-১২টা আসন পেতে পারে। তবে বিধানসভায় কোনও দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে জামায়াত ও ইত্তেহাদ পার্টি নিয়ে সরকার গড়ার চেষ্টা চালাতে পারে বিজেপি।
ন্যাশনাল কনফারেন্স পার্টির ওমর আবদুল্লাহ অবশ্য মনে করেন, কাশ্মিরের নির্বাচনে ইত্তেহাদ পার্টি ও জামায়াতের এই জোটবদ্ধতা হলো নয়াদিল্লির নকশার অংশ।
সম্প্রতি এক সমাবেশে তিনি বলেন, “দিল্লির নেতারা আমাকে পছন্দ করে না। কিন্তু তারা আমাকে এত ঘৃণা করে, তা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কারাগারে থাকা প্রার্থীরা কেন শুধু আমার বিরুদ্ধেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন?”
মাসখানেক আগে কারাগারে থাকা অবস্থাতেই বারামুলা লোকসভা আসনে জেতেন ইঞ্জিনিয়ার রশিদ। সেখানে তিনি ওমর আবদুল্লাহ ও সাজ্জাদ লোনকে হারিয়েছিলেন।
কাশ্মিরের প্রভাবশালী দল পিডিপি প্রধান মেহবুবা মুফতি অভিযোগ করছেন, এই রাজ্যকে অশান্ত করতেই রশিদের পার্টিকে অর্থায়ন করেছে বিজেপি। অবশ্য রশিদ এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে নিজেকে বিজেপির ‘শিকার’ বলেছেন।
জামায়াত কেন নির্বাচনে
সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠা অবিভক্ত ভারতে হলেও পরে পাকিস্তানেই এর মূল ভিত গড়ে ওঠে। নানা বিতর্কের মধ্যে পাকিস্তানের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও রয়েছে দলটি।
দল হিসেবে জামায়াত ভারতের কাশ্মিরে শেষবার নির্বাচন করেছিল ১৯৮৭ সালে। তবে সেবার নির্বাচনে জিতেছিল ন্যাশনাল কনফারেন্স।
এরপর থেকে জামায়াত নিজেদের নির্বাচন থেকে সরিয়ে নিয়ে সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করে। রাজ্যের একাধিক জায়গায় স্কুল, কলেজ, হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে ভোট ব্যাংক তৈরির চেষ্টা করে। উত্তর কাশ্মিরের সোপোর, দক্ষিণ কাশ্মিরের পুলওয়ামা, কুলগাম ও শোপিয়ানের মতো জায়গায় ক্রমেই জামায়াত শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
বিশ্লেষক আকিব জাভেদ মনে করেন, রাজ্যের প্রতিটি এলাকাতেই জামায়াতের ‘ক্যাডার বেইজ’ আছে। তবে তারা কতটা ভোট টানতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
জামায়াতের মধ্যে বিভক্তি
বিধানসভা নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণকে ভালোভাবে নেয়নি দলটির তরুণদের অনেকে। এমনই একজন ৩৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “জামায়াতের ইয়ুথ উইংয়ের র্যালিতে আমার বন্ধুদের ও পার্টির অনেককে দেখতে পাইনি। নির্বাচন করার সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন দেয়নি আমাদের ইয়ুথ উইং। কিন্তু কেউ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলতে চাইছেন না। কারণ আওয়াজ তুললে দমন-পীড়নের শিকার হতে পারে।”
শ্রীনগরের ২৯ বছর বয়সী যুবক আসিফ। জামায়াতের হয়ে আন্দোলন করায় দুই বছর কারাগারে ছিলেন তিনি। এই নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে তিনি।
আসিফ বলেন, “প্রতিরোধ করতে, নিজেদের প্রকাশের জন্য এবং নিজেদের পরিচয় রক্ষার্থে আমাদের কৌশলের পরিবর্তন করতে হবে। এই মরিয়া সময়ে কখনও কখনও ভোট না দেওয়া কৌশলের একটি অংশ। আবার কখনও কখনও ভোট দেওয়া আমাদের অধিকার পুনরুদ্ধারের শেষ বিকল্প হয়ে ওঠে।”
প্রথম ধাপে ভোটের চিত্র
ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরে ১০ বছর পর হচ্ছে বিধানসভা নির্বাচন। বুধবার সেখানে তিন ধাপের নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোটগ্রহণ হয়। টাইমস অব ইন্ডিয়া থেকে শুরু করে দ্য হিন্দুও বলছে, প্রথম ধাপে ভোটার উপস্থিতির হার প্রায় ৫০ শতাংশ।
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর জম্মু ও কাশ্মিরে এ পর্যন্ত ১২ বার বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে। এসব নির্বাচন ছিল অধিকাংশক্ষেত্রেই সহিংস এবং ভোটার উপস্থিতিও ছিল কম। এবার কিন্তু ব্যতিক্রম।
কাশ্মিরে একটা সময় পর্যন্ত ওমর আবদুল্লাহর ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনএ) এবং মেহবুবা মুফতির পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (পিডিপি) প্রভাব ছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই প্রভাব আর আগের মতো নেই। সেখানে আওয়ামী ইত্তেহাদ পার্টির মতো দলও প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে।
জম্মুতে নির্বাচনী লড়াই হচ্ছে বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) ও কংগ্রেসের মধ্যে। সেখানে এবার কংগ্রেস ও ন্যাশনাল কনফারেন্স জোট বেঁধেছে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি, আল জাজিরা