ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীর এক অনুষ্ঠানে সশস্ত্র বাহিনী প্রস্তুত রাখা নিয়ে একটি বক্তব্য দিয়েছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং; যা নিয়ে বাংলাদেশে চলছে আলোচনা।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্যকে ‘উসকানিমূলক’ বলে প্রতিক্রিয়া এসেছে বিএনপির মধ্য থেকে। তার বক্তব্যটি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া দরকার বলে মত জানিয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূইয়া।
ছাত্র -জনতার আন্দোলনে গত মাসে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের পর ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে শীতলতা দেখছেন কূটনীতিকরা।
বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় পাওয়ার পর বিচারের জন্য তাকে ফেরত দেওয়ার দাবি রয়েছে বাংলাদেশে; দিল্লিতে থেকে শেখ হাসিনার আচরণ নিয়েও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এসেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে।
এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার লখনৌতে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং দেশটির জয়েন্ট কমান্ডার্স কনফারেন্সের দ্বিতীয় ও শেষদিনে বক্তব্য রাখেন।
সেখানে তিনি দেশটির সামরিক বাহিনীকে ‘অপ্রত্যাশিত’ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকটি ইঙ্গিত করে তিনি এই বক্তব্য দেন বলে টাইমম অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দল বিজেপির প্রভাবশালী নেতা রাজনাথ সম্মেলনে জাতীয় স্বার্থ রক্ষাসহ ‘আত্মনির্ভর ভারত’ এর রূপকল্পকে এগিয়ে নিতে দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর অবদানের প্রশংসা করেন।
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-হামাস ও বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির বিষয়টি কমান্ডারদের সামনে তুলে ধরেন তিনি।
এরপরই তিনি নিজ দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে ভবিষ্যতে যে কোনও সমস্যা ও ‘অপ্রত্যাশিত’ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন।
তিনি ভারতের উত্তর সীমান্তের পরিস্থিতি ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সাম্প্রতিক ঘটনা নজরে রেখে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বকে এসব ঘটনার আরও বিস্তৃত বিশ্লেষণের তাগিদ দেন।
রাজনাথ বলেন, “বিশ্বব্যাপী অস্থিরতার মধ্যেও ভারত শান্তিতে আছে এবং উন্নতি করছে। তবে বাড়তে থাকা চ্যালেঞ্জগুলোর কারণে আমাদের সর্বদা সতর্ক থাকা জরুরি। আমাদের শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের অগ্রগতির দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
“সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নজর ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। এজন্য আমাদের একটি শক্তিশালী ও সুসংহত জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা জরুরি। আমাদের প্রতিরোধের শক্তিতে যেন কোনও ঘাটতি না থাকে।”
তিনি ভারতের মহাকাশ ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধের সক্ষমতা বিকাশের ওপর জোর দেন। এগুলোকে তিনি আধুনিক সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার অবিচ্ছেদ্য বিষয় হিসাবে বর্ণনা করেন।
এছাড়া রাজনাথ সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বকে তথ্য ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) খাতে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ব্যবহার বাড়ানোর ব্যাপারে মনোনিবেশ করতে বলেন।
তিনি বলেন, “এসব উপকরণ সরাসরি কোনও সংঘাত বা যুদ্ধে লাগে না। তবে এদের পরোক্ষ ব্যবহার যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারণ করে।”
জয়েন্ট কমান্ডারস কনফারেন্স শুরু হয় গত ৪ সেপ্টেম্বর। এতে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব অংশ নেয়।
‘উসকানিমূলক’
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনাকে ইঙ্গিতপূর্ণ ও উস্কানিমূলক বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
শুক্রবার ঢাকার রামপুরায় ‘আমরা বিএনপি পরিবার’র পক্ষ থেকে ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী’ গণঅভ্যুত্থানে নিহত রিকশাচালক সাগরের পরিবারকে আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়। সেখানেই সাংবাদিকদের কাছে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানান রিজভী।
তিনি বলেন, “একটি বিষয় আমি অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে জানাচ্ছি, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ভারতের সেনাবাহিনীর কমান্ডারদের সাথে বৈঠকে বলেছেন যুদ্ধের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকতে। এটা তাদের দেশের ব্যাপার, তাদের দেশের নিরাপত্তার ব্যাপার।
“আমাদের উদ্বেগের বিষয় যা আমাদের আশঙ্কা তৈরি করেছে, তিনি বলেছেন- রাশিয়া, ইউক্রেন, হামাস ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে তো কোনও যুদ্ধ হচ্ছে না। এখানে শতাব্দীর সেরা গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটানো হয়েছে। এটা আমাদের নিজের বিষয়।”
“এখন বাংলাদেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিদ্যমান। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। রাজনাথ সিংয়ের রাশিয়া, ইউক্রেন, ইসরায়েল, হামাসের সাথে বাংলাদেশের নাম বলা ইঙ্গিতপূর্ণ এবং উস্কানিমূলক,” বলেন রিজভী।
বিএনপি নেতারা অভিযোগ করে আসছেন, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে গত দেড় দশকে ভারত সরকারের মদদে বাংলাদেশে টিকে ছিল আওয়ামী লীগ।
‘মূল্যায়ন করা উচিৎ’
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য ফেইসবুকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া।
তিনি শুক্রবার দেওয়া এক পোস্টে লেখেন, “ইন্ডিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং দেশটির সশস্ত্র বাহিনীকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে যেকোনও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে বলেছেন।
“আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রধানদের মূল্যায়ন করা উচিৎ, কখন বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার কাজ শেষে তারা দেশরক্ষার মূল দায়িত্ব সমর প্রস্তুতিতে নিয়োজিত হতে পারবেন। নবনিযুক্ত প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা যতদ্রুত সম্ভব সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে বহিঃশত্রুর হুমকি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন। এক্ষেত্রে ফ্রান্সের ‘লেভি এন মাস’ ধারণাটি বৈপ্লবিক জনপ্রতিরক্ষার জন্য কার্যকরী পন্থা।”
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিজয়ের ক্ষেত্রে সাবেক সেনা কর্মকর্তা হিসাবে ইকবাল করিমের ভূমিকাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়।
আন্দোলন দমনে যখন শেষ হাসিনার সরকার কঠোর অবস্থানে, তখন ৪ আগস্ট ইকবাল করিম ভূইয়ার নেতৃত্বে একদল সেনা কর্মকর্তা সংবাদ সম্মেলনে এসে দমন অভিযানের প্রতিবাদ এবং হত্যাকাণ্ডে ক্ষোভ জানান।
পরদিন আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে রাজপথেও দাঁড়ান তারা। সেদিনই শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে চলে যান। আর তার পদত্যাগের খবরটি সেদিন বিকালে প্রথম জানিয়েছিলেন বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলার মধ্যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়ই সারাদেশে সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। তখন ২৭ হাজার সৈন্য নামানো হয়েছিল।
আন্দোলনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলেও বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে এখনও কাজ করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী।