সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার করে যে রায় সর্বোচ্চ আদালত দিয়েছে, তা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করার কোনও সুযোগ নেই, এমন ব্যাখ্যা এসেছে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের কাছ থেকে।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন বলছেন, সংবিধানে দেওয়া ক্ষমতা প্রয়োগ করে এই রায় দিয়েছে আপিল বিভাগ। ফলে তা নিয়ে রিভিউর সুযোগ নেই।
আপিল বিভাগের আদেশ অনুসারে সরকার কোটার হার পুনর্বিন্যাস করে যে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে, তাও চ্যালেঞ্জ করার কোনও অবকাশ নেই বলে দাবি করছেন দুই শিক্ষার্থীর পক্ষে আদালতে শুনানিকারী আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক।
যে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের রিট আবেদনে কোটা পুনর্বহালের রায় হাইকোর্ট দিয়েছিল, তাদের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলছেন, যেহেতু কোটার হার পুনর্বিন্যাসের ক্ষমতা সরকারের রয়েছে, যেহেতু রিভিউর প্রয়োজনই নেই।
সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের রায়ের পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে ব্যাপক সংঘাত-সহিংসতায় দেড় শতাধিক প্রাণহানির প্রেক্ষাপটে আপিল বিভাগ রায় দেয়।
সেনা মোতায়েন ও কারফিউর মধ্যে গত রবিবার দেওয়া রায়ে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে দেয়। সেই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, অনগ্রসর নৃগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করতে সরকারকে নির্দেশ দেয়।
সেই নির্দেশনা অনুসরণ করে মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কোটার অনুপাত পুনর্নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। আইনমন্ত্রী জানান, এখন থেকে সরকারি চাকরিতে সব নিয়োগে ৯৩ শতাংশ পদ মেধার ভিত্তিতে হবে, বাকি ৭ শতাংশ হবে তিন ধরনের কোটায়।
নারী ও জেলা কোটা বাদ পড়া নিয়ে এরই মধ্যে সংক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এসেছে। মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও অনগ্রসর নৃগোষ্ঠীর কোটার হার কমে যাওয়া নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশিত হয়েছে।
আপিল বিভাগের এই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করার ভাবনার কথাও কারও কারও মধ্যে এসেছে। এই রায় রিভিওর সুযোগ আছে কি না- জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ প্রয়োগের বিরুদ্ধে রিভিউ করা যায় না।”
সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদে রিভিউ নিয়ে বলা আছে, “সংসদের যে কোনও আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে এবং আপিল বিভাগ কর্তৃক প্রণীত যে কোনও বিধি-সাপেক্ষে আপিল বিভাগের কোনও ঘোষিত রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের থাকিবে।”
তার আগের অর্থাৎ ১০৪ অনুচ্ছেদে আপিল বিভাগের ক্ষমতা সম্পর্কে বলা আছে, “কোনও ব্যক্তির হাজিরা কিংবা কোনও দলিলপত্র উদ্ঘাটন বা দাখিল করিবার আদেশসহ আপিল বিভাগের নিকট বিচারাধীন যে কোনও মামলা বা বিষয়ে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের জন্য যেরূপ প্রয়োজনীয় হইতে পারে, উক্ত বিভাগ সেইরূপ নির্দেশ, আদেশ, ডিক্রি বা রিট জারি করিতে পারিবেন।”
আপিল বিভাগ এখানে তার সাংবিধানিক ক্ষমতার প্রয়োগ করেছে বলে আইনজীবীদের ভাষ্য।
অ্যাটর্নি জেনারেল এই প্রসঙ্গে আরও বলেন, যেহেতু কোটার হার পরিবর্তনের এখতিয়ার সর্বোচ্চ আদালত সরকারকে দিয়েছে, সেহেতু রিভিউর প্রয়োজনও পড়ছে না।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, বলেন, “আদালত তো বলে দিয়েছেন, যদি প্রয়োজন হয়, আর সরকার মনে করে তাহলে পরিবর্তন করতে পারবে।
“দেখা গেল দুই বছর, পাঁচ বছর কেটে গেছে, নারীরা আসছে না; তখন সরকার চাইলে এটা পরিবর্তন করতে পারবে। প্রয়োজন পড়লে সরকার পরিবর্তন করতে পারবে। অবস্থা বিবেচনা করে তার প্রেক্ষিতে সরকার পরিবর্তন করতে পারবে। এমনও হতে পারে দেখা গেল কোটারই প্রয়োজন নাই, তখন কোটা তুলে দেবে।”
স্বাধীনতার পর থেকে কোটা ব্যবস্থা ছিল। ২০১৮ সালের আগে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ পদ নানা কোটার জন্য সংরক্ষিত ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, ৫ শতাংশ উপজাতি কোটা এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা।
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র দিয়েছিল সরকার। হাইকোর্টের রায়ে সেই সব কোটা পুনর্বহালের পর তা স্থগিত করতে সরকারের পাশাপাশি দুই শিক্ষার্থীও আবেদন করেছিল আপিল বিভাগে।
তাদের আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক শাহ মঞ্জুরুল হক ২০১৮ সালের পরিপত্র এবং এবারের প্রজ্ঞাপনের পার্থক্য তুলে ধরে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, আগের পরিপত্র নির্বাহী বিভাগ নিজের সিদ্ধান্তে করেছিল, কিন্তু এবারের প্রজ্ঞাপন হয়েছে আদালতের আদেশ বলে।
“এই প্রজ্ঞাপনকে আর চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ নাই। সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হয়েছে, সুতরাং এটা চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ নাই। এটার উপর আর হাত দেওয়ার সুযোগ নাই।”
সরকারকে কোটার অনুপাত ঠিক করার ক্ষমতা দেওয়া হলেও তা প্রয়োগের সুযোগ এই মুহূর্তে নেই বলেও মনে করেন এই আইনজীবী।
এই রায় রিভিউর সুযোগ আছে কি না- এ প্রশ্নে মঞ্জুরুল বলেন, “রিভিউ করতে পারলেও তা অ্যালাও হবে না। তার কারণ যেখান সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করা হয়েছে, এর বিরুদ্ধে রিভিউ হয় না। রিভিউ হয় সেখানে, যেখানে বেআইনি কিছু হওয়ার সুযোগ থাকে। এখানে সেটা নাই। কারণ এটা সর্বোচ্চ আদালতের ডিসক্রেশনারি পাওয়ার।”
সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “আপিল বিভাগের স্বাভাবিক ক্ষমতা সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদে দেওয়া আছে। এর বাইরে ১০৪ অনুচ্ছেদে বলা আছে, আদালতের নিকট যদি কোনও মামলা কিংবা কোনও বিষয় বিচারাধীন থাকে, তাহলে আদালত তার নিজস্ব ক্ষমতা বলে পূর্ণাঙ্গ ন্যায়বিচার করার জন্য যে কোনও রকম নির্দেশনা, আদেশ, ডিক্রি অথবা রুল জারি করতে পারেন। এই অনুচ্ছেদের ক্ষমতা বলেই সর্বোচ্চ আদালত রায়টি দিয়েছেন।”
“এই ক্ষেত্রে সব পক্ষ যদি একমত হয়, তাহলে রিভিউ করতে পারে। তাছাড়া সুযোগ নাই,” বলেন শাহ মঞ্জুরুল।
মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার বিষয়ে রিভিউ করার বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা এরই মধ্যে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
মুক্তিযোদ্ধা কোটার জন্য আদালতে যাওয়া সাতজনের পক্ষে থাকা আইনজীবী মনসুরুল হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রিভিউর তো প্রশ্নই উঠে না। আদালত তো বলেই দিয়েছেন, সরকার এটা পরিবর্তন, পরিবর্ধন করতে পারবে। সেখানে রিভিউয়ের আর দরকার কি?”
সরকার একবার গেজেট প্রকাশের পর ফের পরিবর্তন-পরিবর্ধন করতে পারবে কি- জানতে চাইলে সাবেক এই বিচারপতি বলেন, “সরকার চাইলে প্রতিদিনই করতে পারবে। এখানে আইনের কোনও বাধ্যবাধকতা নাই।”