পর্দা নামতে যাচ্ছে কান চলচ্চিত্র উৎসবের। শনিবার সমাপনী অনুষ্ঠানটি শুরু হবে বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টায়।
আর এ অনুষ্ঠানেই জানা যাবে, কোন সিনেমাটি পেতে যাচ্ছে সেরার পুরস্কার, যেটি পাম ডি’অর বা স্বর্ণ পাম পুরস্কার নামে চলচ্চিত্রপ্রেমী ও বোদ্ধাদের কাছে পরিচিত।
লড়াইয়ে থাকা ২২ ছবির বেশ কয়েকটিকে ঘিরে আলোচনা। শেষ সময়ে প্রদর্শিত ইরানি নির্মাতা মোহাম্মদ রাসুলফের ‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’ নিয়ে আছে জোর আলোচনা। তার আগে সবার মুখে মুখে ছিল ফরাসি নির্মাতা জ্যাক ওদিয়ার ‘এমিলিয়া পেরেজ’ সিনেমাটি।
‘সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’ সিনেমাটির প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে ইরানের সাম্প্রতিককালের হিজাব বিরোধী আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে। এই সিনেমায় দেখানো হয়, মূল চরিত্র আইনজীবী ইমান তরুণদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও প্রথাবিরোধী আন্দোলনের মৌন সমর্থক। তার ইচ্ছা ছিল বিচারক হওয়ার। কিন্তু তাকে দায়িত্ব দেওয়া তদন্তকারী আইনজীবী হিসেবে। প্রচ্ছন্নভাবে সরকার থেকে চাপও দেয়া হয় গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে প্রমাণ না থাকলেও দোষী সাব্যস্ত করার ব্যাপারে। এর মধ্যে আবার ইমানের লাইসেন্সকৃত বন্দুকটি হারিয়ে যায়। একধরনের মানসিক সংকট বা প্যারানয়ার মধ্যে পড়ে সে। সন্দেহ করতে থাকে নিজের স্ত্রী ও তরুণী মেয়েকে।
‘এমিলিয়া পেরেজ’ সিনেমায় উঠে এসেছে একজন ছোটখাটো নারী আইনজীবী সালডানার কাহিনী। সে যে সংস্থায় কাজ করে সেটি অপরাধীদের বিচারের বদলে তাদের মুক্তি পাওয়ার প্রতি বেশি জোর দেয়। তবে একদিন সালডানার জীবন পরিবর্তন হয়ে যায়, যখন একজন ড্রাগ ব্যবসায়ী নিজের লিঙ্গ পরিবর্তন করে নারী হওয়ার ব্যাপারে তার আইনি সহায়তা চায়।
গেল বছরের মতো ফরাসি কোন ছবি, না কি আবারো এশিয়ার কোনটি পাবে সেরার মুকুট- তাই নিয়ে কানে চলছে জোর আলোচনা। আবার খেয়াল রাখতে হচ্ছে, বিচারক প্যানেলের দিকেও। নয় বিচারকের পাঁচজনই যে নারী! সেরা হওয়ার প্রতিযোগিতায় থাকা ২২ ছবির মধ্যে চারটির নির্মাতা রয়েছেন নারী।
লড়াইয়ে আছে আমেরিকান কমেডি সিনেমা ‘আনোরা’, যাতে একজন যৌনকর্মীর জীবনের সঙ্গে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সংস্কৃতি । তালিকায় আছে, ফরাসি আরেক ছবি ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’। কোরালি ফারজা পরিচালিত এ সিনেমায় ডেমি মুর বয়সের কারণে গ্লামার হারাতে বসা এক অভিনেত্রীর চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। এক পর্যায়ে বয়স কমাতে তিনি চোরাবাজার থেকে একটি ওষুধ কিনে ব্যবহার করতে শুরু করেন। এটি একটি হরর ফিল্ম!
তবে পুরস্কারের ব্যাপারে অনুমান ছাপিয়ে যাবার ঐতিহ্য আছে কান চলচ্চিত্র উৎসবের।
উৎসবে যোগ দেয়া চলচ্চিত্র বিশ্লেষক, বোদ্ধা ও সমালোচকরা বলছেন, গেল বারের থেকে ছবির মান কমেছে। যদিও পরিচালকের তালিকায় রয়েছে বড় বড় সব নাম। কিন্তু তা মেটাতে পারেনি প্রত্যাশা। উৎসব পরিচালক থিঁয়েরি ফ্রেমো-র এবারের ছবি সিলেকশন নিয়ে অসন্তুষ্টি অনেকেরই।
চীনা ‘জে মুভি’ থেকে উৎসবে আসা সাংবাদিক রানচেং জিঙের পছন্দের তালিকায় শুরুতে আছে শন বেকারে’র ‘আনোরা’।
তার মতে, “ছবিটির গল্প অসাধারণ। অভিনেত্রীর পারফরম্যান্স ছিল দারুণ। যেভাবে গল্পটা বলা হয়েছে, তা এবছর কানে অন্য কোন ছবিতে দেখিনি। আরেকটি ছবি ফরাসি নির্মাতা কোরালি ফারজা’র ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’। ভৌতিক ছবিটি ভালো লেগেছে। ভারতীয় ছবি ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ও ভালো ছবি। এমন জনরা’র ভারতীয় ছবি আগে দেখা হয় নি। পরিচালক দারুণ মেধাবী। সাধারণ গল্পকে তিনি দারুণ নির্মাণ করেছেন।”
পায়েল কাপাডিয়া পরিচালিত এ সিনেমায় মূলত তিনজন নার্সের জীবন নিয়ে গল্প এগিয়েছে। এর মধ্যে একজন দীর্ঘদিন পর জার্মানি থেকে তার স্বামীর পাঠানো একটি ‘রাইস কুকার’ সারপ্রাইজ গিফট হিসেবে পান। স্বামীর সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল ক্ষীণ। তারই রুমমেট আরেক নার্স নিজে হিন্দু এবং মুসলিম প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হওয়া এবং প্রেমকে পরিণতি দেওয়া সংক্রান্ত সংকটে ভোগেন।
পায়েল কাপাডিয়ার জন্য তো বটেই, ভারতীয় সিনেমার জন্যও কানের প্রতিযোগিতা বিভাগে ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ সুযোগ পাওয়াটা একটি বড় ধরনের অর্জন। কেননা, প্রায় ৩০ বছর পর কোনও ভারতীয় সিনেমা কানের প্রতিযোগিতা বিভাগে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
কান উৎসবে আসা বুলগেরিয়ান সাংবাদিক নেভা মিশেভা-র তালিকায় প্রথমেই আছে জ্যাক ওদিয়ার ‘এমিলিয়া পেরেজ’ সিনেমাটি। রক অপেরার গল্পে মিউজিক্যাল মুভিটা তার মন জিতে নিয়েছে। তার ভাষায়, ‘ইট ইজ বিউটিফুল, বোম্বাস্টিক মুভি’।
নেভার পছন্দে এরপরই আছে ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’। ডেমি মুরের অভিনয়ের দারুণ প্রশংসা করে নেভা বলছেন, “প্লটটা দারুণ। কিছুটা নারীবাদী। ডেমি মুরের অভিনয়ে দারুণ আলোড়িত আমি”।
“এই ফেস্টিভালটায় ছবি বাছাই দারুণ বৈচিত্রময়। ভারতীয় ছবি ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইটে’র কথাই ধরুন। আমি ছবিটা দারুণ উপভোগ করেছি।”
প্রতিযোগিতায় আছে নির্বাসিত রাশান নির্মাতা কিরিল সেরব্রেনিকভের ‘লিমোনোভ: দ্য ব্যালাড’। এই সিনেমাটি রুশ কবি, রাজনীতিবিদ, লেখক ও সংস্কারক এডওয়ার্ড লিমোনোভের জীবনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা। লিমোনোভ রাশিয়া থেকে ১৯৭৪ সালে নির্বাসিত হয়েছিলেন। পরে আবার ১৯৯১ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাশিয়ায় ফিরে এসে রাজনীতি শুরু করেন।
চীনা নির্মাতা জিয়া জানকি পরিচালিত ‘কট বাই দ্য টাইডস’-ও আছে আলোচনায়। একজন চীনা নারীর প্রেমের আখ্যানের কাহিনী নিয়ে তৈরি হয়েছে এ সিনেমার প্লট।
এই ছবি দুটিকে স্বর্ণপামের দৌড়ে এগিয়ে রাখছেন সার্বিয়ান সাংবাদিক দুবরাকভা লাকিচ। তার ভাষায় ‘লিমোনোভ’ শক্তিশালী ছবি। একই সঙ্গে ইস্যুটা বিতর্কিত। সেই সঙ্গে দুবরাকভা’র পছন্দের তালিকায় আছে চীনা নির্মাতা জা জেনকি পরিচালিত সিনেমা ‘কট বই দ্য টাইডস’ । তার মতে, “ইমোশনাল ম্যুভিটি একই সঙ্গে ঐতিহাসিক ভ্রমণ”।
ভারতীয় সিনেমা ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ প্রসঙ্গে দুবরাকভা বলছেন, “ভিজ্যুয়ালি ছবিটি দারুণ। কিন্তু গল্প আমাকে মুগ্ধ করতে পারেনি।”
তবে কানের যে ‘অনুমনেয়’ চরিত্র, তা মেনে এর বাইরে কোন ছবি স্বর্ণপাম জিতে নিলে অবাক হবার কিছু থাকবে না।