বাস্কেটবল কোচ সবুজ মিয়ার মন ভীষণ খারাপ। প্রতিদিন কোনও না কোনও খেলোয়াড় ফোন করে তাকে জিজ্ঞাসা করেন, “স্যার কবে আবার খেলা শুরু করবো?” ফোনের অন্য প্রান্তে নিশ্চুপ থাকেন সবুজ মিয়া। কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারেন না। সবুজ মিয়ার নিজেরও যেন জানা নেই দেশের স্থবির ক্রীড়াঙ্গনে কবে ফিরবে প্রাণচাঞ্চল্য!
সেই কোলাহলমুখর ক্রীড়াঙ্গন দেখতে হয়তো আরও কিছুদিন সময় লাগবে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দেশে শেষ ক্রীড়া আয়োজন ছিল সিটি ব্যাংক প্রফেশনাল গলফ টুর্নামেন্ট। যশোরে অনুষ্ঠিত ওই টুর্নামেন্ট শেষ হয় গত ১৯ জুলাই। সেই থেকে দেশে কোনও ধরনের খেলা ছিল না টানা ৭৩ দিন! আন্দোলনের ভাষায় বললে ক্রীড়াঙ্গনে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ছিল প্রায় আড়াই মাস।
আশার কথা, অস্থির সময়কে পেছনে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ স্কোয়াশ র্যাকেটস ফেডারেশন। আজ ১ অক্টোবর ঢাকায় শুরু হয়েছে চতুর্থ বাংলাদেশ ওপেন স্কোয়াশ।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পেরিয়ে গেছে ৫৬ দিন। ৮ আগস্ট ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন নতুন অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। নতুন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এখনও মাঠে ঘরোয়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের ব্যবস্থা করতে পারেননি। খেলাধুলা মাঠমুখী করার অভিভাবক সংস্থা ফেডারেশনগুলোতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মাঠে খেলা নেই। স্থবির হয়ে আছে ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর কার্যালয়।
অনুশীলনের অভাবে দিন দিন খেলোয়াড়দের ফিটনেস কমতে শুরু করেছে। কোনও প্রতিযোগিতা না থাকায় হতাশায় দিন কাটছে খেলোয়াড়দের। অনেকে খেলা ছেড়ে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আঁচ সব সময় লেগেছে ক্রীড়াঙ্গনে। গত কিন্তু ২০০১ সাল থেকে ধরলে গত ২৪ বছরে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এমন স্থবিরতা দেখাই যায়নি। এমনকি ‘ওয়ান-ইলেভেনের’ পরও এত লম্বা সময় খেলাবিহীন ছিল না দেশের ক্রীড়াঙ্গন।
অথচ দেশের করোনা সংক্রমণের উর্ধ্বগতির মধ্যেও ২০২১ সালের এপ্রিলে আয়োজন করা হয় বঙ্গবন্ধু নবম বাংলাদেশ গেমস। তখন জৈব সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে হয়েছিল খেলাধুলা।
দেশে জনপ্রিয় ও অপ্রচলিত খেলা মিলিয়ে ৫৫টি ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। প্রতিটি ফেডারেশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খেলাধুলাহীন অলস সময় কাটছে অ্যাথলেট ও কর্মকর্তাদের।
শুটিংয়ে প্রতিযোগিতাহীন ১৫৪ দিন
এমনিতেই শুটিংয়ে ঘরোয়া প্রতিযোগিতা আয়োজন হয় কম। শুটিংয়ে সর্বশেষ প্রতিযোগিতা হয়েছে এ বছর ২৯ এপ্রিল। ষষ্ঠ হামিদুর রহমান জাতীয় যুব শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে সেবার চ্যাম্পিয়ন হয় বিকেএসপি।
ঘরোয়ার চেয়ে আন্তর্জাতিকে নজর আর্চারির
সারা বছর কোনও না কোনও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকতে হয় দেশের আর্চারদের। চলতি সপ্তাহেও চীনা তাইপেতে চলছে এশিয়ান যুব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপ। যে প্রতিযোগিতায় রিকার্ভ অনূর্ধ্ব-২১ বিভাগে রুপা জিতেছেন বাংলাদেশের আবদুর রহমান আলিফ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যস্ত হলেও ঘরোয়া আসর আয়োজন করতে পারছে না ফেডারেশন। সর্বশেষ টঙ্গীর আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে এ বছরের ১০ জুন অনুষ্ঠিত হয়েছিল আর্চারি বাংলাদেশ লিগ রাউন্ড-২।
অক্টোবরের সামার অ্যাথলেটিকস নিয়ে শঙ্কা
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনে সাধারণ সম্পাদক আবদুর রকিব মন্টু পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে অন্য সব ফেডারেশনের মতোই স্থবিরতা জেকে বসেছে অ্যাথলেটিকসে। সর্বশেষ এ বছর ২৬ মে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে রকিব মন্টুর কমিটি আয়োজন করে শেখ কামাল ৩৮তম জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতা। সব ঠিক থাকলে অক্টোবরে শুরু হতো সামার অ্যাথলেটিকস। কিন্তু সেটা আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। ফেডারেশনের অফিসিয়াল আবু তালহা বলছিলেন, “আমরা সাধারণত কোনও ন্যাশনাল প্রতিযোগিতার জন্য চূড়ান্ত চিঠি প্রতিযোগিতা শুরুর ৩ মাস আগে ছাড়ি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। তাছাড়া নতুন কমিটি না এলে কিভাবে খেলার আয়োজন হবে, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না।”
যাযাবর বাস্কেটবল
ধানমন্ডিতে বাস্কেটবল জিমনেসিয়াম ভেঙে সেখানে নির্মাণ করা হচ্ছিল শেখ কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্স। এরপর থেকেই ভেন্যু সঙ্কটে ভুগছে বাস্কেটবল। তারপরও যাযাবরের মতো এখানে সেখানে ঘরোয়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে বাস্কেটবল ফেডারেশন। সর্বশেষ গত জুন মাসে যশোরে হয়েছে চ্যালেঞ্জ কাপ বাস্কেটবল। এরপর ২৪ জুলাই-১৩ আগস্ট মিরপুর শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে বরাদ্দ নেয় বাস্কেটবল ফেডারেশন। সেখানে হওয়ার কথা ছিল অনূর্ধ্ব-১৬ থ্রি অন থ্রি বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেখানে প্রতিযোগিতা আয়োজনের কোনও সুযোগ নেই। মিরপুর ইনডোরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ক্যাম্প করেছে।
ব্যাডমিন্টনে খেলা নেই ২ বছরের বেশি
দেশের সবচেয়ে স্থবির ফেডারেশন ব্যাডমিন্টন। যেখানে ঘরোয়া প্রতিযোগিতার আয়োজন অনিয়মিত। সর্বশেষ ঘরোয়া প্রতিযোগিতা হয়েছিল ২০২২ সালের ২৮ জুলাই, ৩৭তম জাতীয় ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপ।
অন্যান্য ডিসিপ্লিনেও তথৈবচ
হ্যান্ডবলে আন্তর্জাতিক সাফল্য নেই। কিন্তু ঘরোয়া প্রতিযোগিতা নিয়মিতই আয়োজন করে হ্যান্ডবল ফেডারেশন। সর্বশেষ ৭ জুন পল্টন হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে শেষ হয়েছে জাতীয় নারী হ্যান্ডবল চ্যাম্পিয়নশিপ।
টেবিল টেনিসের সর্বশেষ খেলা হয়েছে চলতি বছর ৩০ জানুয়ারি, প্রাইজমানি র্যাঙ্কিং টুর্নামেন্ট। সাঁতার ফেডারেশন এ বছর ২৫-২৮ মে আয়োজন করে জাতীয় বয়সভিত্তিক সাঁতার প্রতিযোগিতা।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ জিমনেসিয়ামে জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন সর্বশেষ যে প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল সেটা প্রথম বঙ্গবন্ধু আন্তঃস্কুল জিমন্যাস্টিকস। এটা হয়েছিল এ বছর ৩ মার্চ। হকিতেও অনিয়মতি খেলা। এবারের প্রিমিয়ার হকি লিগ ছিল ফেডারেশনের সর্বশেষ কোনও ঘরোয়া আয়োজন। যে লিগ শেষ হয়েছে চলতি বছর এপ্রিলে।
কাবাডিতে নিয়মিতই খেলা মাঠে থাকতো। সর্বশেষ জুলাই মাসে সার্ভিসেস কাবাডির আয়োজন করে ফেডারেশন।
দেশের ফেন্সাররা পড়েছে সবচেয়ে অসহায় অবস্থায়। মিরপুর ইনডোরে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প হওয়ায় তারা অনুশীলন করতে পারছেন না। ফেন্সিং ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউর রহমান সিনহা আক্ষেপের সুরে বলছিলেন, “ছেলে মেয়েরা এখন রাস্তায়, ফুটপাতে প্র্যাকটিস করছে। কারণ আর্মি ক্যাম্প বসেছে মিরপুরে। সরকার নতুন সভাপতি না দিলে আমরা কোনও খেলায় আয়োজন করতে পারছি না।” সর্বশেষ চলতি বছর ৯ জুন শেষ হয়েছে ৬ষ্ঠ জাতীয় ফেন্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দক্ষিণ এশিয়ান কুস্তি বাতিল হয়েছে এরই মধ্য। সর্বশেষ সার্ভিসেস কুস্তি অনুষ্ঠিত হয় এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে।
মার্শাল আর্ট খেলা কারাতের সর্বশেষ খেলা হয়েছে ২০২৩ সালের ২০ মে, ২৮তম জাতীয় কারাতে চ্যাম্পিয়নশি।
ভলিবল স্টেডিয়ামেও বসেছে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। খেলোয়াড়েরা অনুশীলন ও ক্যাম্প করতে পারছে না। সর্বশেষ চলতি বছর মে মাসে ফেডারেশন আয়োজন করে স্বাধীনতা দিবস ভলিবল।
ভারোত্তোলন ফেডারেশন নিয়মিত প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। গত জুন মাসে তারা আয়োজন করে পঞ্চম জাতীয় জুনিয়র ক্লাব ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপ। পল্টনে গত ১২ জুলাই স্যান্ড রাগবির আয়োজন করে রাগবি ফেডারেশন। বেসবল এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে আয়োজন করে নারী জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ। জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছে ১০ জুলাই। ১ জুন উশুতে হয়েছে তাইচি প্রতিযোগিতা।
রোলার স্কেটিং ফেডারেশনও সেনাবাহিনীর দখলে। তারাও সর্বশেষ স্বাধীনতা দিবস আয়োজন করে মার্চ মাসে।
বডি বিল্ডিং ফেডারেশন ২০২২ সালে ডিসেম্বরে জাতীয় শরীরগঠন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এরপর আদম তমিজি হককে সভাপতি করে গত বছর জুনে অ্যাডহক কমিটি করে সরকার। কিন্তু আদম তমিজি হক পরবর্তীতে গ্রেফতার হলে এই ফেডারেশনে নেমে আসে স্থবিরতা।
গত বছর ২৬ জুলাই যশোরে হয় জাতীয় খো খো পুরুষ ও মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ। ওটাই ছিল খো খোর সর্বশেষ ঘরোয়া আয়োজন। সার্ফিয়ের সর্বশেষ প্রতিযোগিতা হয়েছিল ২০২১ সালে নভেম্বরে কক্সবাজারে, বঙ্গবন্ধু জাতীয় সার্ফিং। টেনিস ফেডারেশন মার্চে আয়োজন করে স্বাধীনতা দিবসের টুর্নামেন্ট। বক্সিংয়ে সর্বশেষ ২০২৩ সালের মার্চ মাসে শেখ কামাল জাতীয় যুব গেমসের বক্সিং ইভেন্ট হয়। এরপর নিজেদের উদ্যোগে বক্সিং ফেডারেশন কোনও প্রতিযোগিতা করেনি। সাইক্লিং ফেডারেশন বঙ্গবন্ধু ৪৩তম জাতীয় সাইক্লিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করে নড়াইলে এ বছর ৮-১০ মার্চ। ক্যারমের সর্বশেষ আয়োজন হয়েছিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বর র্যাঙ্কিং টুর্নামেন্ট।
শেষ কথা
বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ মোহাম্মদ হায়দারের আক্ষেপ, “খেলা ছাড়া থাকাটা অস্বস্তিকর। আশা করি, শীঘ্রই এই অচলাবস্থা কেটে যাবে।”
খেলোয়াড়দেরও দীশাহীন অবস্থা। রাজনৈতিক অস্থিরতায় খেলার মাঠে যাওয়াটা যেন ভুলতেই বসেছেন। সঙ্কট কাটিয়ে উঠে দ্রুত মাঠে ফিরতে চান খেলোয়াড়রা। তাদের সবার হয়ে যেন সেই কথাই বললেন বক্সার মোহাম্মদ আল আমিন, “আমরা এভাবে আর কত দিন বসে থাকব বুঝতে পারছি না। প্র্যাকটিস না করতে করতে ফিটনেস হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের। ফেডারেশন থেকেও কোনও সবুজ সঙ্কেত মিলছে না। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে খেলায় ফিরতে চাই আমরা।”