সোশাল মিডিয়াতে একেক দিন একেক হিড়িক ওঠে; যেমন এখন গাভীর শালদুধ আর এই দুধে তৈরি সাপ্লিমেন্ট খেতে পেলে যেন বর্তে যাচ্ছে সবাই ।
বিষয়টি নজরে আসায় এ নিয়ে ইনডিয়া টুডের প্রতিবেদন জানার চেষ্টা করেছে, মানুষের খাদ্যাভ্যাসে গাভীর শালদুধ আসলে কতটুকু উপকারী?
ভালো স্বাস্থ্য ও নিজেকে ভালো দেখাতে সাপ্লিমেন্ট বা পুষ্টি পূরণের বিকল্প খাবারে ঝোঁক রয়েছে সবারই।
চুল ঝরে যাচ্ছে? তাহলে খাদ্যাভ্যাসে বায়োটিন সাপ্লিমেন্ট যোগ করে নিন।
শারীরিক যে কোনো ঘাটতির জন্যই বাজারে কোনো না কোনো সাপ্লিমেন্ট রয়েছে; এসব পণ্য সব মুশকিল আসানের ওয়াদাও দিচ্ছে।
ঠিক এখন যেমন সাড়া ফেলেছে গাভীর শালদুধের সাপ্লিমেন্ট। গাভীর শালদুধ এবং এর থেকে বানানো গুড়াদুধ ও পিল কেনার জন্য লোকজন যেন হিতাহিত জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেছে। এই পণ্যকে বাজারে ডাকা হচ্ছে ‘তরল সোনা’।
গাভীর শালদুধ কী?
“প্রসবের পর গাভীর প্রথম দুধ হলো শালদুধ।”
ইনডিয়া টুডের কাছে এ কথা জানালেন ভারতের মুম্বাইয়ের জেনারেল পেডিয়াট্রিশিয়ান অমরিন্দার ওবেরয়।
“এই দুধ পুষ্টি, অ্যান্টিবডি ও শিশুর বেড়ে ওঠার উপাদানে ভরপুর। এই পুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সদ্য জন্ম নেওয়া বাছুরের শরীরের জন্য অতি জরুরি।”
আর এ কারণে গাভীর শালদুধকে ‘মহৌষধ’ বলে।
শালদুধের ধরন নিয়ে আরও বিষদে বোঝালেন মুম্বাই শহরের আরেক চিকিৎসক এবং নিবিড় পরিচর্যা বিশেষজ্ঞ রুহি পীরজাদা।
তিনি বলেন, “মানব শিশু বা যে কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণী জন্ম নেয়ার পর, মায়ের স্তন হতে প্রথম যে তরল দুধ বেড়িয়ে আসে তাই শালদুধ।
“স্তন্যপায়ী প্রাণীরা প্রসবের ৪৮ থেকে ৭১ ঘণ্টার মধ্যে শালদুধ দেয়।”
এই শালদুধে উচ্চমাত্রায় আমিষ এবং কম মাত্রায় চর্বি থাক; যা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে দেয়।
“মানুষের বেলায় কখনও কখনও অল্প সময়ের জন্য এই শালদুধ মেলে। যে কারণে গরুর শালদুধ থেকে ওই উপকারিতা পূরণ করে নেওয়া যায়”, বললেন পীরজাদা।
গাভীর শালদুধে রয়েছে ইমিউনোগ্লোবুলিনস, অ্যান্টিবডি, ফ্যাটি এসিড এবং লিপিড।
বেড়ে ওঠার জন্য হরমোন, হজম সহায়ক এনজাইম, ভিটামিন এবং মিনারেলস থাকার কারণে গাভীর শালদুধের চাহিদা বেড়েই চলেছে। পাস্তুরিত এবং শুকনা করে পিল বা গুড়াদুধ করে বিক্রি হচ্ছে ; যা পরে তরলের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া যায়।
মুম্বাইতে গ্লেনেগ্লেস হসপিটালে ইন্টারনাল মেডিসিনে একজন সিনিয়র কনসালটেন্ট হলেন মঞ্জুসা আগারওয়াল।
তিনি বলেন, “শালদুধ নবজাতককে সংক্রমণ এবং রোগবালাই থেকে সুরক্ষা দেয়। গাভীর শালদুধ মানুষের জন্যও পুষ্টিকর বলে দিন দিন চাহিদা বাড়ছে। গিঁট ও পেশীর গড়ন গড়ে দেওয়া থেকে আরও বহু উপকারীতা রয়েছে গাভীর শালদুধে।”
চিকিৎসক ওবেরয় বলেন, শালদুধের হলদে রঙের কারণে একে তরল সোনা ডাকা হয়।
বিটা-ক্যারোটিন উচ্চ মাত্রায় থাকে বলে শালদুধের রঙ এমন হয়ে থাকে।
গাভীর শালদুধ খাওয়া সাধারণত নিরাপদ। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, গিঁট সুস্থ রাখতে এবং খেলায় ভালো করতে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে শালদুধের সাপ্লিমেন্ট রাখা যেতে পারে।
তবে অন্যান্য সাপ্লিমেন্টের মতো এই শালদুধের সাপ্লিমেন্টও ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা এফডিএ দ্বারা অনুমোদিত নয়। কারণ বাজারে থাকা একাধিক ব্র্যাণ্ডের পণ্যে বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ পাওয়া গেছে বলে জানাচ্ছে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
যাদের দুগ্ধজাত খাবারে এলার্জি আছে, অথবা গর্ভকালে ও সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় এ ধরনের সাপ্লিমেন্ট জেনেবুঝে খেতে পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
গাভীর শালদুধের উপকারিতা
আমিষের পাশাপাশি ভিটামিন এ, ই এবং কে রয়েছে গাভীর শালদুধে। ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামের মতো খনিজও রয়েছে।
শর্করা এবং ল্যাকটোজ থাকায় শরীরে শক্তি জোগায় এই শালদুধ। উপকারী ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় বলে গিঁটের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
ওমেগা-থ্রি, ওমেগা-সিক্স ফ্যাটি এসিড স্নায়ুর বিকাশে খুব জরুরি; যা এই শালদুধ থেকে মিলবে। ভিটামিন সি, ই এবং গ্লুটাথিওন পাওয়া যায় গাভীর শালদুধে। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কোষের ক্ষয় রোধ করে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি আছে?
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা গাভীর শালদুধে খুব সামান্যই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখছেন। শুরুতে কারও সমস্যা দেখা দিলেও, কয়েকদিনের মধ্যে শালদুধ শরীরে মানিয়ে যায়।
কারও কারও অবশ্য ঢেকুর আর পাতলা পায়খানাও হতে পারে; যদি বেশি বেশি শালদুধ খাওয়া হয়।
তবে শালদুধের সাপ্লিমেন্ট বা যে কোনো সাপ্লিমেন্ট খেতে চাইলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ভালো বলে মন্তব্য করলেন ড. ওবেরয়।
গাভীর শালদুধ মানুষ কেন খাবে?
প্রাণী অধিকার কর্মী কুনাল এ মনে করেন, গাভীর শালদুধ নিয়ে বাণিজ্য করা আসলে এক ধরনের প্রতারণার সামিল।
“এই প্রথম দুধ তো গাভী তার বাছুরকে খেতে দেবে; এটা তার প্রাণী অধিকার।”
তিনি বলেন, “মানুষ তো মায়ের বুকের দুধ থেকেই পর্যাপ্ত পুষ্টি পায়।
“আমরা কি বাছুর? ঈশ্বর যেভাবে জীবজগত গড়ে দিয়েছেন সেখানে আমরা কি যথেষ্ট পরিমাণে বুকের দুধ পাইনি মায়ের কাছ থেকে? আমাদের কেন অন্য প্রাণীর কাছে যেতে হবে?
“মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা অন্য প্রাণী থেকেও দুধ নিয়ে খায়। এটা খুবই হাস্যকর।”
ভারতে প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা পিইটিএ ইন্ডিয়ার ভেগান প্রকল্পের ম্যানেজার কিরণ আহুজা বলেন, “গাভীর এই দুধ বাছুর খেলে দ্রুত তার ওজন শখানেক কিলোগ্রাম হবে। মানুষের শালদুধ মানুষের জন্য উপযুক্ত; নবজাতকের জন্য। গরু ও মহিষও তাদের বাছুরের জন্য শালদুধ দেয়।
“কুকুরের দুধ খাওয়া কথা ভাবা যেমন অস্বাভাবিক, তেমন গাভীর শালদুধ খাওয়াটাও ঠিক নয়। বড় হওয়ার পর কোনো প্রজাতিরই আর দুধ খাওয়ার প্রয়োজন নেই। ”
খামারগুলোতে বাছুর থেকে গাভীকে আলাদা করে এই ‘শালদুধ চুরি করা হয়’ মানুষের কাছে বিক্রি করতে; এমন অভিযোগও তুললেন কিরণ আহুজা।
“এই বাছুরগুলো মা ছাড়া চরে বেড়ায়, খিদায় ছটফট করে। অথবা মাংস ও চামড়ার জন্য এদের বিক্রি করে দেওয়া হয়। গরু এবং মহিষকে দুধ উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। এদের থেকে জোর করে নয়তো মাদক দিয়ে দুধ আদায় করা হয়।”
গাভীর দুধ মানুষের জন্য নয়; তাই এই দুধ খেলে মানুষের হৃদরোগ, ডায়াবেটিক, ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এমন তথ্য দিলেন ডা. আহুজা।
তিনি বলেন, “বিশ্বে মোট জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ মানুষ ল্যাকটোজ ইনটলারেন্ট। এরমধ্যে সুখবর হচ্ছে, মানুষের জন্য প্রকৃতিতে ফল-সবজির মতো ভেগান খাবারের ছড়াছড়ি রয়েছে। এসব খেলে রোগ প্রতিরোধ হয় এবং হাড় ভালো থাকে।”