বাংলাদেশে গুমের শিকার ব্যক্তিদের তথ্য যত দ্রুত সম্ভব তাদের পরিবারের কাছে সরবরাহের দাবি জানিয়েছে সংগঠন ‘মায়ের ডাক’। সেইসঙ্গে দাবি উঠেছে গুমের সঙ্গে জড়িতদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিতেরও।
শুক্রবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত মানববন্ধন থেকে এসব দাবি জানায় গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের প্ল্যাটফর্ম ‘মায়ের ডাক’।
মানববন্ধনে অংশ নিয়েছিলেন ইউনাইডেট পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সংগঠক মাইকেল চাকমা। যিনি ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল ঢাকার শ্যামলী থেকে নিখোঁজ হন। তার দল ও পরিবারের পক্ষ থেকে বারবারই দাবি করা হয়েছিল যে, মাইকেলকে গুম করা হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ৬ আগস্ট চট্টগ্রামের একটি সড়কের পাশে চোখ বাঁধা অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে। মাইকেলের অভিযোগ, রাষ্ট্রীয় বাহিনীই তাকে সাড়ে পাঁচ বছর আটকে রেখেছিল।
মানববন্ধনে মাইকেল বলেন, “আমি চাই যারা এসবের যুক্ত ছিল তাদের বিচার হতে হবে। বিচার নানান রকম হয়, কিন্তু আমি দাবি করব ন্যায় বিচার করতে হবে। যারা এসব অপরাধ করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যেন আমার মত করে দেশের আর কোনও নাগরিককে এভাবে বছরের পর বছর গুম থাকতে না হয়।”
মায়ের ডাকের এই কর্মসূচিতে নিখোঁজদের স্বজনদের পাশাপাশি অংশ নেন মানবাধিকারকর্মী, রাজনীতিবিদ, আইনজীবীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। অংশ নেওয়া পরিবারের সদস্যদের হাতে ছিল নিখোঁজ স্বজনদের ছবি।
‘মায়ের ডাক’ প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, “৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যান। অবশিষ্ট অপশক্তিগুলো এখনও দেশে অবস্থান করছে। কিন্তু গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের তথ্যগুলো এখনও পরিবারের কাছে আসছে না। যারা যারা এসব কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল, যারা এর আদেশ দিয়েছেন; সবার তালিকা বের করতে হবে এবং যথাযথ শাস্তির আওতায় আনতে হবে।”
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, “গুম শব্দ নেই বলে বিচার করা যাবে না, এটা সঠিক নয়। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের মুখ বন্ধ ছিল। আদালত এই ব্যাপারে নীরবতা পালন করেছে। কোনও হস্তক্ষেপ আমরা দেখিনি। কিন্তু এখন পরিস্থিত বদলেছে। এখনও যদি আমরা ভূমিকা না নিই, তা খুবই দুঃখজনক হবে। আমাদের দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে যেন আর কোনোদিন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে।”
গত এক দশক ধরে বাংলাদেশে ‘গুম’ শব্দটি ছিল বেশ আলোচনায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে বিরুদ্ধমত প্রকাশকারী অনেককে ধরে নিয়ে অস্বীকারের অভিযোগ করতেন পরিবারের সদস্যরা। তবে গুমের কথা বারবারই অস্বীকার করত ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ।
দায়িত্ব নেওয়ার পর গুমের প্রতিটি ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই কমিশনের সভাপতি হিসেবে রয়েছেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী।
এছাড়া কমিশনে সদস্য হিসেবে আছেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস ও মানবাধিকার কর্মী সাজ্জাদ হোসেন।
সবশেষ বৃহস্পতিবার জোরপূর্বক গুম হওয়া থেকে সব নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সই করেছে বাংলাদেশ। এই সনদে জোরপূর্বক গুমকে একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে এই সনদের লক্ষ্য কাউকে জোরপূর্বক গুম করা বন্ধের পাশাপাশি এই অপরাধের জন্য দায়মুক্তি বন্ধ করা। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা দেওয়া।
গুমবিরোধী সনদে বলা হয়েছে, কোনও মানুষকেই জোর করে গুম করা যাবে না। যত ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি আসুক না কেন, কাউকে গুম করা যাবে না। যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বা অন্য কোনও জরুরি অবস্থাকেও গুমের ন্যায্যতা হিসাবে দেখানো যাবে না।
সনদে বলপূর্বক গুমের সংজ্ঞায় বলা হয়, রাষ্ট্রের এজেন্ট বা রাষ্ট্রের অনুমোদন, সমর্থন বা সম্মতির সঙ্গে কাজ করে এমন ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের হাতে কেউ গ্রেপ্তার, আটক, অপহরণ বা অন্য কোনও পদ্ধতিতে স্বাধীনতা বঞ্চিত হওয়ার পর যদি রাষ্ট্র তা অস্বীকার করে বা নিখোঁজ ব্যক্তির ভাগ্য বা অবস্থান গোপন করে, যা সেই ব্যক্তিকে আইনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করে, তাহলে তা গুম হিসাবে গণ্য হবে।
সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর গুমের বিরুদ্ধে কর্তব্য হিসাবে বলা হয়, প্রতিটি রাষ্ট্র নিজ দেশে গুমের প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করার জন্য এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য থাকবে।
প্রতিটি রাষ্ট্র তার ফৌজদারি আইনের অধীনে বলপূর্বক গুমকে একটি অপরাধ বলে নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।