লক্ষ্য এবার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’- আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল তাই। সেই লক্ষ্যের যাত্রায় নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করলেন শেখ হাসিনা। দপ্তরও বণ্টন করে দিলেন তাদের।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের পর শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবারই তার পঞ্চম সরকারের সদস্যদের নিয়ে শপথ নেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছ থেকে।
কারা কারা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হচ্ছেন, তা একদিন আগেই জানানো হয়েছিল। শপথের পরপরই নতুন ৩৬ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর বণ্টনের প্রজ্ঞাপন আসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে।
তাতে দেখা যায়, শেখ হাসিনা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় রেখেছেন নিজের হাতে।
গত বারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের দায়িত্ব খানিকটা ছেঁটে তাকে শুধু বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বে রাখা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকা সংস্কৃতি এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে কোনো প্রতিমন্ত্রীই রাখা হয়নি।
গতবারের অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী তিনজনই বাদ পড়েন।
ফলে অর্থনীতিতে মহামারীর পর ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত মোকাবেলায় আর্থিক খাতে নতুন নেতৃত্ব আসার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
সেই নেতৃত্বে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আনা হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে। ৮০ বছর পেরিয়ে আসা মাহমুদ আলী কূটনীতিক হিসেবেই পরিচিত।
২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসা মাহমুদ আলী ২০১৪ সালের সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। তবে বিদায়ী সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। গতবার তাকে সরকারে না নিলেও এবার ফেরানো হয়েছে তাকে।
পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্বটি পেয়েছেন এবারই প্রথম মন্ত্রিত্ব পাওয়া আব্দুস সালাম। ৮২ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত এই মেজর জেনারেল ময়মনসিংহের নান্দাইল থেকে এবার নিয়ে দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন।
এক সময় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান ছিলেন সালাম, যিনি সাবেক সচিব এম এ মান্নানের উত্তরসূরি হিসেবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন শুরু করবেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে কোনো মন্ত্রী রাখেননি শেখ হাসিনা। গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন মন্ত্রিসভার নতুন মুখ আহসানুল ইসলাম টিটু।
সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনের ছেলে টিটু পৈত্রিক এলাকা টাঙ্গাইল-৬ আসন থেকে এনিয়ে দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য হলেন। এক দশক আগে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি ছিলেন তিনি।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব আগের বারের নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনকেই রেখেছেন শেখ হাসিনা।
নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকির মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বটি আসছে সময়গুলোতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার কথা।
এ কে আব্দুল মোমেনকে সরিয়ে দেওয়ার পর এবার সেই গুরুদায়িত্বটি শেখ হাসিনা দিয়েছেন তার এক সময়ের সহকারী হাছান মাহমুদকে।
চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য হাছান ২০০৮ সাল থেকে মন্ত্রিসভার সদস্য। প্রথমে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর হন তথ্যমন্ত্রী।
হাছান মাহমুদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও তথ্য মন্ত্রণালয়ে নতুন মন্ত্রী দেওয়া হয়নি। এই মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মোহাম্মদ এ আরাফাতকে।
টিভি আলোচনা অনুষ্ঠানের পরিচিত মুখ আরাফাত ঢাকার গুলশান-বনানী-সেনানিবাস আসন থেকে উপনির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর এবার দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হলেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বটি পেয়েছেন রাজনীতিতে একেবারেই নবিশ সামন্ত লাল সেন। আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সামলানো এই চিকিৎসককে টেকনোক্র্যাট হিসেবে মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয়েছে।
পদোন্নতি পাওয়া মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন, যে দপ্তরে আগের সরকারে উপমন্ত্রী ছিলেন তিনি। সরকার যখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কাজটি চালাচ্ছে, তখন শিক্ষামন্ত্রীর ভূমিকা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
আগের শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিকে এবার দেওয়া হয়েছে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনের পর গত পাঁচ বছর ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সামলে আসছিলেন।
মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ নাজমুল হাসান পেয়েছেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ছেলে নাজমুল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি পদে রয়েছেন।
আরেক নতুন মুখ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীকে দেওয়া হয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। নতুন মন্ত্রী আব্দুস শহীদ পেয়েছেন কৃষি মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রিসভায় ফিরে আসা সাবের হোসেন চৌধুরী পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় পেয়েেছন। তিনি বিদায়ী সংসদে এই মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন।
জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস বিষয়টিকে নিজের রাজনৈতিক প্রচেষ্টার মধ্যে রেখে আসছেন ঢাকার সংসদ সদস্য সাবের।
এক দশক পর মন্ত্রিসভায় ফিরে আসা মুহাম্মদ ফারুক খান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। গোপালগঞ্জের সংসদ সদস্য ফারুক খান এর আগে বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী, খুলনার সংসদ সদস্য নারায়ন চন্দ্র চন্দ এবার মন্ত্রী হিসেবে ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর দুই সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং আব্দুর রহমান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন।
মন্ত্রিসভার নতুন মুখ রাজবাড়ীর সংসদ সদস্য জিল্লুল হাকিমকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দপ্তরে আগের মন্ত্রীদেরই রেখেছেন শেখ হাসিনা। তাদের মধ্যে রয়েছেন- ওবায়দুল কাদের (সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়), আ ক ম মোজাম্মেল হক (মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়), আনিসুল হক (আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়), আসাদুজ্জামান খান কামাল (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়), তাজুল ইসলাম (স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়), সাধন চন্দ্র মজুমদার (খাদ্য মন্ত্রণালয়)।
ফরহাদ হোসেনকে মন্ত্রী হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েই রাখা হয়েছে। একইভাবে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে রাখা হয়েছে ফরিদুল হক খানকে।
ইয়াফেস ওসমান আগের বারের মতোই টেকনোক্র্যাট হিসেবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন।
প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে আগের মতোই খালিদ মাহমুদ চৌধুরী নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে, জুনাইদ আহমেদ পলক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে, জাহিদ ফারুক পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে রয়েছেন।
নতুনদের মধ্যে সিমিন হোসেন রিমি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মহিববুর রহমান দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, শফিকুর রহমান চৌধুরী প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, রুমানা আলী প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন।