Beta
শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

‘গুলি খাইয়া মরতে হইল, কী দোষ ছিল ওর’

নাজমুল হাসান
নাজমুল হাসান
Picture of আঞ্চলিক প্রতিবেদক, মাদারীপুর

আঞ্চলিক প্রতিবেদক, মাদারীপুর

“আমার ছেলেরে বিজিবি গুলি কইরা মারছে, কী দোষ ছিল আমার ছেলের? আমার ছেলে তো বাসা থেকে বের হয়ে হাসপাতালে ডিউটি করতে যাচ্ছিল। আমি এখন কী নিয়ে বেঁচে থাকব?”

সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর এসব কথা বলতে বলতে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন কোটা আন্দোলন ঘিরে ঢাকার সহিংসতায় নিহত নাজমুল হাসানের মা নাজমা বেগম।

নাজমা বেগম এক যুগেরও বেশি সময় ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করছেন। তার ছেলে ২১ বছর বয়সী নাজমুল হাসান পড়ালেখার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরি করতেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় চলতি মাসের শুরুতে। শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের এই আন্দোলন গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতায় রূপ নেয়।

পর দিন সারাদেশে ছয় জনের মৃত্যু হলে বিক্ষোভ ব্যাপক আকার ধারণ করে। বাড়তে থাকে সংঘাত, সহিংসতা ও প্রাণহানি। শুরুতে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি মোতায়েন করা হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করে সরকার।

নাজমুলের স্বজনরা জানিয়েছেন, ঢাকায় মা-ছেলের যা রোজগার দিয়ে ভালোই চলছিল তাদের সংসার। গত ১৯ জুলাই কর্মস্থলে যাওয়ার পথে কোমরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান নাজমুল। তাকে দাফন করা হয় নানাবাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলার চরগোবিন্দপুর উত্তরকান্দি গ্রামের মাতুব্বরবাড়ি।

নাজমুলের বাবা কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার চাপাতলি এলাকার সৈয়দ আবুল কায়েস। বাবার বাড়ি কুমিল্লা হলেও নানাবাড়ি মাদারীপুরেই ছিল নাজমুলের স্থায়ী ঠিকানা। নাজমা বেগম ছেলেকে নিয়ে থাকতেন ঢাকার আফতাবনগরে ভাড়া বাসায়।

মাদারীপুর শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে খোয়াজপুর ইউনিয়নের চরগোবিন্দপুর উত্তরকান্দি গ্রাম।

সম্প্রতি নাজমুলের নানাবাড়ি গিয়ে টিনশেড ঘরের বারান্দায় পাওয়া যায় নাজমুলের মা নাজমা বেগমকে। বাড়ির সবার চেহারায় পাওয়া যায় শোকের ছাপ। উঠানে ছিলেন নাজমুলের খালাতো ভাই সুমন কাজী।

এই প্রতিবেদকের পরিচয় জেনে সুমন কাজী বললেন, “আমার ভাই আট দিন ধরে কবরে শুয়ে আছে। আপনারা তাকে দেখে আসেন।”

বাড়ির পাশেই মাতুব্বরবাড়ি মসজিদের পাশে করস্থানে দাফন করা হয় নাজমুলকে।

নাজমুল হাসানের মা নাজমা বেগম।

সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর নাজমা বেগম হাউমাউ করে কান্না শুরু করেন। এসময় তার মেয়ে তানজিলা আক্তার ও মেয়েজামাই তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু থামছিল না তার বিলাপ।

নাজমা বেগম বলছিলেন, “আমি ক্যামনে এই যন্ত্রণা সহ্য করব। আমার তো একটাই মানিক আছিল, খোদা। আমার এই সন্তান ছাড়া তো আর কেউ নাই। কষ্ট কইরা মানুষ করলাম, পড়াইলাম, লেখাইলাম। এখন কী পাইলাম?

“মানুষের হাতে গুলি খাইয়া আমার মানিকের মরতে হইল, কী দোষ ছিল ওর? আমার বাবারে তোমরা আইনা দাও। আমি তো মা, আমি তো সহ্য করতে পারছি না।”

নাজমা বেগম বলেন, “মা-ছেলে একলগে কাম করতাম। ঘর ভাড়া দিতাম। সমান সমান থাকতাম। বাপজান আমারে কইতো, মা তোমার আর কষ্ট করতে হইবে না। আমি টাকা জমিয়ে বিদাশ যামু। আপু চাকরি করব। তোমার আর কষ্ট থাকব না।

“এগুলো মনে পড়লে আমার বুকের মধ্যে যে ক্যামন করে- তা কইতে পারতাছি না। সরকারের কাছে একটা জিনিসই চাই, আর কোনও মার বুক যেন খালি না হয়।”

নাজমা বেগম জানান, চোখের সামনে ছেলেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছেন।

তিনি বলেন, “আমার চোখের সামনে সব ঘটল। কিন্তু কোনও চেষ্টাতেই ছেলেডারে বাঁচাইতে পারলাম না। চোখের সামনে বাপজান আমার মইরা গেল। বিজিবি ওরে এমনে গুলি করতে পারল? আমার বাবায় তো কোনও ঝায়ঝামেলায় থাকতো না। দেশের কোনও ক্ষতি করে নাই। তাহলে ওরে কেন গুলিতে জীবন দিতে হইল?”

স্বজনরা জানিয়েছেন, নাজমুল বনশ্রীর ফরাজি হাসপাতালে খণ্ডকালীন চাকরি করতেন। ১৯ জুলাই তিনি আফতাবনগরের ভাড়াবাসা থেকে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। সংঘর্ষ এড়াতে তিনি গুদারাঘাট দিয়ে বনশ্রীর দিকে হেঁটে যাচ্ছিল।

গুদারাঘাটের নার্সারির কাছে সেতুতে ওঠার পরই গুলিবিদ্ধ হন নাজমুল। কয়েকজন শিক্ষার্থী তাকে উদ্ধার করে পাশের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে সন্ধ্যায় মারা যান নাজমুল। রাতেই মরদেহ নানাবাড়ি মাদারীপুরে আনা হয়। দাফন করা হয় নানা আব্দুল রহমান মাতুব্বরের পারিবারিক কবরস্থানে।

নাজমুলের বোন তানজিলা আক্তার বলেন, “ভাইডার যে এভাবে মরতে হইবে, এটা এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। বুকের ভেতরটায় যে কী হচ্ছে তা বোঝাতে পারব না। আমার ভাইকে কেন গুলি করে মারা হলো?”

নাজমুলের খালাত ভাই সুমন কাজী বলেন, “নাজমুল গত বছর ঢাকার ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে এইসএসসি পাস করে। অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। পড়ালেখার পাশাপাশি একটি বেসরকারি হাসপাতালে পার্টটাইম কাজ করে মাসে ১২ হাজার টাকা পেত নাজমুল। এই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে মাকে সহযোগিতা করত।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত