ডলার সংকট চলতে থাকার মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে ব্যবসা-বাণিজ্য করার বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে।
এবার চীনের পক্ষ থেকে এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কীভাবে এনিয়ে কাজ করা যায়, তা মঙ্গলবার পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুস সালামের সঙ্গে আলোচনায় তুলেছেন চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তার নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার বাড়াতে চাইছে। বিশ্ব বাণিজ্যে ডলারের দাপটে ঘুন ধরানোর লক্ষ্য বেইজিংয়ের।
দুই বছর আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও ডলারের সংকট দেখা দেয়। চড়তে থাকে ডলারের দর। আন্তঃব্যাংক লেনদেনেই ৮৫ টাকার ডলার বাড়তে বাড়তে ১১০ টাকায় উঠেছে।
ব্যাংকগুলো ১১৫ থেকে ১১৬ টাকায় নগদ ডলার বিক্রি করছে। এলসি (ঋণপত্র) খুলতে নিচ্ছে ১২০ টাকার বেশি। কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে ১২৪ টাকায়।
ডলারের এই দৌড়ের কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে ব্যবসা-বাণিজ্য করার বিষয়টি আলোচনায় আসছে। গত বছরের জুলাইয়েও এই আলোচনা উঠেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেশি দূর এগোয়নি।
প্রশ্ন আসছে, চীনা মুদ্রা ইউয়ানে বাণিজ্যিক লেনদেন কতটা সহজ হবে বাংলাদেশের জন্য? বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে?
সুবিধা কী
ডলার সংকটের মুখে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে চীনের মুদ্রা ইউয়ানে অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় জানানো হয়েছিল, ব্যাংকগুলোর অথরাইজড ডিলার শাখা চীনের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে ইউয়ান মুদ্রায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে।
বিশ্বের পাঁচটি দেশের মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ‘হাই ভ্যালু কারেন্সি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। চীনের ইউয়ান তাদের একটি। আইএমএফের কারেন্সি বাস্কেটে ইউয়ান স্বীকৃতি পেয়েছে ২০১৬ সালে। এরপর থেকে আইএমএফের পর্যালোচনায় মুদ্রা হিসেবে ইউয়ান আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মানীত ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ডলার সংকটের এই সময়ে টাকা-ইউয়ানে লেনদেনের বিষয় খুবই প্রাসঙ্গিক। দু-দেশের মধ্যে সম্মানজনক আলোচনার মাধ্যমে যদি এটা করা যায়, তাহলে ‘খুবই ভালো’ হবে।
“ইউয়ান এমন এটি মুদ্রা যেটি বাংলাদেশ এবং চীন পরস্পরের সঙ্গে বাণিজ্য, ঋণ ও বিনিয়োগের জন্য ব্যবহার করতে পারে। ইউয়ান মুদ্রায় চীনের সাথে লেনদেনের অর্থ হচ্ছে, ডলার সংকটকে অ্যাভয়েড (পাশ কাটিয়ে) করে আপনি লেনদেন করতে পারবেন, যেটা দুটো দেশ গ্রহণ করবে। এতে দুই দেশই লাভবান হবে।”
চীনের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ করেন, সেটা যদি ইউয়ানে আসে, তাহলে ডলার সংকট কেটে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
“আরেকটি বিষয় হচ্ছে- চীনের সঙ্গে যে সব দেশের ইউয়ানে বাণিজ্য হয়, একটা ক্লিয়ারিং সেটেলমেন্ট ব্যবস্থার মাধ্যমে সেই সব দেশের সঙ্গে যদি আমরা ইউয়ানে বাণিজ্য করতে পারি, তাহলে আরও ভালো হবে।”
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এবং বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজও একে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “চীনের সাথে ইউয়ানে বাণিজ্য করতে পারলে আমাদের জন্য ভালো হবে। কারণ, চীনও ইউয়ানে লেনদেন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
“চীনের সাথে পুরো লেনদেন হয়ত ইউয়ানে করা যাবে না। তবে আংশিক হয়ত করা যেতে পারে। তাতে ডলারের উপর কিছুটা চাপ কমতে পারে।”
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে যদি সত্যি সত্যিই এটা চালু হয়, তাহলে খুবই ভালো।”
অসুবিধা কোথায়
বাণিজ্যে ভারসাম্যের পাল্লা চীনের দিকে হেলে থাকায় তাদের মুদ্রায় লেনদেনে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সুযোগ কম বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
প্রতি বছর চীন থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। তবে এর বিপরীতে চীনে রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলারেরও কম।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীনে ৬৭ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “তবে এখানে মনে রাখতে হবে, যেহেতু চীনে আমাদের রপ্তানি কম, সে কারণে ইচ্ছে করলেই ইউয়ানে খুব বেশি বাণিজ্য করা যাবে না। যে ১ বিলিয়ন ডলারের মতো রপ্তানি করি, সেটাই করতে হবে।”
আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবসময় ডলার ব্যবহার করে আসছে। তাই রিজার্ভে ইউয়ানের পরিমাণ কম থাকার বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি।
আনোয়ার-উল আলম পারভেজ বলেন, “ব্যাংকগুলোর কাছে ইউয়ান কতটা আছে, সেটা একটা বিষয়। আমরা তো চীনে খুব বেশি এক্সপোর্ট করি না। ব্যাংকগুলোর কাছে যদি পর্যাপ্ত ইউয়ান না থাকে তাহলে ডলার দিয়েই ইউয়ান কিনতে হবে।”
আহসান মনসুর বলছেন, লেনদেন ইউয়ানে করার কাজটি সহজ হবে না।
“দুই দেশকেই এ বিষয়ে সমানভাবে আন্তরিক হতে হবে। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে রুপিতে বাণিজ্য কিন্তু চালু হয়েছে ছয়-সাত মাস হয়ে গেল, খুব বেশি লাভ কিন্তু আমাদের হচ্ছে না। যদি আমরা ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি (চীনে) করতে পারতাম, তাহলে আমাদের জন্য ভালো হত।”
বিশ্ববাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বৈরিতার মধ্যে পড়ার শঙ্কার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “আরেকটু বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে; সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের সম্পর্কের খুব বেশি উন্নতি হয়নি। এ অবস্থায় আমরা যদি চীনের সঙ্গে ইউয়ানে বাণিজ্য, ঋণ ও বিনিয়োগে চলে যাই তাহলে যুক্তরাষ্ট্র মনঃক্ষুণ্ন হতে পারে।”
“সেক্ষেত্রে একক দেশ হিসেবে আমাদের রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না, সেটাও ভাবনায় রাখতে হবে,” বলেন দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।