Beta
বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৫

জামায়াত নিষিদ্ধ হবে কোন পথে

শাহবাগ আন্দোলন থেকে জামায়াতে ইসলামীকে আইন করে নিষিদ্ধ করার দাবি জোরেশোরে উঠেছিল।
শাহবাগ আন্দোলন থেকে জামায়াতে ইসলামীকে আইন করে নিষিদ্ধ করার দাবি জোরেশোরে উঠেছিল।
[publishpress_authors_box]

জামায়াতে ইসলামকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার; কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায়?

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, বুধবারের মধ্যেই সেই সিদ্ধান্ত জানাবেন তারা।

আইনজ্ঞরা বলছেন, দুটি প্রক্রিয়ায় এই কাজটি করতে পারে সরকার। একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে বিচারের মাধ্যমে; অন্যটি হচ্ছে নির্বাহী আদেশে। এছাড়া সংসদের মাধ্যমেও তা হতে পারে।

আইন সংশোধন করে জামায়াতের বিচার করাটি সময়সাপেক্ষ বিষয়; সেক্ষেত্রে নির্বাহী আদেশে যে কোনও সময়ই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে সরকার।

সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতার পর সোমবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের বৈঠকে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত আসে।

এই সহিংসতায় দুই শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার পাশাপাশি সরকারি বহু স্থাপনায় আগুন ধরানো হয়। এই কাজে জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির জড়িত ছিল বলে আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াত নিষিদ্ধ করার দাবি দীর্ঘদিনের। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলনে এই দাবিটি জোরাল হয়ে ওঠে।

এরপর ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন থেকে পুনরায় এই দাবি আসে। তখন আইন করে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছিল শাহবাগ থেকে।

এরমধ্যে আদালতের আদেশে রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হলেও তাকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়াটি ঝুলে আছে এক দশক ধরে।

নির্বাহী আদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার কোনও পরিকল্পনা সরকারের নেই- এই কথাটি এক বছর আগেও বলেছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের মাধ্যমে বিচার করা হবে দলটির। সংশোধিত আইনের খসড়া শিগগিরই মন্ত্রিসভায় তোলা হবে।

বর্তমান আইনে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে শুধু ব্যক্তির বিচারই করতে পারছে ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু দলের বিচার করার সুযোগ নেই। সেজন্যই আইন সংশোধন করতে হবে।

একটি মামলার রায়ে ট্রাইব্যুনাল জামায়াতকে ‘ক্রিমিনাল দল’ বলার পর দল হিসাবে জামায়াতের বিচারের পথ অনেকটাই প্রশস্ত করে।

সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ২০১৪ সালে তদন্ত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন প্রসিকিউশন বিভাগে জমা দেয়। এরপর তৎকালীন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজকে প্রধান করে সাত সদস্যদের একটি প্রসিকিউশন দলও গঠন করা হয়েছিল।

কিন্তু আইন সংশোধন না হওয়ায় তা আর বিচারে গড়ায়নি।

তুরিন আফরোজ মঙ্গলবার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের জন্য আমরা কাজ করতেছিলাম। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের জন্য আমাদের যাবতীয প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। কিন্তু আইন সংশোধনের কথা বলে ২০১৪ সালের ২৬ জুন এক ঘোষণা দেওয়া হয়। তারপর আর আলোর মুখ দেখেনি মামলাটি।”

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মঙ্গলবার সকাল সন্ধ্যার জিজ্ঞাসায় বলেন, “নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জামায়াত নিষিদ্ধ হবে।”

কোন আইনে বা কীভাবে হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যখন নিষিদ্ধ হবে, তখন আপনারা দেখতে পাবেন।”

আইনজ্ঞরা বলছেন, নির্বাহী বিভাগের আদেশে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার সুযোগ আছে সরকারের।

৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবেঃ তবে শর্ত থাকে যে, কোন ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি-

(ক) উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়;

(খ) উহা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়;

(গ) উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোন দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গী কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; বা

(ঘ) উহার গঠন ও উদ্দেশ্য এই সংবিধানের পরিপন্থী হয়।

এই অনুচ্ছেদের প্রয়োগ ঘটিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা জঙ্গি দলকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার।

নির্বাহী আদেশে জামায়াত নিষিদ্ধ করার সুযোগ থাকলেও তাতে একাত্তরে দলটির যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি লঘু হয়ে যাবে, এমন মতও আছে।

একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক তুরিন আফরোজ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নির্বাহী আদেশে জামায়াত কেন, যে কোনও সংগঠনকে যে কোনও সময় নিষিদ্ধ করতে পারে সরকার। নির্বাহী আদেশে কিন্তু ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার একবার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিল।

“এখন আমার বক্তব্য হলো- নির্বাহী আদেশে জামায়াত নিষিদ্ধ করা হলে আসলে কী হবে? অন্য সরকার আসলে আবার জামায়াত আসবে। এতে কিন্তু সমস্যাটা সমাধান না।”

জামায়াত নিষিদ্ধ করতে চাইলে বিচারের মাধ্যমে তা করা উচিৎ বলে মত প্রকাশ করেন এই আইনজীবী।

তিনি বলেন, “আমরা যদি মনে করি জামায়াতের আদর্শটাই ঠিক না, দেশবিরোধী, তাহলে কিন্তু ট্রাইব্যুনালে মামলা নিয়ে বিচারের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।”

নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের উদাহরণ দিয়ে বলেন, “সেখানে দলের শীর্ষনেতাদের বিচার হয়ে ফাঁসি হয়েছে। আবার কতগুলো সংগঠনেরও বিচার হয়েছে। একই সাথে তারা যেটি করেছে সেটা হলো-দীর্ঘ সময় ধরে সমূলে উৎপাদনের ব্যবস্থা করেছিল সেখানকার সরকার।

“আমরা কিন্তু তার কিছুই করি নাই। এখন এই মূহূর্তে জামায়াত নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে আগুনে ঘি ঢালার মত অবস্থা হবে না” প্রশ্ন রাখেন তিনি।

তুরিন বলেন, “আমি বলব, বর্তমান বাস্তবতায় জামায়াত নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত কতখানি ফলপ্রসূ হবে, সেটা সরকারকে ভেবে দেখা দরকার।”

গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে ইমরান এইচ সরকার এক বিবৃতিতে জামায়াত নিষিদ্ধের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, “কিন্তু সরকারের দীর্ঘ কালক্ষেপণের প্রক্রিয়া দেশকে যে অরাজকতার প্রান্তে দাঁড় করিয়েছে, তার ভুক্তভোগী হচ্ছে জনগণ।

“২০১৩ সালে নির্বাচন কমিশন যখন যুদ্ধাপরাধী সংগঠনটির নিবন্ধন বাতিল করেছিল, তখন তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে তা আরও কার্যকর হতো।”

এখন ক্ষমতাসীনদের মধ্যে জামায়াত-শিবিরের ও জঙ্গি মনস্কতার যে ‘ভাইরাস’ ছড়িয়ে পড়েছে, তা দূর করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছে গণজাগরণ মঞ্চ।

এদিকে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামী এক বিবৃতিতে বলেছে, “আওয়ামী লীগ জামায়াতের সাথে বসে অতীতে অনেক আন্দোলন করেছে। দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার ফর্মূলা জাতির সামনে উপস্থাপন করেছে এবং তার ভিত্তিতে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

“এরকম একটি গণতান্ত্রিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার দাবি বেআইনি, এখতিয়ারবহির্ভূত ও সংবিধান পরিপন্থি। জনগণ ১৪ দলের এই দাবি গ্রহণ করবে না।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত