ভারতের জোটভিত্তিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এক নাম এনডিএ (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স)। ২০২৩ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স (ইন্ডিয়া) গঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এনডিএ বেশ ভালো অবস্থানেই ছিল।
এনডিএ থেকে ২০১৪ ও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করেছে। কিন্তু ইন্ডিয়া গঠনের পর বিজেপি তার বেশ কয়েকটি মিত্র দলকে হারিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শিরোমনি আকালি দল ও শিবসেনার মতো পরীক্ষিত পুরনো মিত্র।
২০২৩ সালের ১৮ জুলাই এক বৈঠকে এনডিএ ঘোষণা করে যে, তাদের জোটসঙ্গীদের সংখ্যা ২৮। তখন ইন্ডিয়া জোটের সদস্য ছিল ১৮টি দল। কয়েক মাসের ব্যবধানে এনডিএ জোটে যোগ দেয় অন্ধ্র প্রদেশের শক্তিশালী আঞ্চলিক দল তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি), বিহারের জনতা দল-ইউনাইটেড ও টিপরা মোথা। একই সময়ে এনডিএ এআইএডিএমকে’র মতো শক্তিশালী দলও হারায়।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফল আরও একবার এনডিএ জোটকে দ্বান্দ্বিক এক অবস্থার সামনে এসে দাড় করিয়েছে। ভোটের ফলে দেখা যায়, এনডিএ জোটগত ভাবে ২৯২ আসন পেলেও বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। ফলে বিজেপির জন্য এখন টিডিপি ও জেডি-ইউ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে।
নির্বাচনী ফলের বাস্তবতায় এখন প্রশ্ন আসছে, এই মিত্ররা আসলে বিজেপির কাছে কী চাইবে। মিত্ররা কী এনডিএ জোটে থাকবে নাকি ত্যাগ করবে।
তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি)
টিডিপি প্রথম এনডিএ জোটে যোগ দেয় ১৯৯৬ সালে। তখন চন্দ্রবাবু নাইড়ু ছিলেন একজন তরুণ নেতা। ২০১৮ সালে এনডিএ জোট ত্যাগ করায় টিডিপিকে বেশ ধাক্কা খেতে হয়েছিল। ২০১৪ সালে তেলেঙ্গানার বিধানসভায় ২টি ও ২০১৯ সালে অন্ধ্র প্রদেশের বিধানসভায় ২৩টি আসন পেয়েছিল দলটি।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে টিডিপি ইউপিএ জোটে যোগ দিয়েছিল। এরপর এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে টিডিপি আবার এনডিএ জোটে যোগ দেয়। তখন অন্ধ্র প্রদেশের ১৭৫টি আসনের মধ্যে ১৩৪টি পায় টিডিপি। আর এবার লোকসভার ১৬ আসন পেয়ে প্রায় দুই দশক পর দলটির নেতা নাইড়ু কিংমেকার হিসেবে আবির্ভুত হয়েছেন।
ইন্ডিয়া জোটের নেতারা নাইড়ুর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, এমন রিপোর্ট ভারতীয় মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে। রিপোর্ট বলছে, টিডিপি ইন্ডিয়া জোটে যোগ দিলে একাধিক মন্ত্রণালয় পেতে পারে।
তবে টিডিপি এনডিএ জোটের সঙ্গেই থেকে যেতে পারে, এমন দুইটি কারণও আছে।
প্রথমত; অন্ধ্রপ্রদেশে বিভক্ত হওয়া, ওয়াই এস রেড্ডির মৃত্যু ও পার্টিতে বিভক্তির পর কংগ্রেস এখনও তার হারানো জনপ্রিয়তা ফিরে পায়নি। দ্বিতীয়ত; রাজ্যে নাইডু নির্বাচনী প্রচারে মোদী ও বিজেপির সঙ্গে তার গভীর সম্পর্কের দিকটি তুলে ধরেছিলেন। এমন অবস্থায় জোট পরিবর্তন করলে তার ভবিষ্যত রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
জনতা দল (ইউনাইটেড)
ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের জন্য প্রায় বিনোদনের সমান হলেন নীতিশ কুমার। তাকে একটা সময় প্রধানমন্ত্রী পদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু বহুবার জোট বদলে তার চরিত্র নিয়ে এখন দেশটির অধিকাংশ মানুষই সন্দিহান। নীতিশ প্রথম এনডিএ জোটের সঙ্গে গাঁট বাধে অটল বিহারি বাজপেয়ির আমলে। তখন তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী।
২০১৩ সালে মোদীর সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে এনডিএ ছাড়েন নীতিশ। তখন অনেকেই ধরে নিয়েছিল যে, তিনি হয়তো প্রধানমন্ত্রী পদে লড়বেন।
এই অনুভূতি ২০১৫ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচনের পরে শক্তিশালী হয়েছিল। তখন কংগ্রেস, আরজেডি, জেডি(ইউ) এবং বাম দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত জোট মহাগাটবন্ধন বিজেপিকে পরাজিত করেছিল। দুর্ভাগ্যবশত ২০১৭ সালে নীতিশ ওই জোট থেকে বের হয়ে যান। আবার ২০২২ সালে জোটে ফিরে আসেন। এরপর ২০২৪ সালে ফের এনডিএ জোটে যোগ দেন।
এভাবে জোট বদল করে নীতিশ তার গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই হারিয়েছেন। কিন্তু এবারের নির্বাচনে লোকসভার ১২ আসন পেয়ে তিনিও কিংমেকার হয়ে উঠেছেন। এনডিএ জোটে এখন তৃতীয় বৃহত্তম দল হলো জেডি-ইউ। নীতিশ যেহেতু খুব সহজেই জোট বদল করেন। ফলে ইন্ডিয়া জোটের ভালো প্রস্তাবে হয়তো তিনি সাড়াও দিতে পারেন।
লোক জনশক্তি পার্টি (রাম বিলাস)
লোক জনশক্তি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হলেন রাম বিলাস পাসওয়ান। ভারতের রাজনীতিতে বুদ্ধিমান রাজনীতিক হিসেবে তার নাম আছে। ঝোপ বুঝে জোট বদলের রেকর্ড রয়েছে তার।
বাজপেয়ির আমল থেকে থাকলেও, রাম বিলাস ২০১৪ সালে নির্বাচনের কয়েক মাস আগে ফের এনডিএতে যোগ দেন। নিজের দলের প্রভাব খাটিয়ে সুবিধা আদায় করতে ওস্তাদ ছিলেন তিনি। কিন্তু এখন দেখার বিষয় তার ছেলে চিরাগ পাসওয়ান কী করে।
লোকসভার ৫টি আসন লোক জনশক্তি পার্টির অধীনে। বিহারের দলিত জনগোষ্ঠীর মুখপাত্রই বলা হয় চিরাগকে। এখন পর্যন্ত তিনি এনডিএর প্রতিই অনুগত। কিন্তু এটা পরিবর্তন হতে পারে। যদি ইন্ডিয়া জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়ে মাত্র ৫ আসন কম হয়, সেক্ষেত্রে এনডিএ জোট ত্যাগ করে ইন্ডিয়াতে যোগ দিতে পারেন চিরাগ। কারণ এক্ষেত্রে কম আসন নিয়েও মন্ত্রণালয় পেতে পারেন চিরাগ।
শিব সেনা (সিন্ধে)
বিজেপির হিন্দুত্ববাদের দীর্ঘদিনের সঙ্গী শিব সেনা। সেই ১৯৮৪ সাল থেকে এনডিএ জোটে থাকলেও ২০১৯ সালে মহারাষ্ট্র বিধানসভা ভোটকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে ভাঙন ধরে।
শারদ পাওয়ারের ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির মতোই ২০২২ সালে এনডিএ থেকে বের হয়ে যায় শিবসেনা। তখন শিব সেনার বিদ্রোহী নেতা একনাথ সিন্ধের নেতৃত্বে নতুন শিব সেনা দল তৈরি হয়।
এবারের নির্বাচনে সিন্ধের শিব সেনা এনডিএ জোটের শরিক দল। তারা পেয়েছে ৭টি আসন। বিশ্লেষকরা বলছেন, সিন্ধে হয়তো উদ্ভব ঠ্যাকারের নেতৃত্বে শিব সেনার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। উদ্ভবের নেতৃত্বে শিব সেনা এখন ইন্ডিয়া জোটে আছে।
আরএলডি ও জেডিএস
উত্তর ও দক্ষিণের দুই দল বিরোধী অবস্থান থেকে লাভের আশায় এনডিএ জোটে যুক্ত হয়েছিল। উত্তর প্রদেশের রাষ্ট্রীয় লোক দল ও কর্ণাটকের জনতা দল (সেক্যুলার) উভয়েই এবার দুইটি করে আসন পেয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দুই দল আপাতত এনডিএ জোটে থাকলেও, হাওয়া বুঝে জোট পাল্টাতে পারে।
তথ্যসূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।