মৃত মায়ের লাশ নিতে তখন হাসপাতালে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। চিকিৎসক জানালেন জোলির মায়ের কাছে শেষ বেলায় কী কথা দিয়েছেন তিনি; জোলির স্বাস্থ্য পরীক্ষাই ছিল তার জরুরি প্রতিশ্রুতি।
প্রায় এক দশক স্তন ও ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের সঙ্গে যুঝেছেন জোলির মা মার্কিন অভিনেত্রী মার্শেলাইন বারট্র্যান্ড। তারপর ২০০৭ সালে ৫৬ বছর বয়সে ক্যান্সারের কাছে হার মানতে হয় তাকে।
জোলির জন্মের কয়েক মাস আগে তার নানি ক্যান্সারে মারা যান। জোলির নানির মাও মারা গিয়েছিলেন ক্যান্সারে; তার ডিম্বাশয়ে ক্যান্সার হয়েছিল। ২০০৪ সালে জোলির খালার শরীরেও ক্যান্সার ধরা পড়ে।
তাহলে জোলির শরীরেও কি বাসা বাঁধবে ক্যান্সার?
দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে জিন পরীক্ষা করালেন হলিউড অভিনয়শিল্পী জোলি। দেখা গেল, আশঙ্কা অমূলক নয়। বিআরসিএ১ জিন রয়েছে তার শরীরেও; যা থেকে হতে পারে ক্যান্সার।
চিকিৎসক জানালেন, এই জিনের কারণে জোলির বেলায় স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি ৮৭ শতাংশ। পাশাপাশি ডিম্বাশয়ে ক্যান্সার দেখা দেওয়ার ভয়ও রয়েছে ৫০ শতাংশ।
এরপর কঠিন এক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে হাঁটতে হলো লারা ক্রফ্ট: টুম্ব রেইডার অভিনেত্রীকে। ক্যান্সার হওয়ার আগেই ঠেকানোর কথা ভাবলেন তিনি। আর তাই দুই স্তন অপসারণ ছাড়া উপায় ছিল না।
“আমি স্তন অপসারণ দিয়েই শুরু করলাম। কারণ ডিম্বাশয় ক্যান্সারের চেয়ে স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিই বেশি ছিল আমার। আর এই অপারেশনও খানিক জটিল ছিল।”
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হলো সেই প্রক্রিয়া।
সপ্তাহ দুয়েক পর বড় রকমের অস্ত্রোপচার হলো জোলির শরীরে। স্তনের কোষ অপসারণ করে অস্থায়ী পুর বসিয়ে দেওয়া হলো সেখানে।
এই অপারেশনে লেগেছিল আট ঘণ্টার মতো।
হাসপাতালের বিছানায় সেসময় নিজেকে নিয়ে জোলির অনুভূতি ছিল, “ঘুম ভেঙে দেখলাম শরীরে ড্রেন টিউব আর স্তনে এক্সপ্যান্ডার বসানো রয়েছে।মনে হবে বুঝি কোনো সাই-ফাই সিনেমা থেকে তুলে আনা দৃশ্য। তবে অস্ত্রোপচারের একদিন পরেই স্বাভাবিক জীবনে ফেরা যাবে।”
এরমধ্যে জোলির খালা ডেব্বি মার্টিন স্তন ক্যান্সারে ভুগে ৬১ বছর বয়সে মারা যান ২০১৩ সালের মে মাসে।
আর জোলির তিন মাসের মেডিকেল প্রক্রিয়া শেষ হয় ২৭ এপ্রিল; তাতে দুই স্তনই কেটে ফেলেন জোলি।
মাস্টেক্টমি করার এই সময় কৃত্রিম স্তনও বসানো হয় জোলির।
সামান্য বিরতির পর স্তন কেটে ফেলার কথা নিজেই জানান দেন শোবিজ তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।
নিউ ইয়র্ক টাইমসে ‘মাই মেডিকেল চয়েস’ শিরোনামে মতামত লেখেন; যা ছাপা হয় ২০১৩ সালের ১৪ মে।
ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রের টাইম ম্যাগাজিনের ২৭ মে সংখ্যার প্রচ্ছদে জায়গা করে নেন জোলি। ফেব্রুয়ারিতে অস্ত্রোপচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগের জোলি ছিলেন প্রচ্ছদে। সাংবাদিক জেফরি ক্লুগার ও অ্যালিস পার্কের জোলিকে নিয়ে করা প্রতিবেদনের প্রচ্ছদ শিরোনাম ছিল ‘দ্য অ্যাঞ্জেলিনা ইফেক্ট’।
কেন জোলি টাইমসের প্রচ্ছদে তা নিয়ে জেফরি ক্লুগার বলেছিলেন, “একজন নারী তার রূপের জাদুরে মোহিত করে রেখেছিলেন সবাইকে। এরপর হুট তিনি ঘোষণা দিলেন, তার দুটো স্তনই কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে ক্যান্সারের ঝুঁকি এড়াতে; সামাজিক ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে এতো ভূমিকম্পের মতো ঘটনা।”
স্তন অপসারণ করার পর জোলির ক্যান্সারের ঝুঁকি ৮৭ শতাংশ থেকে নেমে এসেছিল পাঁচ শতাংশের নিচে।
চিন্তামুক্ত জোলি তাই নারীদের উদ্দেশ্যে নিউ ইয়র্ক টাইমসে লিখেছিলেন, “মাস্টেক্টমি করার সিদ্ধান্ত খুব সহজ কিছু ছিল না। কিন্তু আমি এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরে খুশি।
“…আমার সন্তানদের কাছে এখন বলতে পারব, স্তন ক্যান্সারে আমাকে হারানোর ভয় নেই আর।”
“আমার নারীত্বে কোনো কমতি হয়েছে বলে আমার কাছে মনে হয় না। আমি তো নিজের ভেতরে শক্তি অনুভব করি এমন জীবন বেছে নিতে পেরে; এতে করে আমার মেয়েলী বৈশিষ্ট্যে কোনো ভাটা পড়েনি। ”
কৃত্রিম স্তন বসানোর প্রক্রিয়ায় জোলি টিয়ারড্রপ স্তন বসিয়েছিলেন। গোলাকার ও টিয়ারড্রপ স্তন প্রতিস্থাপনের মধ্যে টিয়ারড্রপ একেবারে স্বাভাবিক স্তন গড়নের মতোই অনুভব করায় নারীকে।
স্তন অপসারণের পর নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়মিত ভাবে করাতেন জোলি। এরপর ২০১৫ সালে আরও একটি সিদ্ধান্ত নিতে হলো; অপসারণ করলেন ডিম্বাশয়।
ওই বছর ২৪ মার্চ নিউ ইয়র্ক টাইমসে আবারও লিখলেন ‘ডায়রি অব এ সার্জারি’ শিরোনামে।
পেট/সিটি স্ক্যান পরীক্ষায় একটি ডিম্বাশয়ে দানার মতো টিউমারে ক্যান্সার ঝুঁকি পাওয়া যায়নি। তবে বিপদমুক্ত থাকতে ডিম্বাশয় ও ফ্যালোপিয়ান টিউব দুটি ফেলে দেওয়ার সুযোগ ছিল জোলির কাছে।
জোলি অবশ্য এই দিনের জন্য নিজেকে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত করে চলেছিলেন। আর তাই তিনি ডিম্বাশয় ও টিউব অপসারণ করেন।
ডিম্বাশয় অপসারণ করার পর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে ভারসাম্য আনতে হরমোন প্রতিস্থাপন চিকিৎসা শুরু করেন জোলি। জরায়ুতে বসান প্রোজেস্টেরন আইইউডি। তাতে করে জরায়ু থাকবে ক্যান্সারের ঝুঁকি মুক্ত।
শরীরের এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া নিয়ে তার ভাষ্য ছিল, “আমার ম্যানোপজ হয়েছে। আমি আর সন্তান ধারণ করতে পারব না। আমি জানি শরীরে আরও অনেক বদল আসবে। তবে যাই আসুক সামনে আমি সেসব সহজভাবে নিতে পারব। আমি অনেক আত্মবিশ্বাসী। কারণ এসব তো জীবনেরই অংশ। এসবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ”
যদিও অস্ত্রোপচার করে স্তন ও ডিম্বাশয় ফেলে দেওয়াই সুস্থ থাকার একমাত্র পথ নয়।
নারীদের সেই বার্তা দিতে জোলি বলছেন, “আমি অনেক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছি।
“অনেক নারী জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খেয়ে থাকেন। অথবা বিকল্প ওষুধে ভরসা করেন। এখানে জরুরি হচ্ছে চিকিৎসার বিকল্প সব পথ নিয়ে জানা। তারপর নিজের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই পন্থা বেছে নিতে হবে।”
পরিবারে কারও জরায়ু ক্যান্সার ছিল না বলে জরায়ু অপসারণ নিয়ে ভাবেননি জোলি।
পরিবারের জন্য সুস্থ থাকতে চাওয়ার কথা জানিয়ে ওই কলামে তিনি বলেন, “আমি প্রাকৃতিক ভাবে আমার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে চলবো।
“আমার নারীসত্তা বেশ তীব্র, আমি নিজের ও পরিবারের ভালো বুঝে জন্য সিদ্ধান্ত নেই। আমি জানি, আমার সন্তানদের কখনও বলতে হবে না, “মা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারে মারা গেছে।””
বংশের নারীদের ক্যান্সারে মৃত্যু জোলির মনে গভীর দাগ কেটেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি চাননি তার সন্তানদের মনে ক্যান্সারে মাকে হারানো ভয় বাসা বাঁধুক। তাই আক্রান্ত হওয়ার আগেই শরীর থেকে ক্যান্সারের সব রকম সম্ভাবনা ফেলে দেন জোলি।
জোলির ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা যাচাইয়ে জিন পরীক্ষা এবং পরে স্তন ও ডিম্বাশয় ফেলে দেওয়া চিকিৎসা শাস্ত্রে উদাহরণ হয়ে ওঠে ; গবেষণার বিষয় হয়ে ওঠে। জোলি অনেক নারীর প্রেরণা হয়ে ওঠেন।
স্তন ফেলার পর আরও ১০টি বসন্ত পার করেছেন জোলি। এই দশ বছরে একাধিক সিনেমা মুক্তি পেয়েছে এই অস্কারজয়ী অভিনেত্রীর। এরমধ্যে সাড়া ফেলা ম্যালিফিসেন্ট সিনেমার নামও আসবে।
জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূত হয়ে ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে এসে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেন জোলি। ২০০১ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টানা ২০ বছরেরও বেশি সময় জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) বিশেষ দূতের দায়িত্বে কাজ করেন তিনি।
বর্ণিল সাজে গত বছর মার্কিন লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ভোগের প্রচ্ছদকন্যাও হয়েছেন জোলি।
ছয় সন্তানের মা জোলির বয়স এখন ৪৮ বছর। সন্তানকে সময় দেওয়ার পাশাপাশি কর্মব্যস্ত জীবন পার করছেন তিনি। শোবিজ জগতে তার আবেদন এখনও অটুট।