অফিস থেকে আগে বের হয়েও জামিলের মনে হয় নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে পৌঁছাতে হবে স্টেশনে। সন্ধ্যা ৬টায় শাগুফতার ট্রেন ঢাকা পৌঁছাবে। হাতে এখনো প্রায় দেড় ঘন্টা আছে। তবুও চিন্তা হচ্ছে, কমলাপুর পৌঁছাতে পারবে তো! রাইড শেয়ারিং অ্যাপ দিয়ে বাইক কল করেছে আরও আগেই। ১০ মিনিট লাগবে দেখালেও কোনও খোঁজ নেই। ফোন কল করে জানলো গুলশান -১ এর জ্যামে আটকে আছেন রাইডার।
জ্যাম ঠেলে মহাখালী থেকে কমলাপুর যেতে কম করে হলেও ঘণ্টাখানেক লাগবে। বাইক কি আরও দেরি করবে? যদি দেরি হয়ে যায় তাহলে শাগুফতা অভিমান করবে না তো! পৌঁছানোর আগেই যে প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষায় থাকতে চেয়েছিল জামিল। বুঝবে!
এক বছর হলো শাগুফতার পোস্টিং ঢাকার বাইরে। দেরি হওয়ার জন্য শাগুফতার রাগ নিয়ে উদ্বেগ দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে জামিল-শাগুফতার বিয়ের বয়স হয়তো বড়জোর বছর দেড়েক। কিন্তু আসলে তাদের সংসারের বয়স সামনের মাসে পাঁচ বছর হতে যাচ্ছে।
শাগুফতার ঢাকার বাইরে পোস্টিংয়ের আগের বছর তিনেক আটপৌঢ়ে দাম্পত্যের ক্লান্তিতে পেয়ে বসেছিল দুইজনকেই। অথচ পোস্টিং এর পরপরই আবার যেন ক্যাম্পাসের পুরনো প্রেমের দিনে ফিরে গিয়েছে দুইজন।
দেহের দূরত্ব যেন কমিয়ে এনেছে মনের দূরত্বকে। ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ কখনও কখনও তাই আশির্বাদও। এ যেন- ‘নয়ন তোমায় পায়না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে…’।
জামিল-শাগুফতার মতো লং ‘ডিসট্যান্স রিলেশিপ’-এ সুফল পাওয়া দম্পতির সংখ্যা কম নয়। সম্পর্ক ক্লান্তিকর ও একঘেঁয়ে ঠেকলে তাই কেউ কেউ ‘ডিসট্যান্স রিলেশনশিপে’র কথা ভাবতেও পারেন। অবশ্যই সাময়িক সময়ের জন্য।
জেনে নেওয়া যাক ‘ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ’ এর কিছু দিক-
সঙ্গীর প্রতি ভালোলাগা
অনেক সময় দম্পতিরা দীর্ঘ সময় একসাথে থাকার কারণে একে অপরের ভালো গুণগুলো আর আলাদা করে দেখতে পাননা। কিন্তু যখন তাদের অবস্থানগত দূরত্ব তৈরি হয়, তখন অবসরে সঙ্গীর খুঁটিনাটি ভালো দিকগুলো মনে পড়তে থাকে। এতে করে ভালোলাগার নানাদিক আবারও সজীব হয়ে ওঠে। ধূসর শীতের পর বসন্তে সবুজ পাতা ফোটার সাথে তুলনা করা যায় একে।
বাড়তে পারে যোগাযোগ দক্ষতা
ডিস্টেন্স রিলেশনে যোগাযোগ হয়ে দাঁড়ায় মুঠোফোন নির্ভর। ফলে কথা বলেই ধরে রাখতে হয় সম্পর্ক। দুজনেই তাই নিজেদের প্রকাশ করতে আরও বেশি যত্নবান হন। শুধুই কি কথা বলা? একে অপরকে যেহেতু শুনতে হয় অনেক, সেহেতু দুজনেই হয়ে উঠেন ভালো শ্রোতা। এর সম্পর্কে ইতিবাচক প্রভাব পরে।
মানসিক সংযোগ এবং ঘনিষ্ঠতা
গণমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ায় সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার রসায়নে অনেক সময়েই যৌনতাকে প্রয়োজনের চাইতেও বড় করে দেখানো হয়। ফলে মানুষের মধ্যে যৌনতা নিয়ে তৈরি হয় ‘অবসেশন’। সুস্থ-স্বাভাবিক সম্পর্কে যৌনতা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু সম্পর্কের একমাত্র নিয়ামক কখনওই নয়।
ডিসট্যান্স রিলেশন বা দূরত্বের সম্পর্কে দুজনেই শারীরিক প্রয়োজনের উর্ধ্বে গিয়ে অপরাপর মানবিক চর্চা ও অনুভূতির ওপর বেশি করে মনোযোগী হয়। বোঝাপড়া বাড়াতে যুগলরা একে-অপরকে আরও বেশি করে সময় দেন । শারীরিক দূরত্ব থাকায় মানসিক নির্ভরতা হয়ে ওঠে অপরিহার্য। ফলে সম্পর্কে পারষ্পরিক বোঝাপড়া, শ্রদ্ধাবোধ, আস্থা ও বিশ্বাস নির্মাণের চর্চা আরও বেশি করে হতে থাকে। দুজনের মানসিক নৈকট্য বাড়ে।
আত্ম-সমালোচনার সুযোগ
যদিও দূরত্ব একে অপরের জীবনে নিয়ে আসে শূন্যতা। তারপরও এই দূরত্বই আবার আত্ম-সমালোচনার রাস্তা খুলে দেয়। নিজের ভুলগুলো নেড়েচেড়ে দেখার অবসর পাওয়া যায়। গভীরভাবে অনুধাবন করা যায় পারষ্পারিক চাহিদাগুলো।
নিবিড় সময় ও সম্পর্ক
যেহেতু সঙ্গীকে নিয়মিত এবং সহজে দেখার সুযোগ পাওয়া যায় না, তাই একসাথে কাটানোর প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে ওঠে মূল্যবান। অনুপস্থিতির পরে দেখা ও সময় কাটানোর মুহূর্তগুলোর কথা ভেবে আগেই তৈরি হয়ে যায় পরিকল্পনা। হিসেব-নিকেশ, ঘোরাফেরা সবকিছুর একটি খসড়া ছক সম্পর্ককে করে তোলে নিবিড়তম।
প্রতিশ্রুতির প্রতি করে তোলে যত্নবান
দূরত্বের সম্পর্ক বা ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার মনোভাব আরও দৃঢ় করতে সাহায্য করে। কারণ এ ধরনের সম্পর্কে যোগাযোগের কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও সময় মেনে চলতে হয়। এটির জন্য নির্ভর করতে হয় ফোন কল, টেক্সট মেসেজ বা ভিডিও কলে। আর এসবই চলে মৌখিক প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে। অনেকেই জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে এর অনুবাদ করতে পারেন।
যৌথ এবং পৃথক, উভয় জীবনে করে তোলে অভ্যস্ত
একসাথে থাকা দুজন মানুষের মধ্যে একজনকে যদি কোনও কাজে কিছুদিন বাইরে থাকতে হয়, তাহলে শুরুতে মানিয়ে নিতে কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে একা থাকার অভ্যাস তৈরি হয়। একাকিত্বের এ সময়টুকুতেই আবার চিন্তাভাবনা করে দাম্পত্যের ক্ষতগুলোকে খুব দ্রুত সারিয়ে নেওয়া যায়।
ডিসট্যান্স রিলেশন মানেই সম্পর্কে প্রতিবন্ধকতা নয়। উলটো কখনো কখনো এ ধরনের সম্পর্ক দাম্পত্যে নিয়ে আসতে পারে বৈচিত্র্য।
তবে এ ধরনের সম্পর্কে ওঁৎ পেতে থাকে নানান নেতিবাচকতা। কু-মন্ত্রণা দেওয়ার লোকেরও তখন অভাব পরেনা। তাই থাকতে হয় অতিরিক্ত সতর্ক। এমন সম্পর্কের সংকট মোকাবেলায় আপনার বিশ্বস্ত বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যের সহযোগীতা নিন। তবে সবচেয়ে ভালো এবং নিরাপদ হলো বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া।