Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫
Beta
রবিবার, ১৮ মে, ২০২৫

তামাকে বিষাক্ত শৈশব

হারাগাছ ঘুরে বিভিন্ন বিড়ি কারখানার বাইরে ‘শিশুশ্রম মুক্ত প্রতিষ্ঠান’ সাইন বোর্ড টাঙানো পাওয়া যায়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
হারাগাছ ঘুরে বিভিন্ন বিড়ি কারখানার বাইরে ‘শিশুশ্রম মুক্ত প্রতিষ্ঠান’ সাইন বোর্ড টাঙানো পাওয়া যায়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

শিশুরা খেলাধুলা করবে, পড়াশোনা করবে- শৈশব হবে আনন্দের। রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছের অনেকে এমন শৈশব পাচ্ছে না। তাদের একটা বড় সময় চলে যাচ্ছে বিড়ি তৈরির কাজে। কোনও কোনও শিশুর কাছে বিষয়টি ‘রুটিন ওয়ার্ক’ এর মতো।  

হারাগাছ বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্র জানিয়েছে, এ এলাকায় প্রায় ৬০-৭০ বছর ধরে বিড়ি তৈরির কাজ চলছে। রহিম উদ্দিন ভরসা ও করিম উদ্দিন ভরসার হাত ধরে এই এলাকায় বিড়ি কারখানার যাত্রা শুরু। বর্তমানে ছোট-বড় মিলে প্রায় ২০০ বিড়ি কারখানা আছে। এসব কারখানায় শ্রমিক প্রায় ২ লাখ।

সম্প্রতি হারাগাছ ঘুরে বিভিন্ন বিড়ি কারখানার বাইরে ‘শিশুশ্রম মুক্ত প্রতিষ্ঠান’ সাইন বোর্ড টাঙানো দেখতে পাওয়া যায়। এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কারখানা পরিদর্শন করতে চাইলেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। নিরাপত্তারক্ষীদের ভাষ্য ছিল অনেকটা এমন- “ভেতরে যাওয়া যাবে না, সমস্যা আছে। মালিকের আদেশ নাই। এখানে কোনও শিশু কাজ করে না।”

তবে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিড়ি তৈরিতে বড় ভূমিকা পালন করে শিশুরাই। বিড়ি তৈরির শুরু থেকে শেষ অবধি তারা যুক্ত। দরিদ্র পরিবারের আর্থিক সাহায্য হয় বলে তাদের এ কাজ না করার কোনও উপায় থাকে না। এসব শিশুও এই কাজে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। প্রতিদিন সকালে ওঠা, নাস্তা করা, স্কুলে যাওয়া ও পড়াশোনা করা যেমন এদের রুটিনের মধ্যে পড়ে, তেমন রুটিনের মধ্যে পড়ে বিড়ি তৈরি করা।

স্থানীয়রা আরও জানিয়েছে, বিড়ি কারখানাগুলোর মূল শ্রমিক শিশুরা হলেও রেকর্ড খাতায় তাদের নাম থাকে না, থাকে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের নাম। প্রতিদিন একেকটি পরিবার বিড়ি ৫-৬ হাজার তৈরি করে। বিড়ি তৈরির কাজ করা হয় দুই ভাবে। প্রথমে চার কোণা কাগজ দিয়ে বিড়ির বডি তৈরি করা হয়। তারপর সেই ফাঁকা বিড়ির মাঝে তামাকের গুঁড়া দিয়ে বিড়ির মুখ মুড়িয়ে দেওয়া হয়। এখানেই কাজ শেষ নয়। এরপর ছোট ছোট পলিথিনে ২৫টি করে বিড়ি ঢুকিয়ে মুখ আগুনে পুরিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসব কাজের বড় অংশই করে শিশুরা।

হারাগাছ ঘুরে জানা যায়, কারখানাগুলো বিকালে বিড়ি তৈরির উপাদান তুলে দেয় বিড়ি শ্রমিকদের হাতে। শ্রমিকরা উপাদান বাসায় নিয়ে কাজ শুরু করে। শেষ বিকাল থেকে বিড়ির বডি তৈরি করতে অনেক সময়ই রাত ৯টা থেকে ১০টা বেজে যায়। বিকালে খেলা বন্ধ করে বাড়ির বয়স্কদের সঙ্গে শিশুরাও লেগে যায় বিড়ি তৈরির কাজে। যেখানে সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় দেড় থেকে ২ ঘণ্টা সময় দিতে হয় বিড়ি তৈরির কাজে। পরদিন দুপুরে খালি বিড়িতে তামাক ভরতে হয়। এক্ষেত্রে কাজ করে বেশিরভাগ কিশোর, যাদের বয়স ১৫-১৬ বছর।

বিড়ি শ্রমিকরা বলছে, কাজ করার সময় তামাকের গুঁড়ো নাকে-মুখে ঢোকেই। তবে দীর্ঘদিন কাজ করায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় ‘সমস্যা হয় না’ বলে মনে করছে তারা।

হারাগাছের হরিনটারী এলাকার ১৩ বছর বয়সী সখিনা (ছদ্মনাম) জানায়, সে দিনে ৩-৪ হাজার বিড়ির মুখ বন্ধ করে। এসময় তামাকের গন্ধ নাকে যায়।

ছোটবেলা থেকে বিড়ির কাছাকাছি থাকায় শারীরিক সমস্যা বুঝে উঠতে পারে না বলে জানায় এই শিশু।

হরিনটারী এলাকার মধ্যবয়সী মোজেনা বেগম বলেন, “যখন বিড়ি ঢিকাই (বিড়িতে তামাক ভরা) তখন তাংকুর ধুলা তো নাকত ঢোকে। কয়েকদিন আগত তো শ্বাস কষ্টও হচিল। অনেক টাকার অসুধ খায়্যা এ্যালা ভালো আচুঁ। কী করমো বিড়ি বানাইলে এ্যাকনা হতোত টাকা আইসে। পান-গুয়ার টাকা হয়, সংসারত কি টাকা আটে? বিড়ি না বানাইলে কোনটে টাকা পামো?”

একই এলাকার মজিবর মিয়া সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তামাকের খুব ধক। একবার তো মইরবার ধরছিনু। এইজন্যে এ্যালা আর বিড়ি ঢিকবার যাবার পাওনা।”

হারাগাছ পৌরসভার মেয়র এরশাদুল হক এরশাদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দেখেছি অনেক মা দুধের শিশুকে পাশে শুইয়ে রেখে বিড়ি ঢিকায়। এতে চরম ক্ষতি হয় বাচ্চাটার। বিড়ি মালিকরাই এর জন্য দায়ী। তারা লাভবান হচ্ছে। কিন্তু শ্রমিকের কাজ করার পরিবেশ দিতে পারছে না।”

বিড়ি শিল্পে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. ওয়াজেদ আলী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এ ধরনের কাজে যেসব শিশু জড়িত, তাদের সহজেই ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, হাঁপানি, অ্যালার্জি এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। এসব কাজ থেকে শিশুদের দূরে রাখা উচিৎ।”

বিড়ি তৈরিতে যুক্ত সবাইকে মাস্ক ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. মো. ওয়াজেদ আলী।

মেয়র এরশাদুল বলেন, “বিড়ি কারখানাগুলোতে ৭০ শতাংশ শিশু শ্রমিক কাজ করছে। কিন্তু কোনও বিড়ি কারখানায় আপনাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। মালিকেরা বলছে, শিশু শ্রমিক নেই। কিন্তু অধিক লাভের আশায় তারাই শিশুদের ব্যবহার করছে। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাও এখানে শিশুশ্রমকে বাড়াচ্ছে।”

শিশু সন্তানদের দিয়ে টাকা আয়ের পরিবর্তে তাদের পড়ালেখার প্রতি অনেক অভিভাবক এখন বেশি নজর দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।

তাদের একজন হরিনটারী এলাকার ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সবুজ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিড়ি শিল্পে শিশুরা এখন কম কাজ করছে। অভিভাবকরা সন্তানকে স্কুলে পাঠাচ্ছে বেশি। কারণ বিড়ির টাকা দিয়ে এখন আর সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছে না। আধুনিক জীবনের সঙ্গে তাল মেলাতে শিক্ষার বিকল্প নেই।”

হারাগাছ বিড়ি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও হরিণ বিড়ির মালিক তরিকুল ইসলাম ডিনারের দাবি, তাদের সমিতিভুক্ত কারখানায় শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিছু কোম্পানির বিড়ির কাজ বাড়িতেও হয়। সে কাজে শিশুরা যুক্ত থাকতে পারে।

তিনি বলেন, “বিড়ি শিল্পে খুব ভারী কাজ করতে হয়, তা কিন্তু নয়। জর্দায় যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, তা বিড়িতে ব্যবহার করা হয় না। জর্দা বা সিগারেটের থেকে বিড়ি শিল্পে কম স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আমাদের কারখানায় শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করেছি। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

“তারা পড়ালেখা করে বড় কিছু হবে, আমরাও স্বপ্ন দেখি। আমাদের ফ্যাক্টরিতে বিড়ির কাজ সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু কিছু নিম্নমানের বিড়ি আছে, যেগুলোর কাজ বাড়িতে করে। সেগুলো হয়তো শিশুরা করে থাকে। সেটার দায় তো আমরা নিতে পারব না।”

বিড়ি কারখানায় শিশুশ্রম পরিস্থিতি নিয়ে সকাল সন্ধ্যা কথা বলেছে আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর, রংপুরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সাদেকুজ্জামানের সঙ্গে।

তিনি বলেন, “আমরা বিভিন্ন কারখানায় গিয়ে দেখছি শিশুশ্রম হচ্ছে কি না। বিড়ি কারখানাগুলোকে হুঁশিয়ার করা হয়েছে। আমরা আবারও সেখানে অভিযান চালাব। ধরা পড়লে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর, রংপুরের উপ-পরিচালক জানান, শিশুশ্রম আইন অনুযায়ী দুই পক্ষই অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা, অনাদায়ে কাজের ধরন দেখে ৩ মাস, ৬ মাস, ৯ মাস সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত