তিস্তা প্রকল্প ভারতই পাবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চীন সফর নিয়ে রবিবার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে একথা জানান তিনি।
২০১১ সালের পর থেকে তিস্তার পানি একতরফা প্রত্যাহার করছে ভারত। এমনকি অভিন্ন নদীর বিষয়ে আন্তর্জাতিক রীতি না মেনে পানি সরাতে গত বছর উজানে আরও দুটি খাল খননের উদ্যোগ নেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
ভারতের জলপাইগুড়ি এলাকা দিয়ে লালমনিরহাট হয়ে বাংলাদেশে ঢোকা তিস্তা শুষ্ক মৌসুমে ভারতের উজানে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের কারণে প্রায় শুকিয়ে যায়। আবার বর্ষাকালে যখন নদী উপচে পড়ে, তখন বাংলাদেশে ঘন ঘন বন্যা দেখা দেয়। বর্ষাকালে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রায়ই পানির চাপ কমাতে গজলডোবা ব্যারেজে ফ্লাডগেট খুলে দেয়।
প্রধানমন্ত্রীর এই চীন সফরে তিস্তার বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে বলে কূটনৈতিক মহলে আলোচনা ছিল। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তিস্তা প্রজেক্টটা আমাদের করতে হবে। চীনও আমাদের কাছে কিছু অফার দিয়েছিল।
“তাদের ফিজিলিবিটি স্টাডি করেছে। ইন্ডিয়াও আমাদের কাছে অফার দিয়েছে। ইন্ডিয়াও ফিজিবিলিটি স্টাডি করবে। এটা করার পরে, যেটা আমাদের জন্য যুক্তিযুক্ত হবে, আমরা সেটা নেব।”
পানির অপ্রাপ্তি ও বন্যার সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করে ২০১৯ সালে চীনের সহায়তা চায়। চীন এই প্রকল্পে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়।
ইতোমধ্যেই প্রকল্পটির জন্য তিস্তা এলাকায় একটি সমীক্ষা সম্পন্ন করে চীন আনুষ্ঠানিক প্রকল্প প্রস্তাবও জমা দিয়েছে। চীনের ওই বিনিয়োগমূলক অর্থায়ন প্রস্তাব ঝুলে থাকার মধ্যেই তাতে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।
সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রস্তাবের পক্ষে থাকার যুক্তি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “চীন তো রেডি। কিন্তু আমি চাচ্ছি যে এটা ইন্ডিয়া করে দিক। এই প্রজেক্টটা করলে এই প্রজেক্টটার জন্য যা দরকার, ইন্ডিয়া দিতেই থাকবে। ঠিক আছে? যা সাফ সাফ কথা, রাখা ঢাকা নাই।
“কারণ তিস্তার পানিটা ইন্ডিয়াই আটকে রেখেছে, কাজেই তাদের কাছ থেকে আমাদের যদি আদায় করতে হয়, প্রজেক্টের কাজ তাদেরই করা উচিত। তারা প্রজেক্ট করে আমাদের যা প্রয়োজন তারা দেবে। এটা তো একটা ডিপ্লোমেসি। এখানে আর কোনও দ্বিধা থাকার তো কথা নয়।”
তিস্তা প্রকল্প বহু আগের প্রকল্প জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার যতটুকু মনে পড়ে, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ছিল, আওয়ামী লীগের ইশতেহারে অনেকবার ছিল।”
‘আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্টের ওপর হামলা কেন?’
সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পর ওপর হামলার প্রসঙ্গেও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুরুতেই ওই ঘটনাকে অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, “তিনি একজন প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেট। তার ওপর এ ধরনের হামলা করা, আমি এর নিন্দা জানাই অবশ্যই।”
তিনি বলেন, “সেখানে বিপক্ষের একজনকে এভাবে গুলি করা, তাও আবার একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট, অল্পের জন্য বেঁচে গেছে কিন্তু। তার একেবারে কানের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, যদি একটু এদিক ওদিক হতো, সে আর বাঁচতো না।”
আমেরিকার মতো জায়গায় হয় এটা কীভাবে হয় সে প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, “আমেরিকার মতো সভ্য দেশে, যারা গণতন্ত্রের এত বড়…নিরাপত্তা, সেই দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে কেন, সেটাওতো আমাদের একটা প্রশ্ন। একজন প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেটকে এভাবে হামলা করা, তারা এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।”
“বাংলাদেশে হলে তো সরকারকে দায়ী করত”, যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
এরপর নিজ দেশের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “এক গ্রুপ সরকারকে দায়ী করতো, আরেক গ্রুপ যেমন …আমি শরীরে গ্রেনেড নিয়ে নিজেই মারছি…বলে দিল, বলার তো কোনও লাগাম নাই, লাগামছাড়া। ওরাও যেমন সরকারকে দায়ী করেনি, তেমনি প্রেসিডেন্ট বাইডেনও এর নিন্দা করেছেন।
“এইটুকু সভ্যতা তাদের আছে। তাই আমার মনে হয় যারা এই দেশে কথায় কথায় ..তাদেরও এখান থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। তবে অবশ্যই এই ঘটনা খুবই দুঃখজনক।”
‘পেনশন স্কিম নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা শিক্ষকদের’
সংবাদ সম্মেলনে পেনশন স্কিম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দুয়েকটা বক্তব্যের সঙ্গে একমত হলেও তা নিয়ে তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি থাকার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রশাসন ও শিক্ষকদের মুখোমুখি করার একটা চেষ্টা হচ্ছে কি- এমন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তাদের যে দাবিদাওয়া ছিল সেটা তারা পাঠিয়েছে। সেখানে তাদের কিছু ভ্রান্ত ধারণাও আছে। সেগুলো আমি সমস্ত পড়েছি, এবং মার্ক করা রয়েছে। সব লেখা রয়েছে আমার, সেগুলো আমরা দিব।
“তাদের একটা ভুল ধারণা যে একটা পেনশন ফান্ড রয়েছে, পেনশন ফান্ড বলে কিছু নাই। পেনশনটা দেওয়া হচ্ছে, একেবারেই যারা ট্যাক্স পেয়ার তাদের টাকা থেকে। পেনশন নিয়ে তাদের ধারণাটা এত বিভ্রান্তকর…আন্দোলন যখন তারা চালাবেই, তখন চালাতে থাক, চালাতে চালাতে যখন টায়ার্ড হবে, তখন বলব। তার আগে বলার দরকারটা কি?”
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “তাদের অনেকগুলো ভুল ধারণা। এখন এত বিস্তারিত বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। পেনশন নিয়ে তাদের ধারণাটা এত বিভ্রান্তিকর, যে তারা…এর মধ্যে দুয়েকটা জিনিস আছে, ২৪ না ২৫, ওটা ঠিক করে দেওয়া যাবে, এটা কোনও ব্যাপার না।”
সংবাদ সম্মেলনে নিজের টেবিলে থাকা কিছু কাগজ দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তাদের যে দাবিদাওয়া ছিল, সেটা তারা পাঠিয়েছে। সেখানে বেশকিছু ভ্রান্ত ধারণাও তাদের আছে। ইতোমধ্যে দুটো পেপার আমার পড়া। এখন আর এর মধ্যে এটা তুলতে চাই না। আমার এখানে লেখাও আছে, আমি নিয়েও আসছি। এখন আমি বলব না।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা যেটা করতে চাচ্ছি, সর্বজনীন পেনশন স্কিম করে দিয়েছি সকলের জন্য। আমরা সর্বজনীন স্কিম করে দিয়েছি। এই যে সাংবাদিকরা, আজকে কারও চাকরি গেলে কাল তার কিছু করার নেই। তখন সে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে? সেইক্ষেত্রে এটা আরম্ভ করা।
করোনার টিকা প্রসঙ্গ
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী করোনা মহামারির সময়ে টিকা কেনা নিয়েও কথা বলেন।
তিনি বলেন, “দুর্নীতি তো এমন পর্যায়ে ছিল কোনও কাজই করা যেত না। সেখান থেকে ধীরে ধীরে একটা পর্যায়ে নিয়ে এসছি। আর কোভিডের সময় এ বিষয়টা ছিল। সত্যি কথা বলতে গেলে কিছু নিয়ম আছে, টেন্ডার দাও, সরকারি জিনিস কিনতে গেলে। কিন্তু ওইগুলো করতে গেলে রোগী বাঁচাতে পারতাম না।
“তখন আমি করলাম কী, কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তখন। আমার এখন সিরিঞ্জ কিনতে হবে, এখন যদি আমি টেন্ডার দিয়ে যাই তাহলে ভ্যাকসিন দেব কবে? আমি সোজা প্লেন পাঠিয়ে দিয়েছি, কোথায় (ভ্যাকসিন) পাওয়া যায়? ছোট সিরিঞ্জ লাগবে, পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় বড়টা, কিন্তু দাম বেশি।
“বললাম, হোক (দাম বেশি), আমার এক্ষুণি দরকার। কাজেই আমাকে আনতে হবে। আমি তিনদিনের মধ্যে প্লেন পাঠালাম, যা কেনার কিনে পাঁচদিনের মধ্যে চলে এলাম। এখন যদি ওখানে দুর্নীতি ধরতে চান, ধরতে পারেন।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমি ব বললাম…আগে টাকা দিয়ে বুকিং দিতে হবে। টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি, তুমি বুকিং দাও। আমি বুকিং দেওয়লালাম। ভ্যাকসিন রাখার জন্য ফ্রিজার দরকার, যা ছিল সেটা যথেষ্ঠ ছিল না। এখন কিনতে হবে, কিন্তু টেন্ডার দিয়ে কিনতে গেলে কত সময় লাগবে?
“সোজা অনলাইনে বুকিং দিয়ে প্লেনে করে চলে আসবে। স্যানিটাইজার আনতে হবে, পিপিপি তৈরি করতে হবে। আমিতো এভাবে কাজ করেছি। এখন যদি সবজায়গায় দুর্নীতি ধরেন তাহলে সব জায়গায় দুর্নীতি ধরতে হবে।”
সচিবালয় থেকে গোপনে এক সাংবাদিকের নথি নেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সাংবাদিকদের তথ্য জোগাড় করা এক জিনিস, আর ফাইল চুরি করা আরেক জিনিস।
“আমি ভ্যাকসিন কিনব, আমার সেখানে নেগোসিয়েশন হচ্ছে, জরুরি পেপার। আমার অফিসাররা দিনরাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে। ফাইলটা রেখে কেবল একটু বাইরে গেল আর ওমনি আপনাদের এক স্বনামধন্য পত্রিকার সাংবাদিক ঢুকে সেই কাগজ চুরি করতে গেল। “সে যে ফাইল চুরি করতে গেল, এটা কোনও অপরাধ না। এরপর তাকে ফাইল চুরির জন্য পুরস্কার দিয়ে দিল বড় একটা দেশ? এটা কি দুর্নীতি, চুরি ডাকাতি কোনটা? কী ডেফিনেশন দেবেন আমাকে আপনারা? এরপর হিরো হয়ে যায়। আর আমরা তো জিরো আছিই।”