Beta
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫

দাউদ ইব্রাহিম কি বেঁচে আছেন

সম্প্রতি মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিম কাস্করের মৃত্যুর গুঞ্জন ওঠে। ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিম কাস্করের মৃত্যুর গুঞ্জন ওঠে। ছবি: সংগৃহীত
[publishpress_authors_box]

মুম্বাইয়ের এক বহুতল ভবনের নিচে দাঁড়িয়ে একদল পুলিশ। তাদের চোখ ভবনটির উপরের দিকের এক ফ্ল্যাটে। মাইকে পুলিশ কর্মকর্তা আত্মসমর্পণ করতে বলছেন এক মাফিয়া ডনকে। কিন্তু তিনি পাত্তাই দিচ্ছেন না। যেখানে তাকে ধরতে দীর্ঘদিন ধরে লেগে আছে একটি, দুটি নয়, ১১টি দেশের পুলিশ। এতটাই চতুর ও আত্মবিশ্বাসী তিনি। পুলিশ ভবন ঘিরে রাখলেও রয়েছেন নির্বিকার। বলছিলেন, “ডন কো পাকাড় না মুশকিলই নেহি, নামুমকিন হ্যায়।” যার বাংলা-“ডনকে ধরা শুধু মুশকিলই না, অসম্ভবও।”       

পাঠক হয়ত বুঝে গেছেন, বলিউডের জনপ্রিয় সিনেমা ডনের দৃশ্য এটি। ডন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন। 

পুলিশের চোখকে ধুলো দিয়ে বেড়ানো এমন চরিত্র যে কেবল রুপালি পর্দায় থাকে, তা নয়। বাস্তবেও থাকে। এমনই একজন দাউদ ইব্রাহিম কাস্কর। যাকে ধরতে দশকের পর দশক ধরে হিমশিম ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের বাঘা বাঘা গোয়েন্দারা। 

জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে যোগাযোগ থাকার অভিযোগে ২০০৩ সালে দাউদ ইব্রাহিমকে সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। ১৯৯৩ সালে মুম্বাইয়ে সিরিজ বোমা হামলার পরিকল্পনা তিনি করেন বলে সন্দেহ করা হয়। 

সেই বছর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দাউদ ইব্রাহিম। ভারতের দাবি, তিনি পাকিস্তানের করাচিতে থাকেন। পাকিস্তান বরাবরই এই দাবি নাকচ করে আসছে।

দাউদ ইব্রাহিম সম্প্রতি ফের খবরের শিরোনাম হন। বলা হচ্ছিল, তিনি হয়ত বেঁচে নেই। তাকে কি বিষ খাইয়ে মারা হয়েছে? তিনি কি করাচির হাসপাতালে ভর্তি? -নেটিজেনদের এসব প্রশ্নে সয়লাব ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। 

অবশ্য এবারই প্রথম নয়। গত ১০ বছরে কমপক্ষে তিনবার দাউদ ইব্রাহিমের মৃত্যুর খবর শোনা গেছে, যেগুলো নিছকই গুজব। 

গত মাসে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি করা হয়, ৬৭ বছর বয়সী এই মাফিয়া ডনকে তার দলেরই একজন বিষ খাইয়েছেন করাচিতে। তাকে শহরটির হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, অবস্থা সংকটাপন্ন। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ হাসপাতালটির নিরাপত্তা জোরদার করেছে। 

এসব দাবি আরও জোরাল হয় ১৮ ডিসেম্বর। সেদিন পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান আনোয়ারুল হক কাকারের নামে এক এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্ট থেকে তার মৃত্যু নিয়ে পোস্ট দেওয়া হয়। সেখানে দাউদের আত্মার শান্তি কামনা করা হয়। ওই পোস্টের স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়। 

এর আগে ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানি এক ইউটিউবার গভীর রাতে এক ভিডিওতে দাবি করেন, দাউদ ইব্রাহিমকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে, তিনি হাসপাতালে ভর্তি। এ কারণে ইন্টারনেট বন্ধ।

বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন তিনি ভিডিওটিতে ব্যবহার করেন। প্রতিবেদনগুলো তিনি যাচাই করেননি।

১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় নেটিজেনদের সন্দেহ জোরাল হয়।    

ভারত বা পাকিস্তান শুরুতে এ বিষয়ে একেবারেই চুপ ছিল। দাউদ ইব্রাহিমের মৃত্যুর সত্যতা নিয়ে মানুষের আগ্রহ যখন তুঙ্গে, সে সময় তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ‘ছোটা শাকিল’ জানালেন, মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীকে বিষ খাওয়ানোর দাবি একেবারেই ভুয়া। 

ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির ফ্যাক্ট চেক দল জানায়, পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান তার এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে দাউদ ইব্রাহিমের মৃত্যু নিয়ে কোনো পোস্ট দেননি। 

নেটিজেনরা যে স্ক্রিনশট দেদারসে শেয়ার করেন, সেটি আসলে আনোয়ারুল হক কাকারের নামে খোলা ভুয়া একটি অ্যাকাউন্ট। পাকিস্তানের তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও জানানো হয়, আনোয়ারুল হক কাকার শীর্ষ সন্ত্রাসীর মৃত্যু সংক্রান্ত কোনো বক্তব্য দেননি। 

পাকিস্তানি ইউটিউবারের দাবি উড়িয়ে দেয় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাও। তারা বলে, এটা ঠিক, ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানে কয়েক ঘণ্টা ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। তবে এর কারণ দাউদ ইব্রাহিমের মৃত্যু নয়। 

সেদিন বিকেলে পাকিস্তানের বিরোধী দল তেহরিক-ই-ইনসাফের ভার্চুয়াল বৈঠক ছিল। সেটি বিঘ্নিত করতেই ৭ ঘণ্টা ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। 

সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা লন্ডনভিত্তিক সংগঠন নেটব্লকস জানিয়েছে, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফের কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত করতে মাঝেমধ্যেই ইন্টারনেট বন্ধ করছে সরকার। ১৭ ডিসেম্বরও তারা এই কাজ করে।  

ভারতের একাধিক সংবাদমাধ্যম নিশ্চিত করেছে, মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের মৃত্যু হয়নি।   

অপরাধ জগতের এই ব্যক্তিকে নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। কে এই দাউদ ইব্রাহিম? কেনই বা তাকে খুঁজছে গোয়েন্দারা? তাকে নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানে এত আলোচনা কেন?         

দাউদের শৈশবের মুম্বাই  

ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি জেলায় ১৯৫৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর দাউদ ইব্রাহিমের জন্ম। তার বাবা ইব্রাহিম কাস্কর ছিলেন পুলিশ কনস্টেবল। মা আমিনা বাই গৃহিণী। ইব্রাহিম-আমিনা দম্পতির আরও ১১ সন্তান ছিল। 

ষাট থেকে আশির দশকের শুরু পর্যন্ত মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বাইয়ে ছিল তিন মাফিয়া ডনের রাজত্ব। এদের একজন সুলতান মির্জা, যিনি শহরটিতে আসেন তামিল নাড়ু থেকে। 

মুম্বাইয়ের বন্দরে কুলির কাজ করতেন সুলতান মির্জা। একপর্যায়ে অন্য কুলিদের সঙ্গে নিয়ে তিনি সোনা, ইলেকট্রনিক্সসহ বিভিন্ন সামগ্রী চুরি করে কালোবাজারে বিক্রি করতেন। দ্রুতই অর্থের মুখ দেখেন সুলতান মির্জা। 

সেই অর্থে হজে যান। ফেরার পর সুলতান মির্জা হাজি মাস্তান নামে বেশি পরিচিত হতে থাকেন। ‘ব্যবসার’ নাম যায় পাল্টে। চোরাচালানের কারবার হয়ে যায় আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা।  

হাজি মাস্তান শৌখিন ছিলেন। প্রায়ই বাড়িতে ভোজের আয়োজন করতেন। আমন্ত্রিতদের মধ্যে থাকতেন শিল্পপতি, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বলিউডের সুপারস্টাররা।

মুম্বাইয়ের অপরাধ জগতের আরেক মাফিয়া ডন ছিলেন করিম লালা। গত শতকের বিশের দশকে আফগানিস্তান থেকে মুম্বাইয়ে আসেন তিনি। গড়ে তোলেন পাঠান গ্যাং। 

অভিযোগ আছে, ভারতের উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল শিব সেনার প্রতিষ্ঠাতা বাল ঠাকরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল হাজি মাস্তানের দোসর করিম লালার।            

হাজি মাস্তান আর করিম লালার সম্মিলিত শক্তিতে আতঙ্কে থাকতেন মুম্বাইয়ের বাসিন্দারা।        

হাজি মাস্তান যেসব কাজ করতে চাইতেন না, সেসব করত করিম লালার পাঠান গ্যাং। এগুলোর অন্যতম চরস-আফিমের কারবার, জুয়া, অপহরণ ও জমি দখল। 

মুম্বাইয়ে হাজি মাস্তান-পাঠান গ্যাংয়ের রাজত্বের সময়ই রত্নগিরি থেকে শহরটিতে বদলি হয়ে আসেন দাউদ ইব্রাহিমের বাবা ইব্রাহিম কাস্কর। পরিবার নিয়ে মুম্বাইয়ের ডোংরি এলাকায় থাকতেন তিনি।  

সৎ পুলিশ সদস্য হিসেবে খ্যাতি ছিল তার। হাজি মাস্তান আর পাঠান গ্যাংকে আইনের আওতায় আনতে চেয়েছিলেন তিনি। পারেননি। বরং তার ছেলে দাউদ ইব্রাহিম হয়ে ওঠেন হাজি মাস্তান ও করিম লালার চেয়ে বড় সন্ত্রাসী।      

দাউদ ইব্রাহিমের উত্থান 

ছোটবেলায় দাউদকে মুম্বাইয়ের আহমেদ সেলর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। সপ্তম শ্রেণিতে থাকতে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন তিনি। 

স্কুলে না গিয়ে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে মানুষের পকেট মারতেন, চুরি করতেন। এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় গিয়ে একে-ওকে মারধর করতেন। ইব্রাহিম কাস্কর ছেলের এসব কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।                       

চুরি-চামারি আর ছিনতাইয়ে হাত পাকানোর একপর্যায়ে স্থানীয় মাফিয়া ডন বাশু দাদার দলে যোগ দেন দাউদ ইব্রাহিম। সত্তরের দশকে সেই দল থেকে বেরিয়ে ডি-কোম্পানি নামে দল গড়েন। সঙ্গে রাখেন বড়ভাই শাবির ইব্রাহিম কাস্করকে। প্রধানত সোনা চোরাচালান, চাঁদাবাজি ও মাদক পাচারের কাজ করত ডি-কোম্পানি। 

আশির দশকে মুম্বাইয়ে মেট্রোপলিটন ব্যাংক থেকে ৪ লাখ ৭৫ হাজার রুপি লুট হয়। ঘটনাটি ব্যাপক আলোড়ন তোলে।  

ব্যাংক ডাকাতিটি হয় দাউদ ইব্রাহিমের নেতৃত্বে। ওই প্রথম তিনি সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হন। তার বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর। এত অল্প বয়সে দাউদ ইব্রাহিমের এমন কাজ হতবাক করে দেয় মুম্বাইয়ের দুই মাফিয়া ডন হাজি মাস্তান আর করিম লালাকে।  

ব্যাংক ডাকাতিতে জড়িতদের ধরতে যে দল গঠন করা হয়, দাউদ ইব্রাহিমের বাবা ইব্রাহিম কাস্কর ছিলেন সেই দলের সদস্য। 

দ্রুতই তিনি জানতে পারেন, ডাকাতির প্রধান সন্দেহভাজন তারই ছেলে দাউদ। সঙ্গে আছেন তার আরেক ছেলে শাবির। 

দুই ছেলের এমন অপরাধে জড়িয়ে পড়া মেনে নেওয়া কঠিন ছিল ইব্রাহিম কাস্করের। তিনি জানতেন, তার ছেলেরা পাড়ায় মাস্তানি করে, চাঁদাবাজি করে। তাই বলে ব্যাংক ডাকাতি! 

ব্যাংক ডাকাতির পর দুই ছেলে কোথায় লুকিয়ে আছে, তা তদন্তের একপর্যায়ে জানতে পারেন ইব্রাহিম কাস্কর। ছেলেদের কাছে ঘরে ফেরার বার্তা পাঠান।  

ভারতের অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও লেখক এস হুসেইন জাইদি ২০১২ সালে মুম্বাইয়ের মাফিয়া ডনদের নিয়ে একটি বই লেখেন। নাম ‘ডোংরি থেকে দুবাই: মুম্বাই মাফিয়ার ছয় দশক’।

বইয়ে তিনি বলেছেন, “দাউদ আর শাবির ঘরে ফিরলে তাদের মা বকাবকি শুরু করেন। সে সময় ইব্রাহিম তার মোটা চামড়ার বেল্ট নিয়ে ছেলেদের সামনে দাঁড়ান। পুলিশের মুম্বাই ক্রাইম ব্রাঞ্চের হেড কনস্টেবল হিসেবে যে বেল্ট গর্বের সঙ্গে কোমরে বাঁধতেন, সেটি দিয়ে দুই ছেলেকে মারতে শুরু করেন।”

হুসেইন জাইদি আরও লিখেছেন, “মারধরের পর দুই ছেলেকে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সামনে হাজির করেন ইব্রাহিম। ছেলেদের অপরাধের জন্য হাতজোড় করে ক্ষমা চান। অঝোরে পানি পড়ছিল তার চোখ দিয়ে। তার সততা দেখে দাউদ আর শাবিরকে ছেড়ে দেন কর্মকর্তারা।”     

বাবা ইব্রাহিম কাস্করের সঙ্গে দাউদ ইব্রাহিম। ছবি: সংগৃহীত

ছাড়া পেয়ে চুপচাপ বসে ছিলেন না দাউদ। তার নেতৃত্বে আগের মতোই কর্মকাণ্ড চলতে থাকে ডি-কোম্পানির। তখন তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল পাঠান গ্যাং। সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল এই দুই দলের। 

১৯৮১ সালে মুম্বাইয়ের সিদ্ধিবিনায়ক মন্দিরের উল্টো দিকে এক পেট্রোল পাম্পে দাউদের বড় ভাই শাবিরকে হত্যা করে পাঠান গ্যাং। এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শুরু হয় দুই দলের ভয়াবহ সংঘর্ষ। 

টানা দুই দশক মুম্বাইয়ের অলিগলিতে তাদের রক্তক্ষয়ী লড়াই চলে। ভাইয়ের হত্যাকারীদের সাজা দিতে মরিয়া ছিলেন দাউদ ইব্রাহিম।    

আশি ও নব্বইয়ের দশকে মুম্বাই শহরের অপরাধ জগতের সঙ্গে ধনী ও ক্ষমতাবানদের সম্পর্ক ছিল জটিল। রাস্তায় লাশ পড়ে থাকা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। দুর্নীতি আর ত্রাস শহরের আইন-শৃঙ্খলাকে হুমকির মুখে ফেলে। 

পুরো পরিস্থিতি দাউদের মতো উঠতি মাফিয়া ডনের জন্য ছিল অনুকূল। ভাইয়ের মৃত্যুর বদলা নিতে পাঠান গ্যাংয়ের সব সদস্যকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। 

১৯৮৩ সালে মুম্বাই দায়রা আদালতের বাইরে খুন হন শাবিরের হত্যাকারীদের একজন, আমিরজাদা নওয়াব খান। পরের বছর মুম্বাই হোটেলের বাইরে আরেক হত্যাকারী সামাদ খানকে গুলি করে মারা হয়। সামাদ ছিলেন করিম লালার ভাতিজা।  

নওয়াব ও সামাদ হত্যাকাণ্ডের পর মুম্বাই পুলিশ দাউদকে ধরতে উঠেপড়ে লাগে। একপর্যায়ে ১৯৮৬ সালে দুবাইয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন দাউদ। 

তার অবর্তমানে ডি-কোম্পানির দায়িত্ব নেন ‘ছোটা রাজন’। দলটির আকার বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। ডি-কোম্পানিতে তখন পাঁচ হাজারের বেশি সদস্য কাজ করত। 

নব্বই দশকের শুরুতে প্রতি বছর কোটি কোটি রুপি আয় করে ডি-কোম্পানি। অর্থপাচার, অস্ত্র চোরাচালান ও চাঁদাবাজি ছিল তাদের প্রধান কাজ। চলচ্চিত্র শিল্পেও তাদের বিনিয়োগ ছিল।

আশি ও নব্বইয়ের দশকে বলিউডের বেশ কয়েকটি স্টুডিও ও চলচ্চিত্র ডি-কোম্পানির অর্থে হয়। 

অভিযোগ আছে, বলিউডের প্রযোজক ও নামীদামী অভিনেতাদের ডি-কোম্পানি মাঝেমধ্যেই হুমকি দিত। প্রযোজক জাভেদ সিদ্দিক ও গুলশান কুমার হত্যাকাণ্ডে ডি-কোম্পানি জড়িত শোনা যায়।

মুম্বাইয়ে সিরিজ বোমা হামলা  

১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের অযোধ্যা শহরে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার পর ভারতের বিভিন্ন শহরে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা হয়। অনেক মুসলমান সেই দাঙ্গায় নিহত হন।

ওই ঘটনা দাউদকে বিচলিত করেছিল বলে ধারণা করা হয়।

মুম্বাইয়ের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনার রাকেশ মারিয়া এ প্রসঙ্গে তার আত্মজীবনী ‘লেট মি সে ইট নাও’- এ লিখেছেন, “বাবরি মসজিদের ঘটনায় মুম্বাইয়ের মুসলমানরা দাউদকে এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। দাউদ প্রথমে তাদের অনুরোধে সাড়া দেননি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কয়েকজন মুসলমান নারী দাউদের কাছে চুড়ি পাঠান।”

এরপরই দাউদ ইব্রাহিম মুম্বাইয়ে সিরিজ বোমা হামলার পরিকল্পনা করেন বলে ধারণা করা হয়। 

অভিযোগ আছে, ১৯৯৩ সালে মুম্বাই সিরিজ বোমা হামলার জন্য পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) সাহায্য নিয়েছিলেন দাউদ। আর দলের ভেতরে তাকে সাহায্য করেছিল ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছোটা শাকিল, ইয়াকুব মেমন, টাইগার মেমন ও আবু সালেম। আড়াইশর বেশি মানুষ ওই বোমা হামলায় নিহত হয়।

বোমা হামলায় জড়িত থাকার অপরাধে পরে ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি হয়। আবু সালেমের হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।  

আল কায়েদার পাশাপাশি পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার সঙ্গে দাউদ ইব্রাহিমের যোগাযোগ থাকার অভিযোগ রয়েছে হোয়াইট হাউজের। ৯/১১ এর হামলায় দাউদ ইব্রাহিম জড়িত বলেও সন্দেহ যুক্তরাষ্ট্রের। 

ভারতের সাবেক আইন ও বিচারমন্ত্রী রাম জেঠমালানি ২০১৭ সালে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, মুম্বাইয়ে সিরিজ বোমা হামলার পর লন্ডন থেকে দাউদ ইব্রাহিম তাকে ফোন করেন। তিনি বলেছিলেন, এক শর্তে ভারতে ফিরে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে প্রস্তুত। শর্তটি হলো, কারাগারে তাকে তৃতীয় শ্রেণির সুবিধা দেওয়া যাবে না। 

জেঠমালানি দাউদ ইব্রাহিমের প্রস্তাবটি মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শারদ পাওয়ারকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু দাউদের প্রস্তাবে সাড়া মেলেনি।

জেঠমালানি মনে করেন, দাউদ ইব্রাহিম দেশে ফিরলে রাজনীতিকরা স্বস্তিতে থাকতে পারতেন না। কারণ, তাদের অনেক গোপন তথ্য তিনি জানতেন। সেসব ফাঁস হওয়ার শঙ্কা ছিল। দাউদ ইব্রাহিমের ভারতে না ফেরাই তাদের জন্য ভালো ছিল।

ডি-কোম্পানির খপ্পর থেকে মুম্বাইকে মুক্ত করতে দুই দশক লেগে যায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এই সময় ‘এনকাউন্টারে’ নিহত হয় অন্তত নয়শ জন।

দাউদ ইব্রাহিম এখন কোথায়?

২০০৬ সালে পাকিস্তানের ক্রিকেটার জাভেদ মিয়াঁদাদের ছেলে জুনাইদ মিয়াঁদাদকে বিয়ে করেন দাউদ ইব্রাহিমের মেয়ে মাহরুখ ইব্রাহিম। 

২০১১ সালে দাউদ ইব্রাহিমের আরেক মেয়ে মেহরিনের সঙ্গে বিয়ে হয় এক পাকিস্তানি-আমেরিকানের। একই বছর দাউদের ছেলে মঈন বিয়ে করেন লন্ডনের এক ব্যবসায়ীর মেয়ে সানিয়াকে। 

ভাই ইকবাল ইব্রাহিম কাস্করসহ দাউদ ইব্রাহিম পরিবারের আরও সদস্য মুম্বাইয়ে বসবাস করছেন। 

তাহলে দাউদ ইব্রাহিম কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো খুব ভালোভাবেই জানেন বলে মনে করেন ভারতের সাংবাদিক ও লেখক হুসেইন জাইদি। 

২০১৯ সালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য কুইন্টকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “দাউদ কোন এলাকায় কত নম্বর বাড়িতে থাকেন, তা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অজানা নয়। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা একবার আমাকে এও বলেছিলেন যে, দাউদের ছেলে মঈন ধর্মকর্ম নিয়ে মেতে আছেন। বড় বড় দাড়ি রেখেছেন।

“দাউদের ছেলে কোথায় থাকেন, তার মেয়ে লন্ডনে কোন কলেজে পড়াশোনা করেন- এসব কিছুই গোয়েন্দারা জানেন। তার মানে দাউদ কোথায় আছেন, তাও তারা জানেন।”

রাজনীতিক রাম জেঠমালানির মতো সাংবাদিক হুসেইন জাইদিও মনে করেন, রাজনৈতিক নেতা, যারা দাউদ ইব্রাহিমকে বিভিন্ন সময়ে মদদ দিয়েছেন, তারা স্বাভাবিকভাবেই চাইবেন না তিনি দেশে ফিরুন।

দাউদ ইব্রাহিম কোথায় আছেন- তা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানে বলে রাম জেঠমালানি ও হুসেইন জাইদি মনে করলেও ভারত বরাবরই অভিযোগ করে আসছে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই তাকে দেশটিতে থাকতে সহযোগিতা করছে।

দাউদ ইব্রাহিমের একসময়ের সহযোগী ‘ছোটা রাজন’ ইন্ডিয়া টুডেকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “দাউদ ইব্রাহিম মাঝেমধ্যে পাকিস্তানের বাইরে গেলেও করাচিই তার ঘাঁটি।” 

ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র) ও ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) দাউদ ইব্রাহিমকে ধরতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

পাকিস্তানের করাচি শহরে তার অবস্থান বেশ কয়েকবার সনাক্ত করা হয়েছে বলে দাবি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা দুটির। 

র এবং আইবির দাবি ২০১৫ সালের আগস্টে জোরাল হয় যখন ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস নাও জানায়, দাউদ ইব্রাহিমের করাচির বাসভবনে ফোন দেওয়া হলে সেটি তার স্ত্রী ধরেন।

তার স্ত্রী টাইমস নাও-এর সংবাদকর্মীদের নিশ্চিত করে জানান, করাচির ওই বাড়িতে দাউদ ইব্রাহিম থাকেন। 

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এরপর দ্রুত দাউদ ইব্রাহিম সম্পর্কিত তথ্য-প্রমাণ জড়ো করে। ওই মাসে সেগুলো দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক বৈঠকে উত্থাপন করার কথা ছিল। ‘রাজনৈতিক কারণ’ দেখিয়ে সেই বৈঠক বাতিল করা হয়। 

তথ্যসূত্র: 

১. টাইমস অব ইন্ডিয়া

২. ইন্ডিয়া টুডে

৩. হিন্দুস্তান টাইমস

৪. এএফপি

৫. বিবিসি

৬. ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস

৭. ইকোনমিক টাইমস 

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত