দীর্ঘদিন পর নেতা-কর্মীদের সামনে দেখা দিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া; রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের এই সময়ে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে পদত্যাগের পর রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পাওয়ার পরদিন বুধবার ঢাকায় বিএনপির জনসভায় ভিডিওবার্তা নিয়ে আসেন খালেদা।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে একটি সমাবেশে বক্তব্য রাখেন তিনি। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুর্নীতির মামলায় দণ্ড নিয়ে তিনি কারাগারে যান। ২০২০ সালে নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেলেও বাসায়ই ছিলেন।
সরকারহীন অবস্থায় ধ্বংসযজ্ঞে প্রেক্ষাপটে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা ধ্বংস চাই না, শান্তি চাই। ছাত্র-তরুণরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তরুণদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে।”
ধ্বংস, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধপরায়নতা ছেড়ে গণতান্ত্রিক ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
হাসপাতাল থেকে খালেদার বক্তব্যের একটি ভিডিও ক্লিপ নয়া পল্টনে বিকালের এই সমাবেশে প্রচার করা হয়। প্রায় ৩ মিনিট তিনি কথা বলেন।
খালেদা জিয়া বলেন, “ছাত্র-জনতার বিজয় আমাদের নতুন সংগ্রামে নিয়ে এসেছে। যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-তরুণরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে, তাদের জন্য সেই সুন্দর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।”
যাদের ডাকে আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সেই নেতাদের ‘বীর’ আখ্যা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন। আন্দোলনে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি।
খালেদা বলেন, “বীর সন্তানেরা, যারা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। এই বিজয় নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
“ছাত্র-তরুণরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে। আসুন ছাত্র-তরুণদের হাত শক্তিশালী করি। ধ্বংস নয়, শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তরুণরা যে স্বপ্ন নিয় বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে মেধা, যোগ্যতা ও জ্ঞানভিত্তিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।”
সব ধর্মের ও গোত্রের অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি শান্তি, প্রগতি আর সাম্যের ভিত্তিতে আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে তরুণদের পাশে থেকে তাদের হাত শক্তিশালী করতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান খালেদা।
দেড় দশক পর কোনও রকম বাধা ছাড়াই নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করে বিএনপি। সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই সমাবেশে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঢল নামে। নয়া পল্টন থেকে কাকরাইল ছাপিয়ে শান্তিনগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয় সমাবেশ। ঢাকার বাইরে থেকে প্রায় ১০০ বাস ও প্রায় ৫০ এর বেশি ট্রাক নিয়ে সমাবেশে যোগ দেয় দলটির নেতা-কর্মীরা।
এতদিন পুলিশি বেষ্টনিতে সমাবেশ করে আসা বিএনপির এই সমাবেশে সেই দৃশ্য ছিল না। তবে সেনাবাহিনীর একটি টহল গাড়িকে কয়েকবার ঘুরে যেতে দেখা গেছে।
৩ মাসের মধ্যে নির্বাচন দাবি
সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে আগামী তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করার দাবি জানান।
তিনি বলেন, “ভাংচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ যারা করছে, এরা আন্দোলনকারী নয়, এরা দেশের শত্রু। এদের বিচার হবে।”
হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে ছাত্রদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিজয়কে সুসংহত করার আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।
ফখরুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে শুরুতেই বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান।
তারেক রহমান দেশবাসীকে ধর্ম-বর্ণ-পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঢাল হিসাবে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, “দেশের চলমান অর্জনকে নষ্ট করতে ষড়যন্ত্র চলছে। ধর্ম-বর্ণ-পরিচয় এর ঊর্ধ্বে উঠে সকলকে নিরাপত্তা দিতে হবে। যে যেখানে বসবাস করছেন সেখানে ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক না কেন, সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন।”
সারাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে মন্তব্য করে তারেক প্রশাসনের উদ্দেশে বলেন, “শক্ত হাতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করুন। প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। ধর্ম, বর্ণ কিংবা কোনও পরিচয়ে কারণে কেউ যেন নিরাপত্তাহীনতায় না থাকে, সবার আগে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।”
পুলিশ ‘জনগণের শত্রু’ নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা পুলিশকে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বাধ্য করেছিল। এখন একটি চক্র পুলিশের মনোবল ভাঙতে চেষ্টা চালাচ্ছে।
এখন বিএনপির নামে কেউ যদি অপকর্ম করলে তাকে আইনের হাতে তুলে দিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, “কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। বিচারের ভার দয়া করে নিজ হাতে তুলে নেবেন না। সমালোচনা বা নৈরাজ্যের সমাধান নৈরাজ্য হতে পারে না। প্রশাসনকে সময়োপযোগী করে গড়ে তোলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
নির্বাচনের দাবি জানিয়ে তারেক বলেন, “দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা স্থানান্তর করতে হবে।”
মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।