Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

নতুন বাড়িতে সাগরিকার ঈদ

Capture
[publishpress_authors_box]

এই তো দিন কয়েক আগের কথা। ঠাকুরগাঁওয়ের ছোট্ট শহরতলী রাণীশংকৈলের সাগরিকা তখনও আজকের সাগরিকা হয়ে ওঠেননি। প্রতিদিন সকাল আর বিকেলে ফুটবল নিয়ে অনুশীলনে যেতেন রাঙাটুঙ্গী ফুটবল একাডেমি মাঠে। কেউ সেভাবে ফিরেও তাকাতো না সাগরিকার দিকে। আর তাকাবেই বা কেন?

কিশোরী সাগরিকা তারকাখ্যাতি পাননি তখনও। ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ নারী দলকে সাফ চ্যাম্পিয়ন করানোয় বড় অবদান ছিল স্ট্রাইকার মোসাম্মৎ সাগরিকার। পাশাপাশি বয়সভিত্তিক সাফের সর্বোচ্চ গোলদাতা ও সেরা ফুটবলারের ট্রফিও জিতেছেন। স্মার্টফোন আর ইউটিউবের যুগে সাগরিকার নজরকাড়া পারফরম্যান্স মানুষের মুখে মুখে ফিরতে বেশি সময় লাগেনি। এবারের ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে সাগরিকা বেশ বুঝতে পারছেন, তিনি হয়ে উঠেছেন ছোট শহরের বড় ‘তারকা’। 

একে তো ফুটবল খেলার সুবাদে বাফুফে ভবনের ক্যাম্পে সারা বছর কাটে সাগরিকার। এর ওপর গত বছর ঈদ উল ফিতরের ছুটিতে বাড়ি যেতে পারেননি। মায়ের হাতের পোলাও মাংসও খাওয়া হয়নি। গত বছর ঈদের পরের দিন চড়তে হয়েছিল সিঙ্গাপুরের বিমানে। সিঙ্গাপুরে তখন এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্ব খেলতে গিয়েছিল বাংলাদেশ। যে কারণে চাইলেও সেবার ঈদ করতে বাড়ি যাওয়া হয়নি সাগরিকার।

কিন্তু এবার আগেভাগেই নারী ফুটবলারদের ছুটি দিয়েছে বাফুফে। ৩০ মার্চ ঢাকা থেকে ট্রেনে রানীশংকৈল পৌঁছাতেই ফুলেল সংবর্ধনা পেয়েছেন সাগরিকা।

মা-বাবার সঙ্গে দারুণ একটি ঈদ কাটবে সাগরিকার। ছবি : সংগৃহিত

জীবনের সেরা ঈদ সাগরিকার

সাগরিকার এবারের ঈদটা জীবনের সেরা ঈদ। সেটাও নানা কারণে। প্রথমত- কিছুদিন আগেও সাগরিকার বাবার কোনও টেলিভিশন ছিল না। মেয়ের ফুটবল দেখেছেন প্রতিবেশীর ধার করা টেলিভিশনে। এই সংবাদ সকাল সন্ধ্যায় প্রকাশিত হওয়ার পর ওয়ালটন কর্তৃপক্ষ সাগরিকার বাবা লিটন আলীকে উপহার দিয়েছে একটি টেলিভিশন। এরপর চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রত্যেক সদস্যকে আরও ১টি করে টেলিভিশন দেয় ওয়ালটন। যে টেলিভিশন পেয়েছে সাগরিকা নিজেও। মাস দুয়েক আগেও যাদের ঘরে কোনও টেলিভিশনই ছিল না, মেয়ের খেলার সুবাদে সেই ঘরেই কিনা দু-দুটো টেলিভিশন। হাসতে হাসতে সাগরিকা সকাল সন্ধ্যাকে বলেছেন, “আমার ছোট ক্যারিয়ারের স্মরণীয় স্মৃতি হয়ে থাকবে যে প্রথমবার বাড়িতে কিছু একটা নিয়ে আসতে পেরেছি। ওয়ালটনকে অনেক ধন্যবাদ।”

দ্বিতীয়ত, কদিন আগেও জীর্ণ ঘরে কাউকে বসতে দিতে পারতেন না সাগরিকার বাবা। কিন্তু তাদের জীর্ণ বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি তৈরি করে দিয়েছে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন। ঈদের আগেই যেখানে ‘গৃহপ্রবেশ’ হয়ে গেছে সাগরিকার।

এখন ভক্তদের আবদার মেটাতে হয় সাগরিকাকে। ছবি : সংগৃহিত

‘সেলিব্রেটি’ সাগরিকা

এলাকায় সাগরিকা রীতিমতো ‘সেলিব্রেটি’। নতুন অভিজ্ঞতার গল্পটা শুনুন সাগরিকার মুখেই, “আগে তো রাস্তা ঘাটে বের হলে কেউ তাকাত না। ফাইনাল খেলার পর এখন অনেকে চেনে। গুরুত্ব দেয় আমাকে। এখন বের হলেই অনেকে বলে, দ্যাখ সাগরিকা যাচ্ছে। ওরা বলে, অনেকে ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওর সঙ্গে কথা বলতে। আমরা সামনে থেকে দেখছি। অনেকে আমার খেলার ভক্ত, ওরা এসে ছবি তুলেছে।”

সঙ্গে আরও যোগ করেন সাগরিকা, “একদিন এক আপু এসে বলে, তোমাকে এতদিন শুধু টেলিভিশনে দেখেছি। ভাবতেও পারেনি সামনা সামনি দেখব। এরপর আমাকে দাঁড় করিয়ে সেলফি তুললেন। খুবই ভালো লাগে এগুলো দেখে। তবে যেন আরও ভালো কিছু করি, যেন আরও বেশি মানুষ চেনে, সেটাই চাই।” 

সাগরিকার বাবার টানাটানির সংসার। অন্যের জমিতে বসানো চায়ের টং দোকানের আয়ে সংসার চলে। ঈদে কখনও মেয়েকে উপহার কিনে দিয়েছেন। কখনও দিতে পারেননি। কিন্তু সেটা নিয়ে আফসোস নেই সাগরিকার, “আসলে বাবা মার সঙ্গে এবার ঈদ করতে পারছি। এতেই বেশি ভালো লাগছে। অনেক অভাব গেছে আমাদের। কিন্তু বাবা কখনও বুঝতে দেননি। শুধু ঈদের আগে বাবাকে বলে রাখতাম মেহেদি পরবো। বাবা ১টার বদলে ২টা মেহেদির প্যাকেট কিনে আনতেন।”

এএফসি চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বের প্রস্তুতির জন্য গত বছর এতটুকু অবসর পাননি সাগরিকা। ঈদের দিন সকালেও অনুশীলন করেছেন। যদিও ঈদের দিনে ক্যাম্পে ভালোমন্দ রান্না হয়েছিল। বাফুফের মহিলা কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ পাশে বসিয়ে খাইয়েছিলেন মেয়েদের। কিন্তু মায়ের হাতের রান্নার যে তুলনায় হয়না, “ক্যাম্পে ঈদের দিন অনেক মেনু থাকতো। পোলাও চিকেন থাকতো। কিরণ ম্যাডাম আমাদের সঙ্গে বসে খেয়েছিলেন। কিন্তু এবার মায়ের হাতে খাব পছন্দের গরুর মাংস ও পোলাও। আসলে মায়ের রান্নার তুলনা হয়না।”

মেয়ে বাড়িতে ছিলেন না বলে গতবার ঈদের আনন্দ মাটি হয়েছিল আঞ্জু বেগমের। কিন্তু এবার যেন স্বপ্নের মতো কাটছে ঈদ। মায়ের কন্ঠে তাই খুশির ঝিলিক, “আমার এবারের ঈদটা হবে স্বপ্নের মতো। মনে অনেক আনন্দ। ছোটখাটো বাড়ি হচ্ছে আমাদের। মেয়ে গত বছর ঈদে আমার কাছে ছিল না। এবার মেয়ে এসেছে। কি যে খুশি সেটা বলে বোঝাতে পারব না।”

সেবার মেয়েকে ছাড়া ঈদ করেছিলেন। এমনকি বাড়িতে রান্না হয়েছিল ৩ দিন পর। আঞ্জু বেগমের কন্ঠে ঝরে কান্না, “সেবার মেয়ে আসেনি বলে ঈদ করিনি। তেমন কিছুই রান্না করিনি। শুধু সেমাই রান্না করেছিলাম। ওর বাবা মাংস এনেছিল। কিন্তু ৩ দিন পর ফ্রিজ থেকে বের করে সেটা রান্না করেছিলাম। এমনিতে আমার হাতের গরুর মাংস রান্না ভীষণ পছন্দ সাগরিকার। এবার ওর আব্বুকে একটা মুরগিও আনতে বলব। পোলাও রান্না করবো।”

মায়ের সঙ্গে নতুন বাড়ির সামনে সাগরিকা। ছবি : সংগৃহিত

বদলে গেছে মায়ের জীবনও

সাগরিকার সুবাদে বদলে গেছে মায়ের জীবনও। রাস্তায় কখনও বের হলে সাগরিকার মাকেও লোকে প্রশংসা করে। নতুন এই অভিজ্ঞতার কথা এভাবেই বলছিলেন আঞ্জু বেগম, “আমি তো বাসায় থাকি বেশি। যখন দোকানে যাই তখন অনেক দূরের মানুষও মোটরসাইকেল থামিয়ে খোঁজ নেয়। একদিন দুজন বোরখা পরা মেয়ে যাচ্ছিল। ওদের আমি চিনতে পারিনি। ওরা ঠিকই চিনতে পারে আমাকে। একজন আরেক জনকে বলছিল ওই যে দ্যাখ সাগরিকার আম্মু। বেশ ভালোই লাগে এগুলো শুনতে।”

ফুটবল বদলে দিয়েছে সাগরিকার জীবন। এ জীবনে এখন শুধু আনন্দের সমারোহ।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত