চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করতে আবারও দেশটি সফর করছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। গত ৭ মাসের মধ্যে পুতিনের দ্বিতীয় চীন সফর এটি। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর এই সফরে দুই নেতার মধ্যে চতুর্থ বৈঠক হয়েছে।
বিবিসি জানিয়েছে, বেইজিংয়ে এক বৈঠকে পুতিন ও শি দুই দেশের গভীর সম্পর্কের প্রশংসা করেছেন। ইউক্রেনে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোসহ তাদের মিত্রদের নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলায় মস্কোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে ওঠে বেইজিং। রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদারও হয়ে উঠেছে চীন।
চীন কি রাশিয়াকে অস্ত্র দিচ্ছে
রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ শুরু থেকেই অস্বীকার করে আসছে চীন।
গত মাসে বেইজিং সফরের সময় বিবিসি নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছিলেন, “যা ঘটছে না তা হলো, ইউক্রেনে ব্যবহারের জন্য রাশিয়াকে দেওয়া চীনের প্রকৃত অস্ত্রের যোগানের দায় নেওয়া।”
বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র তৈরিতে চীন রাশিয়াকে সহায়তা করছে বলেও অভিযোগ তার। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ”আরও অস্ত্র, ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান, ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে রাশিয়াকে ব্যাপকভাবে সহায়ক উপাদান দিচ্ছে চীন।”
তিনি আরও বলেন, রাশিয়ার আমদানিকৃত প্রায় ৭০ শতাংশ মেশিন টুলস ও ৯০ শতাংশ মাইক্রো-ইলেকট্রনিক্স আসে চীন থেকে।
যুক্তরাষ্ট্র মে মাসে চীন ও হংকংভিত্তিক প্রায় ২০টি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞায় বলা হয়, একটি প্রতিষ্ঠান শিয়াকে ড্রোন তৈরির উপাদান সরবরাহ করেছে। আর বাকিরা অন্যান্য প্রযুক্তির ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো এড়ানোর জন্য সহায়তা করেছে।
চীন অবশ্য প্রাণঘাতী অস্ত্র বিক্রি না করার যুক্তিতে রাশিয়ার সঙ্গে অস্ত্র বাণিজ্যের ন্যায্যতার কথা বলে আসছে। আইন ও বিধি মেনেই দ্বৈত-ব্যবহার্য সামগ্রী রপ্তানিও অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে করে আসছে চীন।
থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কার্নেগি এনডাউমেন্ট চীনা কাস্টমসের ডেটা বিশ্লেষণ করে বলছে, বেইজিং প্রতি মাসে রাশিয়ায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের দ্বৈত-ব্যবহার্য সামগ্রী রপ্তানি করে। সেগুলোর বাণিজ্যিক ও সামরিক দুই ধরনের উপযোগিতাই রয়েছে।
কার্নেগি এনডাউমেন্ট বলছে, ড্রোন ও ট্যাঙ্কের মতো অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীও তালিকায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যেগুলোকে ‘হাই প্রায়োরিটি’ বা ‘উচ্চ অগ্রাধিকার’ সামগ্রী হিসেবে উল্লেখ করেছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটও ইউক্রেনে রাশিয়ার গোয়েন্দা নজরদারির কাজে চীনা স্যাটেলাইট প্রযুক্তির সম্ভাব্য ব্যবহার সম্পর্কেও সতর্ক করেছে।
চীন ও রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য কতটা বেড়েছে
২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা চালায়। তারপর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এমন পরিস্থিতিতে বেইজিং হয়ে উঠেছে মস্কোর গাড়ি, পোশাক, কাঁচামাল এবং অন্যান্য অনেক পণ্যের মূল সরবরাহকারী।
চীনের সরকারি পরিসংখ্যান থেকেই জানা যায়, ২০২৩ সালে রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির বাণিজ্য রেকর্ড ২৪০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়, যা ২০২১ সাল থেকে ৬৪ শতাংশ বেশি।
গত বছর চীন থেকে রাশিয়ার আমদানি ছিল ১১১ বিলিয়ন ডলারের। আর চীনে রাশিয়ার রপ্তানি ছিল ১২৯ বিলিয়ন ডলার।
২০২৩ সালে রাশিয়ায় চীনা গাড়ি ও যন্ত্রাংশ রপ্তানি ২৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের বছরের ৬ বিলিয়ন ডলার থেকে প্রায় ৪ গুণ বেশি।
মার্চ মাসে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, “রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস অসংখ্য চীনা পরিবারকে জ্বালানি দিচ্ছে এবং চীনের তৈরি অটোমোবাইল রাশিয়ার রাস্তায় চলছে।”
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ এই সম্পর্ককে একটি একতরফা সম্পর্ক বলে মনে করেন। তাদের মতে, রাশিয়া উল্টোভাবে চীনের ওপর বেশি নির্ভরশীল।
যেমন, যেখানে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চীন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদারে পরিণত হয়েছে, সেখানে রাশিয়া চীনের ষষ্ঠ বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার।
রাশিয়া থেকে চীন কত তেল ও গ্যাস কেনে
রাশিয়ার সরকারের বার্ষিক আয়ের প্রায় অর্ধেকই আসে তেল ও গ্যাস থেকে।
ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর কাছে তাদের তেল-গ্যাস বিক্রি কমে গেছে।
এই ঘাটতির একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাশিয়া মিটিয়েছে এশিয়া, বিশেষ করে চীন ও ভারতে বিক্রি বাড়িয়ে।
২০২৩ সালে রাশিয়া সৌদি আরবকে ছাড়িয়ে চীনের সবচেয়ে বড় অপরিশোধিত তেল সরবরাহকারীতে পরিণত হয়েছে। গত বছর বেইজিং মস্কো থেকে ১০৭ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করে, যা ২০২২ সাল থেকে ২৪ শতাংশ বেশি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি সেভেনও সমুদ্রপথে পরিবহন করা রাশিয়ার তেলের দামের ওপর বিশ্বব্যাপী সীমা আরোপ করে দেশটির আয় কমানোর চেষ্টা করেছে।
তবে চীন তাদের নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি মূল্যেই রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে।
ভারতও ইউক্রেন হামলার পর থেকে রাশিয়ার কাছ থেকে ছাড় দেওয়া মূল্যে তেল কেনার পরিমাণ ব্যাপক হারে বাড়িয়েছে। তবে কয়েক দশকের পুরনো বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও ভারত চীনের মতো বাড়তি দরে তেলে কেনেনি।
ভারতের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ব্যাংক অফ বরোদার হিসাব মতে, ভারতের মোট তেল আমদানিতে রাশিয়ার অংশ ২০২৩ সালের জুন মাসে রেকর্ড ৪৪ শতাংশে পৌঁছায়।
২০২৩ সালে চীন রাশিয়া থেকে 8 মিলিয়ন টন তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) আমদানি করে, যা ২০২১ সাল থেকে ৭৭ শতাংশ বেশি।
চীন সফরের দ্বিতীয় দিন হারবিনে এক বাণিজ্যমেলায় পুতিন বলেন, দুই দেশের মধ্যে জ্বালানি সম্পর্ক আরও মজবুত হবে। চীনকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি সরবরাহে রাশিয়া প্রস্তুত বলেও জানান তিনি।
রাশিয়ার পশ্চিম সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে উত্তর-পূর্ব চীনে প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানির জন্যও দেশ দুটি পাওয়ার অফ সাইবেরিয়া ২ নামের একটি নতুন পাইপলাইনসহ জ্বালানি সম্পর্ক প্রসারিত করার পরিকল্পনা করেছে।
চীন ইতিমধ্যেই রাশিয়ার কাছ থেকে মূল ‘পাওয়ার অব সাইবেরিয়া পাইপলাইনের’ মাধ্যমে গ্যাস নিচ্ছে, যা ২০১৯ সাল থেকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি