Beta
শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫

পঙ্কজ উদাসের জীবনে যত নেশা

pankajudash-270224-01
[publishpress_authors_box]

মঞ্চে জমকালো শেরওয়ানি গায়ে আরাম করে বসেছেন শিল্পী। মৃদু স্বরে দুচারটা কথা বলছেন। সামনে রাখা হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন। দর্শকরা তাতে মিটি মিটি হাসছেন। তারপর শিল্পী কণ্ঠ ছাড়তেই শ্রোতারা বুঁদ হয়ে গেলেন। জমে উঠলো গজল মাহফিল।

গজল সম্রাট তখন গাইছেন ‘থোরি থোরি পিয়া কারো …’। অথবা ‘শেরাব চিজ হি অ্যায়সি হ্যায়’।    

এক গজলে বলা হচ্ছে, দাম বেড়ে গেছে তাই অল্প অল্প করে সুরা পান করতে হবে; পান করুন তবে হিসাব করে। আবার  আরেক গজলের অর্থ, মদ তো এমনি যা কখনও ছাড়া যায় না; মদ আমার প্রেয়সীর মতো যাকে ছাড়া যায় না।

পঙ্কজ উদাসের গাওয়া হাজারেরও বেশি গজলের মধ্যে হাতে গোনা ২৫টিতে শরাব, সাকি এমন কিছু শব্দ মেলে। এরপরও ‘মদ্যপ শিল্পী’ বলে বদনাম জুটেছিল তার কপালে।

যদিও এমন কিছু হবে তা ধারণাই করেননি পঙ্কজ উদাস।

গানের বিপণন কৌশলে এই দুর্নামের ভাগীদার হয়েছিলেন বলে ২০০১ সালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি।

“দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওই গজলগুলোই বেছে নিতো মিউজিক কোম্পানিগুলো। এটা একেবারেই বাজে বিপণন কৌশল। আমি যখন গানগুলো রেকর্ড করেছিলাম, তখন কিন্তু ভাবিনি এমন কিছু হতে পারে।”

১৯৭২ সালে সিনেমা গান গেয়ে শিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন পঙ্কজ উদাস। গান ভালো গাইলেও ওই সিনেমা ভালো করেনি। তারপর এই শিল্পী পাড়ি জমান কানাডায়। সেখানে বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে গাইতে গাইতে বুঝতে পারেন গজলের চাহিদা রয়েছে শ্রোতাদের কাছে।

আবারও ভারতে ফিরে এলেন পঙ্কজ উদাস। ১৯৮০ সালে তার প্রথম অ্যালবাম আহাত মুক্তি পেলো। ‘ইয়ে আলাগ বাত হ্যায় অ্যায় সাকি কে মুঝে হোশ নেহি’ – পঙ্কজ উদাসের কণ্ঠে এই গজল খুব দৃঢ় ভাবেই তার ফেরার বার্তা দিল।

‘না সামঝো কে হাম পি গেয়ে পিতে পিতে’, ‘এক তারাফ উসকা ঘর এক তারাফ ম্যায়কাদা’ এসব গান ছাড়া গজলের মাহফিল অসম্পূর্ণ হয়ে থাকতো শ্রোতাদের কাছে।

কেউ কেউ যে তাকে মদ্যপ ভাবতেন তা নিয়ে অনেক সময় মঞ্চে মজাও করতেন এই শিল্পী।

ততদিনে গজলে তার তিরিশ বছর পেরিয়েছে।

এক মাহফিলে সামনে বসা দর্শকের উদ্দেশে পঙ্কজ উদাস বললেন, “ভারত হোক, আর আমেরিকা-কানাডা হোক, গজল শিল্পীদের নিয়ে একটা ভুল ধারণা পোষন করতে দেখেছি অনেককেই।

“তারা ধরেই নেন মদ না গিলে গজল শিল্পীরা গাইতেই পারেন না। ধরা যাক, কনসার্ট শুরু হতে একটু দেরি হয়ে গেলো তো এদিকে অনেকে ভাবেন শিল্পী নিশ্চয়ই ড্রেসিং রুমে বসে গলা ভেজাচ্ছেন।

“একবার তো আমি গরমের দিনে মাহফিলে গাইছিলাম; খুব তেষ্টা পেলো।মঞ্চে পানির গ্লাস রাখা ছিল। আমি এক ঢোকে আধা গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। তারপর খেয়াল করলেন দর্শকের মধ্যে একজন পাশের জনকে কনুই দিয়ে ঠেস মেরে পঙ্কজ উদাসকে দেখিয়ে বলছে, দেখো দেখো শিল্পী পুরো গ্লাস খালি করে দিলো। তাই শুনে পাশের জন বললো, আসর তো তাহলে এখনই জমে উঠবে।”

ওই আসরে সুফি কবি আনোয়ার ফারুখাবাদীর লেখা ‘সব কো মালুম হ্যায় ম্যায় শেরাবি নেহি ফিরভি কোই পিলায়ে তো ম্যায় কেয়া করু’ গজলটি পরিবেশন করেন তিনি।

মূল গানে যাওয়ার আগে পঙ্কজ উদাস কাব্যিক ঢঙ্গে কয়েক চরণ বলেন, “ …নেশা শারাব মে হোতা তো নাচতি বোতল।”

অর্থ্যাৎ যদি মদে নেশা হতো তাহলে তো বোতলই নেচে উঠতো।

তাহলে গজল সম্রাট পঙ্কজ উদাসের নেশা হয় কীসে?

ওই আসরেই মঞ্চে বসে তিনি বলছিলেন, “সত্যি বলতে শুধু আমি না, আমার সঙ্গে সবাই যখন আমরা মঞ্চে বসি, চোখ বন্ধ করি, তারপর সুরের নেশা ছড়িয়ে যায় … তখন কোনো মদের পেয়ালার প্রয়োজন পড়ে না।

“একজন শিল্পী হিসেবে বাজি রেখে বলতে পারি, দুনিয়াতে কোনো শিল্পীর জন্য এমন কোনো নেশা তৈরি হয়নি যে নেশা শ্রোতাদের তালির গুঞ্জনে আছে।”   

ছবি: পঙ্কজ উদাসের ফেইসবুক টাইমলাইন থেকে নেওয়া

ভালোবাসার নেশায় অন্য ধর্মে বিয়ে

প্রথম দেখাতেই ফরিদার প্রেমে পড়েছিলেন পঙ্কজ উদাস। দুজনের প্রেমের গল্প শুরু হয় ১৯৭৯ সালে। তখনও গ্রাজুয়েশন শেষ করেননি পঙ্কজ ‍উদাস। আর ফরিদা তখন এয়ার ইন্ডিয়ার একজন বিমানবালা।  প্রতিবেশী তাদের আবার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এভাবেই তাদের প্রেম সামনের দিকে পা বাড়ায়।

পঙ্কজ উদাসের ক্যারিয়ার তখনও পোক্ত নয়। কিন্তু ফরিদা তার জীবনে যেন সৌভাগ্য হয়ে আসে। ফরিদার সরল হাসিতে আটকে গিয়েছিলেন তা এক সাক্ষাৎকারে নিজেই স্বীকার করেছিলেন পঙ্কজ উদাস।

তিন বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর  সম্পর্ক গড়ায় বিয়ের দিকে। তবে তাতে বিপত্তি হয়ে উঠল দুই পরিবার।

গুজরাতে জমিদার পরিবারের সন্তান পঙ্কজ উদাস। আর ফরিদা হলেন পারসি পরিবারের সন্তান। পারসি সম্প্রদায় ইরান থেকে ভারতে এসে থিতু হয়েছিল হাজার আগেই। জরথুস্ত্রবাদ বা পারসিক হলো এই সম্প্রদায়ের ধর্ম।  আর সম্প্রদায়ের বাইরে বিয়ে করার অনুমতি ছিল না তাদের।

পঙ্কজ ও ফরিদা সিদ্ধান্ত নিলেন, দুই পরিবারের আশীর্বাদ না নিয়ে তারা বিয়ে করবেন না।

এরপর ফরিদার বাবার সঙ্গে পরিচয় হয় পঙ্কজ উদাসের। ফরিদার বাবা এখন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা।  

ফরিদার বাবার লাইসেন্স করা বন্দুকের নলের মুখে বোঝাপড়া সারতে হয়েছিল পঙ্কজ উদাসকে।

তারপর ফরিদার বাবা পঙ্কজ উদাসকে বলেন, “যদি সত্যি মনে করো তোমরা একে অন্যের সঙ্গে সুখী থাকবে তাহলে বিয়ে করে নাও।”

১৯৮২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বিয়ে করেন তারা। সেই হিসাবে তাদের  দাম্পত্য জীবন ৪২ বছর পার করেছে।

জীবনের কঠিন সময়ে ফরিদাকে পাশে পেয়েছেন পঙ্কজ উদাস।

ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “আমার প্রথম অ্যালবাম মুক্তি সময় মাত্র কয়েক হাজার রুপি কম পড়ে যায়। ফরিদার কাছেও টাকা ছিল না। তখনও আমাদের বিয়ে হয়নি। কিন্তু ফরিদা আমাকে ওই কয়েক হাজার টাকা এনে দিল। সে টাকাটা ধার করেছিল।”

এই যুগল একে অন্যের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, “জীবনে তাদের মধ্যে যত ঝগড়াই হোক না কেন, তারা কখনই ধর্ম নিয়ে তর্ক বাঁধাবে না একে অন্যের সঙ্গে।”

ফরিদাও এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি পঙ্কজকে আমার সাত জন্মের স্বামী হিসাবে চাই। খুব কম পুরুষই তাদের জীবনে নারীর অবদানকে স্বীকার করে। পঙ্কজ সেই স্বীকার করাদের একজন। এটাই আমাদের একে অন্যকে কাছাকাছি করেছে।”

দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে এই যুগলের দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। তারা দুজন সংগীত জগতেই কাজ করছেন।

ছবি: পঙ্কজ উদাসের ফেইসবুক টাইমলাইন থেকে নেওয়া

কুকুরপ্রেম থেকে মামলা

২০১৯ সালে ভারতে কুকুরদের নিয়ে ডগস অ্যান্ড মোর ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে দেখা যায় পঙ্কজ উদাসকে; সঙ্গে দুটি কুকুর।  

ওই প্রতিবেদনের আরও অনেক ছবিতে দেখা যায় পরিবারের সবার সঙ্গে কুকুর দুটির বেশ সখ্য।

১৯৯৪ সালে একটি কুকুর বাড়িতে আনেন তারা। নাম দেন টিটো। একবার আমেরিকার থেকে দেশে ফিরে বাড়িতে টিটোর সঙ্গে বাগানে খেলা করলেন পঙ্কজ উদাস। মূল ফটক খোলা ছিল। টিটো সেই ফাঁকে সড়কে উঠে চাপা পড়ে মারা যায়। টিটোকে হারানোতে মনে কষ্ট পেয়েছিলেন পঙ্কজ উদাস।

এরপর প্রিন্স আসে তাদের বাড়িতে। ১৪ বছর তাদের সঙ্গে থাকে এই জার্মান শেফার্ড। একদিন কনসার্ট থেকে বাড়ি ফেরেন পঙ্কজ উদাস। প্রিন্স তার কাছে আসে। দেখা হওয়ার পর প্রিন্স বাগানে গিয়ে শুয়ে পড়ে এবং মারা যায়।

পঙ্কজ উদাস তখন বুঝতে পারেন কুকুরটি তাকে শেষবার দেখার জন্যই অপেক্ষা করছিল।

এরপর রোমিও ১৩ বছর তাদের বাড়িতে কাটিয়ে মারা যায়।

রোমিও মারা যাওয়ার পর পঙ্কজ উদাস আর কুকুর পালতে চাননি। কিন্তু তার মেয়ে ঠিকই পথ থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে নিয়ে আসে স্নোয়িকে। এরপর বড় ভাইয়ের মতো কফি নামে আরেকটি কুকুর  সঙ্গী হয় স্নোয়ির।

কুকুরের কারণে আইন-আদালতের চক্করেও পড়তে হয়েছিল পঙ্কজ উদাসকে।   

পঙ্কজ উদাসের বাংলোতে ভাড়া থাকতেন রাধিকা অরোরা। পঙ্কজ ও ফরিদা  তাদের একটি কুকুরকে  আসা-যাওয়ার পথে ইচ্ছে করে রেখে দিতেন বলে অভিযোগ তোলেন ওই নারী।

এসব কারণে ২০০৮ সালে মামলা ঠুকে দেন রাধিকা অরোরা। ২০১৯ সালেও এই মামলা চলছিল এবং কোর্ট  পঙ্কজ ও ফরিদার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করতে রাজি হয়নি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত