মনে করুন, আপনিই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেনে আক্রমণের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো আপনাকে একঘরে করে ফেলেছে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে আপনার দেশের অর্থনীতিকে বৈশ্বিক বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চলছে।
শুধু কি তাই, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আপনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে আপনি প্রমাণ করবেন যে, এসব চাপ আপনার ওপর কোনো কাজ করছে না।
উত্তর হলো; আপনাকে একটি শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করতে হবে।
মঙ্গলবার রাশিয়ার কাজান শহরে পুতিন ২০টিরও বেশি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে উদীয়মান অর্থনীতির ব্রিকস সম্মেলনে স্বাগত জানালেন।
তিন দিনের এই সম্মেলনে আমন্ত্রিতদের মধ্যে রয়েছেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা। এছাড়া থাকবেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভারও অংশগ্রহণ করার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আহত হওয়ায় তিনি কাজানে সফর বাতিল করেন।
কাজানে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন গত বছর জোহানেসবার্গে হওয়া ব্রিকস সম্মেলন থেকে ভিন্ন। কারণ ওই সম্মেলনে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় স্বশরীরে অংশগ্রহণ করতে পারেননি পুতিন। ভিডিও স্ক্রিনের অপর প্রান্ত থেকে তিনি সেবার অংশ নিয়েছিলেন।
ক্রেমলিন এবারের ব্রিকস সম্মেলনকে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত অন্যতম ‘বৃহৎ পরিসরের পররাষ্ট্র নীতিমূলক ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাক্রো-অ্যাডভাইজারির প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস উইফার মনে করেন, “এর সুস্পষ্ট বার্তা হলো, রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
“ক্রেমলিন থেকে এটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা যে, রাশিয়া নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও টিকে আছে। যদিও আমরা জানি, ভেতরে ভেতরে দেশটি অনেক সংকটে আছে। তবে ভূরাজনৈতিক পর্যায়ে রাশিয়ার বহু মিত্র রয়েছে, যারা সবাই রাশিয়ার অংশীদার হতে চলেছে।”
রাশিয়ার মিত্র কারা?
ব্রিকস হলো ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত একটি জোট। এই জোটকে প্রায়ই পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থার একটি ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সম্প্রতি এই জোটে মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সৌদি আরবকেও এই জোটে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
ব্রিকস সদস্য দেশগুলো বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। সম্মিলিতভাবে এসব দেশের অর্থনীতির মূল্য ২৮ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এটি বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রায় ২৮ শতাংশ।
রুশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আরও ৩০টি দেশ ব্রিকসে যোগ দিতে চায় অথবা এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়তে ইচ্ছুক। এসব দেশের কিছু সদস্য সম্মেলনে অংশ নেবে। কাজানে এই সপ্তাহে ব্রিকসের ‘বৈশ্বিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার’ প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হবে, এমনটা আশা করা হচ্ছে।
তবে প্রশ্ন হলো, পুতিনকে ভূরাজনৈতিক মঞ্চে তুলে ধরার পাশাপাশি এই সম্মেলনের লক্ষ্য কী
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার চাপ কমানো ছাড়াও পুতিন আশা করছেন, ব্রিকস সদস্যদের বৈশ্বিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলারের বিকল্প গ্রহণ করাতে তিনি রাজি করাতে পারবেন।
উইফারের মতে, “রাশিয়ার অর্থনীতির অনেক সমস্যা সীমান্ত পেরিয়ে বাণিজ্য ও লেনদেনের সঙ্গে সম্পর্কিত। অধিকাংশই সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের সঙ্গে সংযুক্ত।
“যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বৈশ্বিক বাণিজ্যের ওপর ব্যাপক শক্তি ও প্রভাব রাখে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ডলার লেনদেনের প্রধান মুদ্রা হিসেবে কাজ করে। রাশিয়ার মূল লক্ষ্য হলো, এই ডলারের আধিপত্য ভেঙে দেওয়া। দেশটি চায়, ব্রিকস দেশগুলো একটি বিকল্প বাণিজ্য ব্যবস্থা ও সীমান্ত পেরিয়ে লেনদেনের একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলুক। এতে যাতে ডলার, ইউরো বা জি-৭ এর কোনো মুদ্রা অন্তর্ভুক্ত না হয় এবং নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমে।”
কিন্তু সমালোচকরা ব্রিকসের সদস্যদের মধ্যে ভিন্নতা তুলে ধরেন। ‘একই মতের’ শব্দটি জোটের বর্তমান সব সদস্যদের বেলায় খাটে না।
গোল্ডম্যান স্যাক্সের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জিম ও’নেইল বলেন, “কিছু ক্ষেত্রে এটি পশ্চিমের জন্য সুবিধা যে, চীন ও ভারত কখনোই কোনো বিষয়ে একমত হতে পারে না। কারণ যদি তারা সত্যিই সিরিয়াস হতো, তাহলে ব্রিকসের বিশাল প্রভাব থাকত।
“চীন ও ভারত একে অপরকে আক্রমণ না করতে যথেষ্ট চেষ্টা করছে। অর্থনৈতিক বিষয়গুলোতে দেশ দুটিকে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবে আনা একটি চলমান চ্যালেঞ্জ।”
জিম ও’নেইল ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি এই শতাব্দীর শুরুতে ‘ব্রিক’ শব্দটির সৃষ্টি করেন। তিনি মনে করতেন, চারটি উদীয়মান অর্থনীতিকে বৈশ্বিক নীতিমালার কেন্দ্রে আনা উচিৎ।
সংশ্লিষ্ট দেশগুলো নিজেদের ব্রিক গ্রুপ গঠন করে পরে একে ব্রিকস নাম দেয়। কারণ এতে যুক্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। তারা বিশ্বের সাতটি বৃহত্তম অর্থনীতির (কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র) আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করে।
এটি শুধু ভারত ও চীনের মধ্যকার মতদ্বৈততার বিষয় নয়। ব্রিকসের নতুন দুই সদস্য, মিশর ও ইথিওপিয়ার মধ্যেও টানাপোড়েন রয়েছে। আর সম্পর্কের উন্নতির কথা বলার পরেও, ইরান ও সৌদি আরব দীর্ঘকাল ধরে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরিচিত।
ও’নেইল বিশ্বাস করেন, “জোটের সবাই মৌলিক বিষয়গুলোতে সমানভাবে একমত হবে, এমনটা ভাবা অযৌক্তিক হবে।”
রাশিয়া যখন পশ্চিম বিরোধিতার জায়গা থেকে ‘নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা’ গঠনের কথা বলছে, তখন ব্রিকসের অন্য দেশগুলো, যেমন ভারত পশ্চিমের সঙ্গে ভালো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী।
কাজানে পুতিনের কাজ হবে জোটের সদস্যদের মধ্যকার মতদ্বৈততা দূর করে একটি ঐক্যের চিত্রপট তৈরি করা। একই সঙ্গে রুশ জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখানো যে, রাশিয়া একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি।
তথ্যসূত্র : বিবিসি, সিএনএন