Beta
শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

পেশা যখন কান খোঁচানো

Ear Cleaners
[publishpress_authors_box]

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে সামনে ন্যায় কুঞ্জের দক্ষিণপাশে প্লাস্টিকের টুলে বসে আছেন তিন ব্যক্তি। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগে অনেকগুলো ছোট ছোট বোতলে নাম না জানা তরল ওষুধ। থরে থরে সাজানো ছোট ছোট সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি, তুলার পুঁটলি।

তখন দুপুর ১২ টা। আদালতে বিচারপ্রার্থীতে সরগরম। এ সময়টা তাদের পিক আওয়ার, কথা বলার সময় নাই। একের পর এক কাস্টমার আসছে আর কান পরিস্কার করাচ্ছেন। তাদের প্রধান কাস্টমার হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। ছবি তুলতে তাদের বেজায় আপত্তি। বাবা এমন পেশায় আছেন পত্রিকায় ছবি গেলে তার মেয়ে বা ছেলের শ্বশুর বাড়িতে সমস্যা হতে পারে।

ষাটোর্ধ্ব শাহজাহান। বয়স হলেও শরীর এখনও বেশ আঁটসাট। বাড়ি চাঁদপুর জেলার হাইমচর থানায়। ২ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। প্রায় ৪০ বছর ধরে এ পেশার সাথে জড়িত। মূলত ঢাকা কোর্ট ও তার আশেপাশেই তিনি করেন। ছেলেমেয়েদের বড় করা, লেখাপড়া শেখানো, বিয়ে সাদী সবই এ পেশার আয় থেকেই। এখনও তার সংসার চলে এই আয় দিয়েই।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “পাকিস্তান আমলে বিহারীরা এ পেশায় ছিলেন। তাদের কাছ থেকে আমার ওস্তাদ জাবখশ দেওয়ান কাজ শিখেন। আর জাবখশ দেওয়ানের কাছ থেকে এ পেশায় আমি ট্রেনিং নিয়ে এতগুলো বছর কাজ করে আসছি।”

কান পরিস্কারে কানের কোন ক্ষতি হবে কিনা জানাতে চাইলে তিনি বলেন, “না। আমরা ট্রেনিংপ্রাপ্ত। আমাদের অনেকে ৩৫/৪০ বছর ধরে এ পেশায় যুক্ত। কোনদিন কারও সমস্যা হতে শুনিনি।”

প্রতিদিন কেমন উপার্জন হয় জানতে চাইলে তিনি জানান, ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা, কোনদিন আরও বেশী হয়। যা পায় কোন রকমে সংসার চলে যায়।

এ পেশায় ৩৬ বছর সেবা দিচ্ছেন চাঁদপুরের একই এলাকার ৫৪ বছর বয়সি রাজু গাজী। থাকেন ঢাকার কেরানীগঞ্জ।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “৮৮ সালের বন্যার পর ঢাকা চলে আসি। এরপর জাবখশ দেওয়ান ওস্তাদের কাছে কাজ শিখে এ পেশায় যুক্ত হই।”

তিন ছেলের মধ্যে দু’জনকে বিয়ে করিয়েছেন। এখন সংসারে তিনি, তার স্ত্রী, এক ছেলে ও এক শালীর মা-মরা মেয়েসহ ৪ জন তার আয়ের ‍উপর নির্ভরশীল।

ছবি- পেক্সেলস

জানালেন মূলত ঢাকা কোর্টে বেশি থাকা পড়ে। তবে লোকজন কমে গেলে সদরঘাট, আজাদ হলের সামনে এমনি জনবহুল স্থানে গিয়ে গিয়ে কাজ করেন।

“এই কাজ যখন শুরু করি, তখন মানুষ কান পরিষ্কারের পর এক টাকা দিতেন। এখন মানুষ ৫০ টাকা দেয়। এই পেশা ঐতিহ্যবাহী পেশা। পাকিস্তান আমল থেকেই এই পেশার প্রচলন,” তিনি বলেন

এ পেশায় ৩৫ বছর যুক্ত আছেন আরশাদ আলী গাজী। তিনিও ঢাকা কোর্ট এলাকায় কাজ করেন। শাহজাহান, রাজুর মতো একই এলাকায় বাড়ি। তিনি জানান, প্রতিদিন কোর্ট এলাকায় তার ৫০০-৭০০ এমনটি হাজার টাকাও ইনকাম হয়। তবে উল্লেখ করার মতো কোন পেশা না হওয়ায় কেউ আর নতুন করে এ পেশায় আসতে চায় না। বর্তমান ছেলে মেয়েদের আত্মসম্মানবোধ বেশী।

আরশাদ আলী গাজীর কাছে কান পরিস্কার করালেন আদালতে এক বিচারপ্রার্থী রবিন।

এই প্রতিবেদকের সামনেই কান পরিস্কার করে ১৫০ টাকা দিলেন। তারপরও আরশাদ আলী গাজী খুশি নন। তিনি তার কাছে আরও টাকা দাবী করছেন। বলছেন তিনি অনেক রকম মেডিসিন দিয়ে তার কান পরিস্কার করেছেন। কমপক্ষে আরও ৫০ টাকা দিতে হবে, নইলে তার কোন লাভ থাকবে না। 

রবিন মানিব্যাগ খুলে তাকে দেখালেন তার কাছে আর কোন টাকা নাই। এরপর গাজী টাকা ট্যাঁকে গুঁজতে গুঁজতে বললেন, “স্যার আবার কোর্টে আসলে আইসেন কান পরিস্কার করে দিমুনে।”

রবিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কান পরিস্কার করার সময় একটা সুড়সুড়ি অনুভূত হয়। এটা ভালো লাগে। তাই কোর্টে আসা হলে কান পরিস্কার করাই।”

তারাতো ৫০ টাকায় কান পরিস্কার করেন, দেড়শ’ টাকা দিলেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এরা এমনই। ৫০ টাকা বলে কাজ শুরু করে এরপর এটা করেছি ওটা করেছি বলে ডিমান্ড বাড়াতেই থাকে।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মালদ্বীপের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সাবেক মেডিকেল অফিসার (এমও) এবং ঢাকা আইনজীবী সমিতির নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. নাভিদ আনজুম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ডাক্তার ব্যতীত যারা কান পরিষ্কার করেন পরবর্তীতে তাদের অনেকেই স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমেস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আদালতপাড়া অনেককেই দেখা গেছে কান পরিষ্কার করান। যারা করে তাদের কাছে একটি চিকন শিক থাকে, সেটি জীবাণুমুক্ত নয়।

“কানে বেশি খোঁচাখুঁচির কারণে পর্দা ফেটে যেতে পারে। কানে ইনফেকশন হতে পারে। আমার কাছে এই ধরণের অনেক রোগীও এসেছে। আগে কান ভালো ছিলো, তবে এসব হকার দিয়ে কান পরিস্কার করানোর ফলে এখন কম শুনেন। এসব সেনসেটিভ বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কোন কিছুই করাই ঠিক নয়।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত