শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে যে সরকার গঠন করেছিলেন, তাতে নারী ছিলেন ছয়জন। তার মধ্যে চারজনই ছিলেন পূর্ণ মন্ত্রী। পরেরবার ২০১৪ সালে গঠন করা সরকারে নারীর সংখ্যা একজন কমে নেমে আসে পাঁচজনে। ২০১৮ সালের মন্ত্রিসভাতেও সংখ্যাটায় বদল আসেনি। তখন ছিলেন পাঁচজন নারী। এরপর ২০২৪ সালে টানা চতুর্থ মেয়াদে যে সরকার শেখ হাসিনা গঠন করতে যাচ্ছেন, তাতে নারী থাকছেন তিনিসহ চারজন। অর্থাৎ নারী মন্ত্রীর সংখ্যা কমছে ধারাবাহিকভাবে।
শতাংশের হিসাবে ৩৭ সদস্যের মন্ত্রিসভায় নারীর অংশ মাত্র ১০। অথচ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি আসনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নেন মোট ৯৪ জন নারী। তার মধ্যে নৌকা প্রতীকে লড়েছেন ২৪ জন। এর মধ্যে জয় পেয়েছেন ১৫ জন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করে জিতেছেন চারজন। জয় পাওয়া ২৪ জনের মধ্যে মন্ত্রিসভায় ডাক পেয়েছেন মাত্র চারজন। তাদের একজন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাকিরা হলেন- দীপু মনি, সিমিন হোসেন রিমি ও রুমানা আলী টুসি।
দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বস্তরের নেতৃত্বে নারীদের অন্তর্ভুক্তির প্রতিশ্রুতি থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। ২০০৮ সালে দেশের সবগুলো রাজনৈতিক দলের মত নিয়ে সংগঠনের প্রতিটি স্তরে নারী নেতৃত্ব নিশ্চিত করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ২০০৯ জারি করা হয়। সেখানে বলা হয়, ২০২০ সালের মধ্যে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বস্তরের কমিটিতে ৩৩ ভাগ নারী রাখা হবে। পরে এই আদেশ সংশোধন করে সময়সীমা ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সে অনুযায়ী প্রতিটি রাজনৈতিক দল কমিশনে নিবন্ধন করে গঠনতন্ত্রে সেই ধারা যুক্ত করে।
যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৃণমূলে নারী নেতৃত্ব বাড়লেই তা জাতীয় পর্যায়ে আসছে না। এক্ষেত্রে পেশী শক্তি, অর্থের শক্তি অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে। আবার শুধু জাতীয় সংসদে আসাটাকেই নারী নেতৃত্বের ‘ইন্ডিকেটর (নির্দেশক)’ বলেও মনে করছেন না অনেকে।
মুক্তিযোদ্ধা, মানবাধিকারকর্মী আরমা দত্ত। একাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি। নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখায় ২০১৬ সালে রোকেয়া পদকও পান।কেবল সংসদে আসাকে নারী নেতৃত্বের ‘ইন্ডিকেটর’ হিসেবে মানতে নারাজ তিনি।
আরমা দত্ত সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা একটা ইন্ডিকেটর হতে পারে কিন্তু তা সামগ্রিক অর্থে নয়। এখন তৃণমূলে নারী নেতৃত্ব অনেক বেড়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে নারীরা অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
“এবার যারা ভোট দিয়েছেন, তার মধ্যে নারী ভোটার বেশি ছিল। এটাও নারীর রাজনৈতিক সচেতনতার অন্যতম উদাহরণ।”
তবে তৃণমূল থেকে উঠে আসতে নারীদের আরেকটু সময় লাগবে মন্তব্য করে আরমা দত্ত বলেন, “এখানে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে, তাদেরকে সাপোর্টিভ ভুমিকা পালন করতে হবে। তা না হলে তৃণমূল থেকে নারী সংসদে আসতে পারবে না। আর এজন্য রাষ্ট্রকেই নারীর প্রতি পুরুষের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।”
সংখ্যার দিক দিয়ে এবারের সংসদে নারীর সংখ্যা নিশ্চয়ই কমেছে। কিন্তু এবারের নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ বেশি ছিল বলেই মনে করেন মানবাধিকারকর্মী খুশি কবির।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এবারে নারী ভোটার বেশি ছিল, নারী প্রার্থীও অনেক ছিল। তবে গতবারের তুলনায় তারা জিতেছেন কম। এর আগেও নারীরা সংসদে গেছেন। কিন্তু সেখানে নারী উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীদের বিষয়গুলো নিয়ে কথা হয়েছে কম। নারী নিয়ে আইনও হয়, কিন্তু নারী পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে কিছু হয় না।”
‘আরেকটি বিষয় এখানে ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ’ উল্লেখ করে খুশি কবির বলেন, “বিশ্বে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যেসব দেশে হয়, সেখানে নারী নেতৃত্ব কমে যায়। ধর্মকে ব্যবহার করে যদি রাজনীতি হয় তাহলে নারীর অবস্থান আরও দুর্বল হয়ে পড়বে, এক্ষেত্রে নারীর অবস্থান সুবিধাজনক হবে না।”
বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার কারণেই দেশের রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব কমে গেছে বলে মন্তব্য করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজ।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “পেশী শক্তির ব্যবহার কমেছে বলা হলেও অর্থ এবং ক্ষমতা এখানে বিশাল ভূমিকা পালন করে। সেখানে কিন্তু নারী দুর্বল। ইউনিয়ন পর্যায়ে সাধারণভাবেও নারীরা আসতে পারে, কিন্তু কোটা নির্ধারণ থাকায় সেখানে তারা এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পিছিয়ে যায়। আইনে কোনও বাধা নেই অথচ কোটার কারণে তাদের কোটার ভেতরেই থাকতে হয়।”
কোটা নারীর ‘বড় প্রতিবন্ধকতা’ উল্লেখ করে তুরিন আফরোজ বলেন, “কোটার বাইরে আসার ক্ষেত্রে নারী যেমন উৎসাহ পায় না, তেমনি মানুষও চায় না। নারীর জন্য খুব সাধারণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় – ‘আপনি তো কোটাতেই আসতে পারেন, সাধারণভাবে কেন?’ এখানে প্রতিযোগিতা এত বেশি যে কাউকে সরাতে হলে নারীকেই সরিয়ে দেওয়া হয়, নারীকে সরে যেতে হয়। নারীকে সরানোই সবচেয়ে সহজ।”
আর নারীর সরে যাওয়ায় পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সবাই সমর্থন দেয়। কোটায় বন্দি থেকে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হচ্ছে না। কোটা না থাকলে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়ত দাবি করে তিনি বলেন, “এতদিনে হয়ত আমরা সেটা অর্ধেক অর্ধেক দেখতে পেতাম অথবা বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি।”
বর্তমান সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে পঞ্চমবার প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি ১৯৯৬ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। নতুন মন্ত্রিসভায় তিনি ছাড়া পূর্ণ মন্ত্রী কেবল একজন; দীপু মনি। চাঁদপুর-৩ আসন থেকে তিনি এনিয়ে চতুর্থবার নির্বাচিত হলেন। বাংলাদেশে পররাষ্ট্র ও শিক্ষার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে তিনি দুইবারের পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন।
তবে এবারের দ্বাদশ মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ হিসেবে প্রতিমন্ত্রী হচ্ছেন সিমিন হোসেন রিমি ও রুমানা আলী টুসি।
দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি গাজীপুর-৪ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয় পেয়েছেন। অপরদিকে, গাজীপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচিত রুমানা আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা রহমত আলীর মেয়ে।
শেখ হাসিনার গত মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে শুধু দীপু মনিই এবার তার অবস্থান টিকিয়ে রাখতে পেরেছেন।
গতবারের মন্ত্রিসভায় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন মন্নুজান সুফিয়ান। মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা। এছাড়া হাবিবুন নাহার ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপমন্ত্রী। তাদের মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য মন্নুজান সুফিয়ান এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। ইন্দিরাও সংসদ সদস্য নন। তবে হাবিবুন নাহার এবারও সংসদ সদস্য হয়েছেন।
২০১৪ সালে শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রিসভায় শেখ হাসিনা ছাড়া পূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। তিনি কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ওই সরকারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী ছিলেন ইসমত আরা সাদেক, ডাক ও টেলিযোগাযোগে ছিলেন তারানা হালিম, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ছিলেন মেহের আফরোজ চুমকি। তাদের মধ্যে মতিয়া চৌধুরী এখন সংসদের উপনেতা। ইসমত আরা সাদেক মারা গেছেন। চুমকি এবার নির্বাচন করলেও হেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় তিনজন নারী পূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন। তারা হলেন মতিয়া চৌধুরী, সাহারা খাতুন ও দীপু মনি। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতে সেবার নারীদের বসিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। মতিয়া কৃষিমন্ত্রী, সাহারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দীপু মনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাছাড়া প্রতিমন্ত্রী ছিলেন মন্নুজান সুফিয়ান। সেই মন্ত্রিসভায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন বর্তমান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে যেবার প্রথম সরকার গঠন করেন, সেবার মন্ত্রিসভায় দুজন নারীকে নিয়েছিলেন। তারা হলেন মতিয়া চৌধুরী ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। দুজনই ছিলেন পূর্ণ মন্ত্রী। সেবার কোনও নারী প্রতিমন্ত্রী ছিলেন না। সেবারের পরিবেশ ও বনমন্ত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ২০০৯ থেকে আমৃত্যু সংসদ উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন।