বিশ্বে প্রথমবারের মতো প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১২ মাসের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জলবায়ু পর্যবেক্ষক কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস বা সি৩এস। তাদের বিজ্ঞানিরা বলেছেন, এটি ‘মানবতার জন্য সতর্কবার্তা’।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ১২মাসে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা শিল্পযুগের আগের সময়ের (১৮৫০-১৯০০ সাল) চেয়ে ১ দশমিক ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল বলে জানিয়েছে সি৩এস।
২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে বিশ্বনেতারা সম্মত হয়েছিলেন, দীর্ঘমেয়াদে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে। জলবায়ু বিপর্যয় রোধে বিজ্ঞানীরা এই সীমা নির্ধারণ করেছিলেন।
এক বছরের তাপমাত্রা বেশি হয়েছে মানেই যে, প্যারিস চুক্তির সীমা অতিক্রম হয়ে গেছে বা জলবায়ু বিপর্যয় নেমে আসবে, তেমনটা বলা যায় না। তবে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা দীর্ঘমেয়াদে এভাবে বাড়তে থাকলে তা অবশ্যই আমাদের জন্য বিপদের কারণ হবে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কার্বন নির্গমন কমাতে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এখনও বিশ্ব উষ্ণায়নের গতি ধীর করা সম্ভব।
যুক্তরাজ্যের রয়্যাল মেটেরিওরোলজিক্যাল সোসাইটির প্রধান নির্বাহী প্রফেসর লিজ বেন্টলে বলেন, “বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করা অনেক বড় ঘটনা। এটি ভুল পথে আর একটি পদক্ষেপ। যদিও আমাদের কী করতে হবে, তা আমরা এখন জানি।”
দীর্ঘমেয়াদে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার শিল্পযুগের আগের সময়ের (মানুষ প্রচুর পরিমাণে জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানো শুরু করার আগের) গড় তাপমাত্রার উপরে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাটা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার প্রধান প্রতীক হয়ে উঠেছে।
২০১৮ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলে তীব্র তাপপ্রবাহ, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি এবং বন্যপ্রাণীর মৃত্যুর মতো ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক বিপর্যয় স্থায়ী হয়ে যাবে।
সদ্য শেষ হওয়া জানুয়ারি ছিল টানা ৮ম বারের মতো রেকর্ড উষ্ণ মাস। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলে আর্থ নামের একটি বিজ্ঞান গ্রুপ বলছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা শিল্পযুগের আগের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি ছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা তা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচেই রেখেছে।
অবশ্য এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, নিয়মিতভাবে তাপমাত্রার রেকর্ড রাখা শুরু হওয়ার পর থেকে পৃথিবী এখন সবচেয়ে উষ্ণতম সময়ের মধ্যে রয়েছে এবং সম্ভবত আরও দীর্ঘ সময়ের জন্য থাকবে।
রেকর্ড রাখা শুরুর করার পর থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও এখন সর্বোচ্চে উঠেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা সাধারণত টানা এক মাসের বেশি সময় ধরে বাড়ে না, কিন্ত এবার তেমনটাই ঘটেছে।
সারা বিশ্বের মহাসাগরগুলোও গত বছর সবচেয়ে উষ্ণ ছিল। বিশ্ব উষ্ণায়নের ৯০ শতাংশেরও বেশি তাপ পৃথিবীর মহাসাগরগুলোতে গিয়ে জমা হয়। সাগরের উচ্চ তাপমাত্রা এই পৃথিবীর দ্রুত উষ্ণায়নের একটি স্পষ্ট সূচক। যা থেকে বছর বছর তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং উষ্ণায়নের গতি যে বাড়ছে, তা প্রকাশ পায়।
সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়ায় ২০২৩ সালের কিছু সময়জুড়ে পৃথিবীর মেরু অঞ্চলে সমুদ্রে বরফের পরিমাণও রেকর্ড সর্বনিম্ন ছিল। দক্ষিণ গোলার্ধের শীতকালে অ্যান্টার্কটিকার সমুদ্রের বরফ আগের রেকর্ডের চেয়ে দশ লাখ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি কম ছিল, যা তাসমানিয়ার আকারের ১৫ গুণেরও বেশি।
ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৪ সাল আরও বেশি উষ্ণ হতে পারে। এ বছরের গড় তাপমাত্রা শিল্পযুগের আগের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি বাড়ার যুক্তিসঙ্গত আশঙ্কা রয়েছে।
কেন ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির সীমা অতিক্রম
দীর্ঘমেয়াদী উষ্ণায়নের পেছনে নিঃসন্দেহে মানুষের জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর মতো কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়াই দায়ী। এর কারণে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো গ্যাস নির্গত হয়। গত বছরের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী এটি।
তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এল নিনো নামে পরিচিত একটি প্রাকৃতিক জলবায়ুও বিশ্ব তাপমাত্রা বাড়ানোর পেছনে দায়ী। যদিও এল নিনো সাধারণত দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা বাড়ায় না।
২০২৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধে এল নিনো শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী বাতাসের গড় তাপমাত্রা প্রায় প্রতিদিনই ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করতে শুরু করে। ২০২৪ সালেও তা অব্যাহত রয়েছে।
আগামী কয়েক মাসে এল নিনোর তীব্রতা কমে আসবে। এতে বৈশ্বিক তাপমাত্রাও সাময়িকভাবে স্থিতিশীল হতে পারে এবং তারপরে সামান্য কমতে পারে, এমনকি তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সীমার নিচেও নেমে আসতে পারে।
কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার অবিলম্বে না কমানো হলে সামনের দশকগুলোতেও তাপমাত্রা বাড়তেই থাকবে।
কোপার্নিকাসের উপ পরিচালক সামান্থা বার্গেস বলেছেন, “গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন দ্রুত কমিয়ে আনাই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি থামানোর একমাত্র উপায়।”
এল নিনো কী
এল নিনো একটি সামুদ্রিক জলবায়ুগত পরিস্থিতি, যা কয়েক বছর পর পর ঘটে থাকে। গড়ে সর্বনিম্ন দুই বছর এবং সর্বোচ্চ ৭ বছর পরপর এল নিনো তৈরি হয়। প্রশান্ত মহাসাগরের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের জলরাশি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে তাকে এল নিনো বলে। যার প্রভাবে বায়ুমণ্ডলও উত্তপ্ত হয়ে উঠে এবং বিশ্বজুড়ে চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া দেখা দেয়। পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত গ্রীষ্মপ্রধান মধ্য ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা টানা তিন মাস সাধারণ গড় তাপমাত্রা থেকে দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকলেই সেই অবস্থাকে বলা হয় ‘এল নিনো’।
৯ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয় এই অবস্থা। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্য ও পূর্বভাগের জলরাশির তাপমাত্রা পশ্চিমভাগের চেয়ে ঠাণ্ডা থাকে। সে সময় বায়ু ও সমুদ্রস্রোত সাধারণত পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। সেই বায়ুর সঙ্গে মিশে যায় সূর্যের তাপও। সে কারণে সাধারণত প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমাঞ্চলের তথা এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের দিকের জলরাশির তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি গরম থাকে। কিন্তু এল নিনোর সময় এর উল্টোটা ঘটে। সে সময় পূর্বাঞ্চলে বায়ুর চাপ কমে যায় এবং বায়ু পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে তথা দক্ষিণ আমেরিকার দিকে প্রবাহিত হয় এবং পশ্চিম থেকে পূর্বমুখী গরম জলের স্রোতও তৈরি হয়। যার ফলে দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্য এবং পূর্বাঞ্চলের জলরাশিও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গরম হয়ে যায়।
এল নিনোর প্রভাবে দক্ষিণ আমেরিকার পেরু এবং ইকুয়েডরে বৃষ্টিপাত বেড়ে যায়, দেখা দেয় বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস। অন্যদিকে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায় দেখা দেয় খরা। শক্তিশালী এল নিনো হলে সারা বিশ্বের জলবায়ুর ওপরও প্রভাব পড়ে এবং বিশ্বের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়, বেড়ে যায় বৃষ্টিপাতও।
২০১৬ সালে সর্বশেষ শক্তিশালী এল নিনো ঘটেছিল। সে বছর বিশ্ব তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে গড়ে দশমিক ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গিয়েছিল। আর তাতেই ইতিহাসের উষ্ণতম বছরের তকমা পেয়েছিল ২০১৬ সাল। এরপর ২০১৯-২০২০ সালে একটি দুর্বল এল নিনো ঘটেছিল, যার ফলে দ্বিতীয় উষ্ণতম বছর হয়েছিল ২০২০ সাল।
২০২৩ সালের জুন-জুলাইয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের উপরিভাগের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা জলবায়ু মডেলগুলোতে বলা হয়েছিল, ২০১৬ সালের পর পুনরায় পৃথিবী শক্তিশালী এল নিনোর মুখোমুখি হয়েছে এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।
গত বছরের জুলাইয়ের প্রথম ২৩ দিনে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা এক মাসের তাপমাত্রা হিসেবে ইতিহাসের সর্বোচ্চ। কোপার্নিকাসের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, গত বছর জুলাই মাসের রেকর্ডকৃত গড় তাপমাত্রা এক মাসের তাপমাত্রার হিসাবে গত ১ লাখ ২০ হাজার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। কোপার্নিকাসের ডেপুটি ডিরেক্টর সামান্থা বার্গেস বলেন, ‘মানবজাতির ইতিহাসে এটি এক মাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।’
এ ছাড়া ২০২৩ সালের জুলাই মাসে পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো একদিনের গড় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। গত বছরের ৬ জুলাই বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ছিল ১৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ৩ জুলাই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পৃথিবীর এক দিনের গড় তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্পর্শ করে। ৬ জুলাই তা ১৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে, যা ছিল ইতিহাসের উষ্ণতম দিন। ৫ এবং ৭ জুলাইও বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে ছিল। এর আগের এক দিনের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রার রেকর্ডটি ছিল ২০১৬ সালের আগস্ট মাসের এক দিনের। সেদিন পারদ উঠেছিল ১৬ দশমিক ৯২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। গত বছরের ১৬ জুলাই চরম তাপমাত্রার আরেকটি রেকর্ড হয়েছিল ইরানে। সেদিন ইরানের পারসিয়ান গালফ ইন্টারন্যাশনাল বিমান বন্দরের তাপসূচক তাপমাত্রা উঠেছিল ৬৭ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন।
বিশ্ব উষ্ণায়ন কি এখনও থামানো সম্ভব
বর্তমানে যে হারে আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও কার্বন নির্গমন করছি তা অব্যাহত থাকলে আগামী দশ বছরের মধ্যেই বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করবে। তবে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করলেই যে জলবায়ু বিপর্যয় নেমে আসবে এমন নয়।
জাতিসংঘের ২০১৮ সালের যুগান্তকারী জলবায়ু প্রতিবেদনের প্রধান লেখক অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও গ্রেশাম কলেজের অধ্যাপক মাইলস অ্যালেন বলেছেন, “এটি এমন সীমা নয় যা অতিক্রম করলেই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।” বিজ্ঞানীদের মতে, এই সীমা হলো ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
“তবে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রমের পর থেকে মাঝেমধ্যেই তীব্র তাপপ্রবাহ, খরা, দাবানল ও বন্যার মতো চরম জলবায়ু সমস্যাগুলো দেখা দিতে শুরু করবে। গত এক বছরে আমরা বিশ্বজুড়ে এসব সমস্যা দেখেছি। আর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করলে এসব সমস্যা স্থায়ী হয়ে যাবে এবং জলবায়ু বিপর্যয় নেমে আসবে।”
গত বছর উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্মেকালে মারাত্মক তাপপ্রবাহ, কানাডা ও হাওয়াইতে বিধ্বংসী দাবানল এবং কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও চীনসহ অনেক জায়গায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে।
তবে আশার কথা হলো, বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবজাতি চাইলে এখনও বিশ্ব উষ্ণায়নের গতিপথ বদলে দিতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশেই নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও বৈদ্যুতিক যানবাহনের মতো সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এতে জলবায়ু মোকাবেলায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে।
তার মানে, এই শতাব্দীতেই বিশ্বের গড় তাপমাত্রা শিল্পযুগের আগের চেয়ে ৪ ডিগ্রি সেলাসিয়াস বেড়ে যাবে বলে যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল বর্তমান নীতি ও প্রতিশ্রুতির ফলে তার সম্ভাবনা অনেক কমে এসেছে। এক দশক আগেও এই সম্ভাবনা অনেক বেশি বলে ধারণা করা হয়েছিল।
আর সম্ভবত সবচেয়ে বড় আশার কথা হলো, বিজ্ঞানীরা এখনও মনে করেন, কার্বন নির্গমন অবিলম্বে শুন্যে নামিয়ে আনতে পারলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি কমবেশি বন্ধ হবে। এর জন্য চলতি দশকেই জীবাশ্ম-জ্বালানির ব্যবহার ও কার্বন নির্গমন কার্যকরভাবে অর্ধেকে নামিয়ে আনার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান গ্রুপ বার্কলে আর্থের জলবায়ু বিজ্ঞানী জিকে হৌসফাদার বলেছেন, “এর মানে পুরো মানবজাতি সামষ্টিকভাবে উদ্যোগ নিলে বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। জলবায়ু বিপর্যয় অনিবার্য নয়।”
জীবাশ্ম জ্বালানির যুগ শেষ হবে
অনেক আশার কথাই শোনাচ্ছে ২০২৪ সাল। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের কপ-২৮ জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে সম্মত হয়েছেন।
বিশ্ব অর্থনীতিতে— বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন, তাপ, রান্না ও শিল্প প্রক্রিয়ায় জীবাশ্ম জ্বালানি প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিও রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ক্লিন এনার্জি বা দূষণমুক্ত জ্বালানি প্রযুক্তি— বায়ু, সৌর ও ব্যাটারিচালিত এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা বাড়ছে। কয়লা চালিত কিংবা দহন ইঞ্জিনের মতো দূষণকারী প্রযুক্তিগুলোও ধীরে ধীরে স্থানচ্যুত হচ্ছে।
২০২৩ সালে বিশ্বের ৫১০ বিলিয়ন ওয়াট পুনর্নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের ক্ষমতা বেড়েছে, যা ২০২২ সালের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি এবং জার্মানি, ফ্রান্স ও স্পেন সম্মিলিতভাবে যে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করে তার সমান। পরবর্তী পাঁচ বছরে বিশ্বের পুনর্নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন ক্ষমতা আরও দ্রুত গতিতে বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
বৈদ্যুতিক যানবাহনের বিক্রি বাড়ছে। ২০২৩ সালে বৈদ্যুতিক যানবাহন বিক্রি ৩১ শতাংশ বেড়েছে। গত বছর বিশ্বব্যাপী বিক্রি হওয়া সমস্ত নতুন গাড়ির প্রায় ১৮ শতাংশই ছিল বৈদ্যুতিক। অস্ট্রেলিয়ায় বৈদ্যুতিক গাড়ির বিক্রি গত বছর দ্বিগুণ হয়েছে এবং আশা করা হচ্ছে সামনে তা আরও দ্রুতগতিতে বাড়বে।
ক্লিন এনার্জি প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের অর্থ হলো, ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন কমতে শুরু করবে। বিভিন্ন দেশের সরকারের নীতি বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ) জানায়, গত বছরটিই সর্বোচ্চ কার্বন নির্গমনের শেষ বছর হবে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, দূষণমুক্ত প্রযুক্তির বিকাশ বর্তমান গতিতে অব্যাহত থাকলে ২০২৪ সাল থেকে কার্বন নির্গমন কমার সম্ভাবনা ৭০ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও জাপানসহ বড় অর্থনীতির দেশগুলো তাদের কার্বন নির্গমনের সর্বোচ্চ সীমা হয়তো গত বছরই ছুঁয়ে ফেলেছে। এরপর হয়তো আর এতো কার্বন নির্গমন করবে না তারা।
চীন বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম কার্বন নির্গমনকারী দেশ। গত বছর বিশ্বের মোট কার্বন নির্গমনের ৩১ শতাংশই করেছে চীন। তবে দূষণমুক্ত জ্বালানিতে বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে বাড়ার অর্থ হল ২০২৪ সালে চীনের কার্বন নির্গমন শুধু কমবেই না, বরং কাঠামোগত পতনের দিকেও যাবে।
এ ছাড়া দূষণমুক্ত ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎশক্তি, বিশেষ করে সৌরশক্তি উৎপাদনে চীন আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। একইভাবে ব্যাটারি ও বৈদ্যুতিক যানবাহন উৎপাদনও ব্যাপকভাবে বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমন কমে আসাটা আশাবাদের বড় কারণ। তবে শুধু তাই যথেষ্ট নয়। এরপরও বায়ুমণ্ডলে গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন হবে এবং তাপমাত্রাও বিপর্যয়করভাবেই বাড়াতে থাকবে। যতক্ষণ না আমরা গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন যতটা সম্ভব শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসছি।
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেল সতর্ক করেছে, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমন অবশ্যই ২০৩০ সালের মধ্যেই প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। কাজটি অনেক কঠিন, তবে অসম্ভব নয়।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, দ্য কনভারসেশন