আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার বড় মঞ্চে কালেভদ্রে জ্বলে ওঠেন বাংলাদেশের অ্যাথলেটরা। এসএ গেমস থেকে শুরু করে এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস, ইসলামিক সলিডারিটি গেমস বা অলিম্পিক গেমস- প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাফল্য খুঁজতে দরকার হয় অনুবীক্ষণ যন্ত্র। আসলে প্রতিভাবান অ্যাথলেট তুলে আনতে ব্যর্থ ফেডারেশনগুলো।
কিন্তু ফেডারেশন কর্তাদের চেয়ার টিকিয়ে রাখতে হলে মাঠে সাফল্য চাই। এজন্য তারা হাঁটতে শুরু করেছেন বিকল্প পথে। প্রবাসী অ্যাথলেট খোঁজেন হন্যে হয়ে। কাউকে পেলে তাকে নিয়েই শুরু হয় লম্ফঝম্ফ। তাদের সুবাদে কিছু একটা সাফল্য এলে তাদের চেয়ার অন্তত টিকে যায়।
কোন কোন প্রবাসী খেলছেন
২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে ওয়াইল্ড কার্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের হয়ে অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী জিমন্যাস্ট কাজী সাইক সিজার। খেলেছেন অস্ট্রেলিয়ার গোল্ডকোস্ট কমনওয়েলথ গেমসে ২০১৮ সালে। গত বছর বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসে খেলেছেন নিউজিল্যান্ডপ্রবাসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জিমন্যাস্ট আলী কাদের হক।
২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অ্যাথলেট আলিদা সিকদার ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়েও অংশ নেননি। আজারবাইজানে বাকুতে গিয়ে নিজের ইভেন্ট ১০০ মিটারে স্প্রিন্টে খেলতে নামার আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। আসলে প্রবাসীদের দিয়ে সাফল্য পেতে সংগঠকরা এমন মরিয়া হয়েছিলেন তিনি যে অন্তঃসত্ত্বা, সেটাই তারা জানতেন না।
লন্ডনপ্রবাসী সাঁতারু জুনায়না আহমেদ গত বছরে টোকিও অলিম্পিকে, ফিলিপাইনে বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপে এবং কাঠমান্ডুতে এসএ গেমসে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের হয়ে। গত বছরে চীনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের বক্সিং রিংয়ে নামেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী জিনাত ফেরদৌস। ইংল্যান্ডপ্রবাসী অ্যাথলেট ইমরানুর রহমান ২০২২ ও ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও হাঙ্গেরিতে অংশ নিয়েছেন বিশ্ব অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে। এরপর কাজাখস্তানে এশিয়ান ইনডোর গেমসে জেতেন সোনা। কিন্তু ইমরানুর গত বছর চীনের হাংজুতে এশিয়ান গেমসে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে বাদ পড়েন সেমিফাইনালে।
ফুটবলে জামাল ভূঁইয়ার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ডেনমার্কে, বর্তমানে জাতীয় দলের অধিনায়ক তিনি। তার মতো আরেক প্রবাসী ফুটবলার তারিক কাজী। ফিনল্যান্ডপ্রবাসী এই ডিফেন্ডার জাতীয় দলের এখন নিয়মিত মুখ।
আদৌ কি প্রবাসীরা প্রত্যাশা পূরণে সফল
গত এশিয়ান গেমসে বক্সিং রিংয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়তে পারেননি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী জিনাত ফেরদৌস। ইংল্যান্ডপ্রবাসী অ্যাথলেট ইমরানুর রহমান ১০০ মিটার স্প্রিন্টের সেমিফাইনালে হেরে যান। এশিয়ান গেমসে যে আশা নিয়ে দুই প্রবাসীকে এনেছিল অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন , এর ছিটোফোঁটাও পূরণ হয়নি। জিনাত, ইমরানুরের আগে জিমন্যাস্ট সাইক সিজার, আলী কাদের, সাঁতারু জুনায়না আহমেদের মতো প্রবাসীরাও পারেননি প্রত্যাশা পূরণ করতে। তাদের সুবাদে আসেনি কোনো বড় সাফল্য।
২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশ ফুটবল দলে খেলা জামাল ভূঁইয়ারও সাফল্য কই। এই ডেনমার্ক প্রবাসীর পায়ে এমন কোনো জাদুকরী নেই যে, জাতীয় দলকে দুর্দান্ত কিছু উপহার দেবেন।
সুযোগ চান দেশী অ্যাথলেটরা
লন্ডনপ্রবাসী অ্যাথলেট ইমরানুর রহমান প্রথমবার বাংলাদেশে আসেন ২০২১ সালে। এরপর থেকে অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সব কার্যক্রম যেন তাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সব প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে শুধুই ইমরানুর প্রতিনিধিত্ব করেন। আর ইমরানুরের সঙ্গে সফরসঙ্গী হিসেবে প্রতিটি গেমসে যাচ্ছেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রকিব মন্টু।
প্রবাসী খেলোয়াড়দের পেছনে খরচ না করে বরং দেশীদের সুযোগ দিলে গল্পটা অন্যরকমও হতে পারতো।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অ্যাথলেট ক্ষোভের কথাগুলো বলছিলেন এভাবেই, ‘শুধু ইমরানুর না সব ফেডারেশনই বিদেশি খেলোয়াড়দের আনার চেষ্টা করছে। কারণ তাদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্যেই এমটা করছেন তারা।”
এক্ষেত্রে ফেডারেশনের পরিকল্পনাহীনতাকেই দায়ী করছেন তিনি, কোনো ফেডারেশনই দীর্ঘমেয়াদী ক্যাম্প করাচ্ছে না। কোনো পরিকল্পনা নেই। খেলাও হচ্ছে বছরে মাত্র একবার। তারা যখন দেখেন প্রবাসীরা সারা বছর ট্রেনিং করে ভালোমানের, ওদের আন্তর্জাতিকমানের সরঞ্জাম আছে, পারফরম্যান্সও আছে। বিনা বিনিয়োগে এখন বাইরে থেকে অ্যাথলেট এনে রেজাল্ট পাচ্ছে। এটা করে সবাইকে দেখাচ্ছে ফেডারেশন খুব ভালোভাবে চলছে। সংগঠকরাও কাজ করছে। এই কারণে প্রকৃতপক্ষে দেশি অ্যাথলেটরা আড়ালেই থাকছি। পারফরম্যান্সও দেখাতে পারছি না। কারণ আমাদের প্রতিযোগিতা নেই, সুযোগ-সুবিধা নেই। বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।”
একজন প্রবাসীর ওপরই ভরসা করতে চায় ফেডারেশন, এমনটাই দাবি ওই অ্যাথলেটের, “বিদেশিদের নিয়ে গেলে আশায় থাকে একজনকে দিয়েই তো রেজাল্ট পাচ্ছি। এত জনকে নেওয়ার দরকার নেই। এজন্য দেশের অ্যাথলেটরা হতাশ হয়ে যে কোনো খেলাতেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে ”
সংগঠকদের মান নিয়ে মাবিয়ার প্রশ্ন
প্রবাসী অ্যাথলেটদের এভাবে দেশে এনে খেলানোর বিষয়টাকে মোটেও ভালোভাবে দেখছেন না অন্য অনেক ডিসিপ্লিনের খেলোয়াড়েরা। এসএ গেমসে সোনা জয়ী ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার প্রশ্ন তুলেছেন সংগঠকদের যোগ্যতা নিয়ে, ‘ প্রথমত বলব যে সব ফেডারেশন বা যে ডিসিপ্লিনে দেশের বাইরে থেকে খেলোয়াড় এনে খেলাচ্ছে তাদের নিজের দেশে খেলোয়াড় তৈরি করার যোগ্যতা নেই। সংগঠক হওয়ারও যোগ্যতা নেই।”
প্রবাসী ও দেশি খেলোয়াড়দের মধ্যে রীতিমতো বিভাজন রেখা তৈরি করে ফেলেছেন সংগঠকরা। এমনটাই অভিযোগ মাবিয়ার, “আরেকটি বিষয় খারাপ লাগে, মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে সাফল্য পেয়েছি আমি। আমাদের ৫ লাখ টাকা দিতেই কষ্ট হয়। অথচ অন্যান্য ডিসিপ্লিনের বিদেশি অ্যাথলেট এনে ১০ লাখ টাকা দিচ্ছেন। ও কোথায় ট্রেনিং করেছে? আমি কোথায় ট্রেনিং করেছি? আপনি আমার জন্য কিছু করেননি, ট্রেনিংয়ের সুযোগ দেননি অথচ বিদেশে যারা এসির নিচে থেকেছে তারা সঠিক খাবার, ডায়েট, মেডিসিন সুবিধা পেয়ে এসেছে। তাদের সঙ্গে কেন তুলনা করবেন আমাদের।”
সঙ্গে যোগ করলেন, “হুট করে গেমস শুরুর আগে বললেন বিদেশি খেলোয়াড় যাবে, তোমরা যাবে না। তাদের সঙ্গে আমাদের তুলনা যারা করে, এটা কি ঠিক করে? যাদের এনে খেলাচ্ছে তারা কি আমাদের চেয়ে খুব ভালো? যদি ভালোমানের খেলোয়াড় হতো তাহলে সেই দেশের জাতীয় দলে খেলতো। তখন তারা বাংলাদেশের মতো দেশে খেলার আগ্রহ দেখাতো না।”
সর্বশেষ এশিয়ান গেমসে প্রবাসী খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সের তুলনা করে মাবিয়া বলেন, ‘ এশিয়ান গেমসে বিদেশি যারা খেলেছে তাদের রেজাল্ট দেখুন। আমাদেরটাও দেখুন। বলেন করা সেরা। আমি মাবিয়া হয়েছি সঠিক ট্রেনিং না পেয়ে, সঠিক ডায়েট না পেয়ে। আমি মনে করি বিদেশি অ্যাথলেট এনে আমাদের অপমান করা হচ্ছে। এশিয়ান গেমসে ইমরানুর কি করেছে সবাই জানে। সে যদি খুব ভালো অ্যাথলেট হতো তাহলে সেই দেশেই জাতীয় দলে খেলতো। বক্সিংয়ে যে মেয়ে খেলেছে ওর র্যাঙ্কিং কিন্তু আমার চেয়ে ভালো না। এনএসসির পুরো জিমনেশিয়াম দখলে জিমনেস্টিকস ফেডারেশনে। তারপরও ওরা ডিসকোয়ালিফাই হয় কিভাবে?’
সত্যিকারের ট্রায়াল কি নেওয়া হয়?
২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে সাইক সিজারকে এনেছিল জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন। চোটে আক্রান্ত সিজার অলিম্পিকে হতাশ করার পর কমনওয়েলথ গেমস ও এশিয়ান গেমসেও প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তি মেলাতে পারেননি। এরপর নিউজিল্যান্ড প্রবাসী আলী কাদেরের দিকে ঝোঁকে জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন। ২০২২ বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসে কাদের ব্যর্থ হন।
লন্ডনপ্রবাসী সাঁতারু জুনায়না ২০২২ বছরের কাঠমান্ডু এসএ গেমসে হতাশার পর হারিয়ে যেতেই বসেছেন। চিকিৎসক হওয়ার উদ্দেশ্যে পড়াশুনা করছেন ইংল্যান্ডের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এটা সত্যি, বিশ্বের অনেক দেশেই প্রবাসী অ্যাথলেটরা পদক মঞ্চে উঠে আলোকিত করেন। কিন্তু বাংলাদেশ দলে নেওয়ার আগে তাদের সত্যিকারের ট্রায়াল নেওয়া হয় না। এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম শুধু ফুটবল। ট্রায়াল দিয়েই জাতীয় দলে খেলছেন জামাল ও তারিক কাজী।
বৃত্ত ভাঙতে চায় জিমন্যাস্টিকস
প্রবাসী খেলোয়াড় এনে সাফল্যের রাস্তায় হাঁটতে ব্যর্থ জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশনের এখন হুঁশ ফিরেছে। দেশি খেলোয়াড়দের দিকেই বেশি নজর দেওয়ার কথা পরিকল্পনা করছে তারা। ফেডারেশনের নতুন নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান নিজে ছিলেন বিকেএসপির ছাত্র। এ সাবেক জিমন্যাস্ট এবার প্রবাসী আনার বৃত্তটা ভাঙতে চান, “আলী কাদিরের মতো প্রবাসীদের আগে দেশি খেলোয়াড়দের সঙ্গে ট্রায়ালে আসতে হবে। দল নির্বাচনের সময় যোগ্যতা প্রমাণ করে সুযোগ পেতে হবে।”
দেশিদের ওপরই আস্থা রাখতে চান তিনি, “আসলে সাইক সিজারের সঙ্গে যদি তুলনা করি, আমরা কিন্তু ভালো ছিলাম ওর চেয়ে। শুধু সঠিক সুযোগ সুবিধার অভাবে প্রমাণ করতে পারিনি নিজেদের। সাইক সিজার যখন অলিম্পিকে খেলে তখন ৩-৪ বছর জাতীয় জিমন্যাস্টিকস হয়নি। আর বিদেশে পাঠানো তো দূরের কথা। এখন বিদেশি কোচ আছে। যুব দলটা ভালো করছে। সিনিয়র দলটাও দাঁড়িয়ে গেছে। আগে শুধু অংশ নেওয়ার জন্যই যেতাম বিদেশে। এখন আশা করি সেটা হবে না। এই কারণেই আমার প্রাধান্য স্থানীয়দের ওপর। সাইক সিজার যদি করতে পারে, কেন এরা পারবে না? সঠিক সুযোগ সুবিধা পেলেই হবে। শুধু সঠিক খেলোয়াড় নির্বাচন করতে হবে।”
খেলোয়াড়ের আগে দরকার খেলা। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সেটা নিয়মিতকরণের ব্যবস্থা করলে আর দুর্বিপাকে পড়তে হয় না ফেডারেশন কর্মকর্তাদের। চেয়ার হারানোরও ভয় থাকে না।