“তার নাম ফিলিস্তিন
তার পোশাক আর তার দুঃখগুলো ফিলিস্তিন”
– মাহমুদ দারবিশ
ফিলিস্তিনের কবি মাহমুদ দারবিশ কোন এক ফিলিস্তিনি বন্ধুর পোশাকে আর দুঃখে ফিলিস্তিনকে খুঁজে পেয়েছিলেন। পোশাকতো শুধুই ব্যক্তির কথা বলেনা, বলে তার সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের কথাও। তেমনি বেদনাও খুব ব্যক্তিগত কি? যে জাতি হারিয়েছে তাদের জমি-জিরাত, প্রতিরোধ লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে তাদের আপনজন; তাদের দুঃখ একই সুতোয় গাঁথা। তাদের সকলের বেদনায় মূর্ত যেন ফিলিস্তিন। মাহমুদ দারবিশ তাই ফিলিস্তিনকে খুঁজে পেয়েছেন দুঃখে অথবা কারও পোশাকে।
একদিন হয়তো এমন একজন’ও বেঁচে থাকবেনা যার দুঃখে কিংবা পোশাকে আমরা ফিলিস্তিনকে খুঁজে পাবো। ইজরাইলি আগ্রাসনে ফিলিস্তিনের উৎসব, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি আজ ধ্বংসের মুখে।
ফিলিস্তিনি জনগনের উৎসবের প্রাণ তাদের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খাবার। এই লেখায় তেমনই কিছু খাবারের মধ্য দিয়ে আমরা খুঁজে ফিরবো ফিলিস্তিনকে।
ফিলিস্তিনি ক্যুজিন মানেই মন-মাতানো সুবাসে ভরা সব খাবার। যেগুলো মূলত ভূমধ্যসাগরীয় এবং মধ্যপ্রাচ্যীয় খাবার দাবারেরই ঐতিহ্য বহন করে। যদিও পরিবেশনা, বৈচিত্র এবং রন্ধনে আছে ফিলিস্তিনের নিজস্ব রীতি। এই রীতির হেরফের আছে শহর থেকে গ্রামে এমনকি উপকূলবর্তী অঞ্চলের সাথে মূল ভূ-খন্ডের।
পশ্চিম তীর যেমন ভারী খাবার দাবার আর জলপাই তেলের জন্য সুপরিচিত। অন্যদিকে গাজা স্ট্রিপ এবং অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলগুলো সামুদ্রিক মাছ এবং মশলায় সমৃদ্ধ।
এই সমস্ত পার্থক্য নিয়েই ফিলিস্তিনি খাবার দাবার মৌলিকভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ।
মাসাখানন
মাসাখানন ফিলিস্তিনের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী খাবার। স্বাদে এবং গন্ধে অতুলনীয় এই খাবারের মূল উপাদান জলপাই তেল। জলপাই গাছ ফিলিস্তিনি সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সে দেশে এর অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দুই গুরুত্বই আছে। ফিলিস্তিনি ‘সুমুদ’ এর প্রতীক এই জলপাই গাছ। ‘সুমুদ’ হলো ইজরেলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজ বাসভূমে বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছা।
মাসখানন খাবারটি প্রস্তুত করতে প্রয়োজন হয় মুরগীর ভূনা মাংস এবং ডুবু তেলে ভাজা মিষ্টি পেঁয়াজ। সে তেল অবশ্যই জলপাই তেল। এই খাবারের অসাধারণ স্বাদের পেছনে যে মশলার ভূমিকা প্রধান সেটি হলো সামাক। সামাক মিষ্টি পেয়াজে ডুবু তেলে ভেজে এক বিশেষ রুটির উপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়। রুটির উপর আরও সাজিয়ে দেওয়া হয় মুরগীর ভুনা মাংস।
মাকলুবা
মাকলুবা ফিলিস্তিনের প্রথম জাতীয় খাবার। মাকলুবার সাথে জড়িয়ে আছে ফিলিস্তিনের সংস্কৃতি, উৎসব এবং স্মৃতিকাতরতা। এই খাবার ফিলিস্তিনিদের মাঝে এমনই উৎসবের আমেজ তৈরি করে; যা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ফিলিস্তিনিদের তো বটেই, খোদ ফিলিস্তিনে বসরাতরত মানুষদেরও নস্টালজিক করে ফেলে।
ফিলিস্তিনিদের কাছে জুম্মাবার মানেই মাকলুবা।
কিন্তু কী থাকে এই মাকলুবায়?
মাকলুবা হল সুগন্ধী চাল, নানা পদের ফ্রাইড ভেজিটেবল, রোস্টেড মুরগীর মাংস এবং হামুস নামের এক বিশেষ পদের মিশেলের তৈরি এক মজাদার খাবার।
সিমাঘিয়া
সিমাঘিয়া এক অতি প্রাচীন ফিলিস্তিনি ডিশ। মূলত গাজার ঐতিহ্যবাহী খাবার এটি। খাবারের মূল উপাদানটি হলো সামাক (Summac)। সামাক থেকেই ‘সামাঘিয়া’ নামকরণ। বিয়ে, উৎসব বিশেষত ঈদুল ফিতরে এই খাবারটি বাড়ি বাড়ি প্রস্তুত করা হয়। পেয়াজ, মরিচ এবং আচার সহযোগে খাবারটি পরিবেশন করা হয়।
মাফতুল
মাফতুল হলো কসকসের’ই ( couscous) একটি সাব ডিশ। কসকস হলো একধরনের পাস্তা। ফিলিস্তিনি কসকস এর দানাগুলো অবশ্য মরোক্কইয়ান কসকসের চেয়ে কিছুটা বড় হয়।
মাফতুলে থাকে সাধারণত কসকস, যেগুলো শুকনো ডিল (Dry Dill) সহযোগে স্টিমড করা হয়।
কেদরেহ
কেদরেহ হেব্রন শহরের এক অতি প্রাচীন খাবার। হেবরন ফিলিস্তিনের সাউদার্ন ওয়েস্ট ব্যাংকের একটি শহর। এই খাবারের অথেনটিসিটি একে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। রান্নার সেই আদী প্রক্রিয়া এবং উপাদান আজও ঠিক একই আছে। উপাদানে আছে ভেড়ার দুধ হতে সংগৃহীত ঘি, চাল এবং চালকে সোনা রঙ দেওয়ার জন্য যুক্ত করা হয় হলুদ, অবশ্যই লবন এবং সব শেষে মাংস।
এক বিশেষ ধরনের ঐতিহ্যবাহী তামার পাত্রে কেদরেহ রান্না করা হয়। এই পাত্র শুধুমাত্র কেদরেহ রান্নার জন্যই বিশেষভাবে তৈরী। বলা হয়ে থাকে, এই বিশেষ পাত্রে রন্ধনকৃত কেদরেহ’র স্বাদ স্টেইনলেস স্টিলে রান্না করা কেদরেহ’র চাইতেও ২০ গুণ বেশি।
এমনকি কেদরেহ রান্নায় এক বিশেষ ধরনের ট্র্যাডিশনাল চুলাও ব্যবহার করা হয়।
সূত্রঃ শেফ পেন্সিল