যুক্তরাষ্ট্রের ইস্ট হলিউডের একটি খাবারের দোকানের দৃশ্য। দোকানটিতে কাজ করেন পায়ো। তিনি স্টলের এক কোণে মুরগি, কার্নে আসাদা, আলু ও রিবস গ্রিল করছিলেন।
তিন বছর আগে তিনি দক্ষিণ মেক্সিকোর ওয়াক্সাকা রাজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। বর্তমানে তার এক বছরের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেই ওই শিশুর জন্ম হয়েছে।
তবে যে দেশকে পায়ো এখন ‘নিজের বাড়ি’ বলে মনে করেন, সেই দেশে কাজ করাটাও এখন তার কাছে বিপজ্জনক মনে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ অনিবন্ধিত অভিবাসীর জন্য ভয় ও অনিশ্চয়তা যেন জীবনের একটি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন যেভাবে একের পর এক কঠোর অভিবাসন অভিযান চালাচ্ছে এবং প্রতিবাদের বিরুদ্ধে ন্যাশনাল গার্ড ও ৭০০ জন মেরিন মোতায়েন করছে, তাতে লস অ্যাঞ্জেলেসের অভিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের কাছে সাম্প্রতিক দিনগুলো আলাদা মনে হচ্ছে।
পায়ো বলেন, “আমি সবসময় স্নায়ুচাপে থাকি। রাস্তায় বের হওয়াটাও এখন একটু ঝুঁকির।”
তবুও তিনি মনে করেন, তার পক্ষে কাজ না করে উপায় নেই। কারণ তাকে তার মেয়ের দায়িত্ব নিতে হয়। একই সঙ্গে মেক্সিকোতে থাকা পরিবারের দিকেও খেয়াল রাখতে হয়।
তিনি বলেন, “আমি এখানে আগে কখনও এমন অনুভব করিনি। আপনি যখন বাড়ি থেকে বের হন, তখন আপনি জানেন না, আপনি ফিরে আসতে পারবেন কি না।”
আতঙ্কের ছায়া
ইস্ট হলিউড শহরের কেন্দ্রস্থল লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত। গত শুক্রবার থেকে সেখানকার বিভিন্ন স্থানে বড় বড় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
কিছু কিছু প্রতিবাদ সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষও ঘটছে। স্থানীয় কর্মকর্তারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন যে তিনি পরিস্থিতি শান্ত করার বদলে উসকে দিচ্ছেন।
এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, রাস্তাগুলো এখন অনেক শান্ত। বাইরে মানুষের আনাগোনা অনেক কমে গেছে। অনেকে অভিবাসন অভিযানের ভয়েই আর বাইরে যাচ্ছেন না।
একটি হাসপাতালে ক্লিনারের কাজ করা হোসে মেদিনা বলেন, “মানুষ খুব একটা বাইরে বের হচ্ছে না। তারা কাজেও যাচ্ছে না, কারণ তারা ভয় পাচ্ছে।” তিনি প্রায় ৪৫ বছর আগে এল সালভাদর থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে এসেছিলেন।
তিনি বলেন, এই শহরের বড় লাতিনো জনসংখ্যাই তাকে এখানে টেনেছিল। ২০২৩ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, লস অ্যাঞ্জেলেসের প্রায় ৪০ শতাংশ পরিবারের ভাষা স্প্যানিশ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই শহরের লাতিন আমেরিকান ঐতিহাসিক সম্পর্ক অনেক পুরোনো।
মেদিনা বলেন, “এটি একটি সুন্দর শহর, এটি পরিশ্রমী মানুষের শহর।” তিনি জানান, অভিবাসী শ্রমিকরা সাধারণত নির্মাণ, বাগান পরিচর্যা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মতো কষ্টসাধ্য কাজ করে থাকেন।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে লস অ্যাঞ্জেলেসসহ পুরো রাজ্যে পরিচালিত অভিবাসন অভিযানগুলো বেশিরভাগ সময় কর্মস্থল লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়েছে। এতে অভিবাসীদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর মনোভাব এই উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
পাসাডেনা কমিউনিটি জব সেন্টারের পরিচালক জোসে মাডেরা বলেন, “আপনি খবরে যা দেখেন এবং কর্মকর্তারা যা বলেন, সেটা হচ্ছে তারা নাকি কেবল সবচেয়ে সহিংস অপরাধীদের ধরছেন। কিন্তু আমরা জানি সেটা সত্যি না।” এই সেন্টারটি দিনমজুরদের সহায়তা করে।
তিনি আরও বলেন, “দিনমজুরি কাজে যদি আপনি একদিন না যান, তবে হয় আপনি বাড়ি ভাড়ার টাকা দিতে পারবেন না, নয়তো আপনার পরিবারের খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবেন না। এটাই প্রতিদিন প্রতিটি দিনমজুর এবং অভিবাসীর জন্য সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত।”
তিনি আরও বলেন, যেসব ব্যক্তিকে আটক করা হচ্ছে এবং পরে যাদের নির্বাসিত করা হচ্ছে, তাদের প্রক্রিয়াগত অধিকার অনেক সময় মানা হচ্ছে না।
এক ২৩ বছর বয়সী যুবককে শুক্রবার গ্রেপ্তার করার পর মেক্সিকোতে পাঠানো হয়। তার বাবা-মা দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে জানান, সেই যুবক সম্ভবত একটি কোভিড-১৯ পরীক্ষার সম্মতিপত্র ভেবে একটি ফর্মে স্বাক্ষর করেছিল। তবে সেটি হয়তো নির্বাসনে সম্মতির দলিল ছিল।
আদালতসহ যেসব স্থানকে সাধারণত অভিবাসন অভিযান থেকে মুক্ত রাখা হতো, সেগুলোও এখন নিরাপদ নয়। লস অ্যাঞ্জেলেসের স্কুল কর্তৃপক্ষ সোমবার বলেছে, শিক্ষার্থীদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অভিভাবকরা যাতে নিরাপদ বোধ করেন, তার জন্য প্রতিটি স্কুলে নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হবে।
ইস্ট হলিউডের এক সেলুনের মালিক মারলেন মারিন বলেন, তিনি গত ৩৫ বছর ধরে লস অ্যাঞ্জেলেসে বসবাস করছেন। তিনি মূলত পেরুর রাজধানী লিমা থেকে এসেছেন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক দিনগুলো তাকে মহামারি কোভিড-১৯ এর শুরুর সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন মানুষ ঘর থেকে বের হতো না এবং রাস্তাগুলো ফাঁকা পড়ে থাকত।
তিনি বলেন, “মানুষ খুব উদ্বিগ্ন। আমাদের দোকানে তেমন ক্রেতা আসছে না। মানুষ বাইরে না বের হলে দোকান ও ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার বড় অর্থনৈতিক প্রভাব পড়ে।”
বিরোধিতার ইতিহাস
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের মেয়র ক্যারেন ব্যাস শহরের কেন্দ্র এলাকায় কারফিউ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্ত ভাঙচুর ও লুটপাট থামানোর উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে।
মারিন বলেন, “কিছু খারাপ লোক পুলিশ গাড়িতে আগুন দিচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি না, যারা এটা করছে তারা অভিবাসী।”
মঙ্গলবার দেওয়া এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, তিনি শহরটিকে “প্রাণী” এবং “এক বিদেশি শত্রুর” কবল থেকে “মুক্ত” করবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ও শুল্ক প্রয়োগ সংস্থা (আইসিই) সোশাল মিডিয়ায় একটি ছবি প্রকাশ করে। সেই ছবিতে দেখা যায়, ভারী অস্ত্রধারী সেনাদের সঙ্গে আইসিই কর্মকর্তারা একজন ব্যক্তিকে আটক করছেন।
তবে ট্রাম্পের বক্তব্যের বিপরীতে, একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে অভিবাসীরা অপরাধ করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারীদের তুলনায় অনেক কম ঝুঁকিপূর্ণ। ইস্ট হলিউডে একটি ছাউনি তলায় দাঁড়িয়ে পায়ো বলেন, “মানুষ এখানে এসেছে আরও ভালো কিছুর আশায়, নিজেদের পরিবারকে সাহায্য করতে।”
লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের ইতিহাসে প্রতিবাদ এবং অভিবাসী অধিকার আন্দোলনের একটি দীর্ঘ ও শক্তিশালী ঐতিহ্য রয়েছে। এ কারণে অনেক সময় স্থানীয় ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়েছে।
১৯৮০-এর দশকে এই শহর যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংচুয়ারি আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। এই আন্দোলন সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের সহায়তা দিত। বিশেষ করে এল সালভাদর ও গুয়াতেমালার মতো দেশগুলোর নাগরিকদের, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সামরিক সরকারগুলো ভয়াবহ দমন অভিযান চালাচ্ছিল।
রোমান ক্যাথলিক যাজক ফাদার লুইস অলিভারেস শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্রের কাছে লা প্লাসিতা গির্জায় শরণার্থী ও অনিবন্ধিত শ্রমিকদের আশ্রয় দেন। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশ অমান্য করে তাদের গির্জায় নিরাপদ স্থান দিয়েছিলেন। তখন অভিবাসন কর্মকর্তারা হুমকি দেন, যদি অলিভারেস সরকারি আদেশ না মানেন, তবে গির্জায় অভিযান চালানো হবে। তবে শেষ পর্যন্ত সরকার সেই হুমকি কার্যকর করেনি।
ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির সান্তা বারবারা ক্যাম্পাসের চিকানো স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মারিও গার্সিয়া অলিভারেসের জীবনী লিখেছেন। তিনি বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন যে ধরনের নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োগ করছে, তা আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে খুবই বিরল।
তিনি বলেন, “১৯৮০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগানের অভিবাসন নীতিতে আইএনএস (যা এখনকার আইসিই-এর পূর্বসূরি)–এর সামরিকীকরণ ছিল না। সেই নীতিতে ন্যাশনাল গার্ড বা মেরিন দিয়ে অনিবন্ধিত অভিবাসী ও মধ্য আমেরিকান শরণার্থীদের পক্ষে হওয়া প্রতিবাদ দমন করার কথা ছিল না।”
গার্সিয়া মনে করেন, ট্রাম্প এখানেই থেমে যাবেন না। সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো হয়তো আরও বড় কোনো পরিকল্পনার ভিত্তি তৈরি করছে, যেমন সামরিক শাসন জারি করা।
তিনি বলেন, “লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে অসাংবিধানিক দমনপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের। এই শহর শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় বারবার সোচ্চার হয়েছে। একটি অভিবাসী শহর হিসেবে অ্যাঞ্জেলেনোরা অভিবাসীদের কাজ ও অবদানের স্বীকৃতি দেয় এবং তাদের সমর্থন করে, হোক তারা বৈধ বা অবৈধ।”
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা