Beta
বুধবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
বুধবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৫

বিশ্বকাপকে ঘিরে পাওয়ার হিটারের দুশ্চিন্তা

পাওয়ার হিটিংয়ে আশা দেখাচ্ছেন তিন তরুণ। জাকের আলি, রিশাদ হোসেন ও তাওহীদ হৃদয়। ছবি : সংগৃহিত
পাওয়ার হিটিংয়ে আশা দেখাচ্ছেন তিন তরুণ। জাকের আলি, রিশাদ হোসেন ও তাওহীদ হৃদয়। ছবি : সংগৃহিত
[publishpress_authors_box]

২০২৪ সাল, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বছর। জুনের টুর্নামেন্ট নিয়ে বাংলাদেশের চিন্তা কেমন? এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের ২০২৩ সালটা ভাল কাটলেও গত মাসে (মার্চ) শ্রীলঙ্কা এসে সবার আত্মবিশ্বাস নাড়িয়ে দিয়েছে। তাই আরো বেড়েছে পাওয়ার হিটারের আক্ষেপ।

ভরসা যাদের ওপর

টি-টোয়েন্টিতে পরিকল্পনার ব্যাকরণটা এখন স্পষ্ট। টপঅর্ডারে কমপেক্ষ দুজন পাওয়ার হিটার চাই, ব্যাটিং অর্ডারে নিচের দিকেও ৬-৭ নম্বরেও থাকতে হবে দুজন। দলে মোট চারজন পাওয়ার হিটার থাকা বাংলাদেশের জন্য বাড়াবাড়ি। অন্তত দুজন স্পষ্ট পাওয়ার হিটার তো থাকতেই হয়।

বিশ্বের সব দলেই পাওয়ার হিটারের নাম চট করে বলে দেয়া যায়। ক্রিকেটের নবীনতম শক্তি আফগানিস্তানেও আছেন এমন ব্যাটার। রহমানুল্লাহ গুরবাজ এখন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের নতুন “হিটার।” আর বোলার হয়েও নিজেকে পাওয়ার হিটারে বদলে নিয়েছেন রশিদ খান। ক্রিজে গিয়েই ম্যাচ ঘুরিয়ে দেবেন এমন ক্রিকেটারদের তালিকায় অন্য দলগুলোর ক্রিকেটারদের নাম অনায়াসে বলে দেয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশ দলে?

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ২০০৬ সালে পা রেখে ১৭ বছর পরও বাংলাদেশে স্পষ্ট পাওয়ার হিটার তৈরি হয়নি। সময়ে সময়ে জিয়াউর রহমান, সাব্বির রহমান, ইয়াসির রাব্বি, মুনিম শাহরিয়ারদের ব্যাটে ঝলক দেখা গেলেও কেউই টেকেনি দুই মৌসুম। এখন আর জাতীয় দলের কাছেও নেই তারা।

এই ক্রিকেটারদের পর্যাপ্ত সুযোগও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ম্যাচে ধারাবাহিক পারফরমের দায়িত্বটা পালন করতে সবাই ব্যর্থ। তাই লিটন দাস, সাকিব আল হাসান, মেহেদি হাসান মিরাজ, মাহমুদউল্লাহ, মুশফিকুর রহিমদের মতো সাবলীল ব্যাটাররাই বাংলাদেশের ভরসা।

যারা আছেন তারাই বা কতটা ধারাবাহিক! সৌম্য সরকার ২০১৫ সাল থেকে জাতীয় দলে। কিন্তু নিয়মিত পারফরম করতে পারেননি কখনই।

সাত নম্বরের জন্য শামীম হোসেন পাটওয়ারীকেও তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু সুযোগ পেয়েও জাতীয় দলে জায়গা করতে পারেননি এই তরুণ। গত বিপিএলে তার ব্যাট হেসেছে একবার। এছাড়া মিডল অর্ডারে তাওহিদ হৃদয় দারুণ ছন্দে আছেন। বিপিএলে সেঞ্চুরিও পেয়েছেন।

সবশেষ শ্রীলঙ্কা সিরিজে ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব রিশাদ হোসেনের। পাওয়ার হিটার হিসেবে দুর্দান্ত করেছেন এই তরুণ। সৌম্য-শামীম-হৃদয়দের সঙ্গে এই তরুণকেও রাখতে হচ্ছে আলোচনায়।

তবে সত্যিকারের ফিনিশার হিসেবে এই বিপিএলে দুজন সফল ছিলেন। জাকের আলি অনিক ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। জাকের একটু বেশিই সফল ছিলেন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও তার ব্যাটে ঝড় উঠেছে। তাই ব্যাটিং অর্ডারে নিচের দিকে জাকের সবচেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।  

বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে সফল পাওয়ার হিটার ছিলেন আফতাব আহমেদ। ছবি : ক্রিকইনফো

ব্যাটিং টেকনিকের উন্নতি দরকার

বাংলাদেশে পাওয়ার হিটার না থাকার পেছনে অনেক কারণ। এখানে খুদে ক্রিকেটার তৈরিতে গলদকেই বড় সমস্যা হিসাবে দেখেন বিশেষজ্ঞ কোচরা। প্রথমে শুদ্ধ ব্যাটিং চর্চা, এরপর ইম্প্রোভাইজেশন। বেশিরভাগ ক্রিকেট একাডেমিতে শুদ্ধ ব্যাটিং শেখানোরই কোচ নেই বলে অভিযোগ আছে। 

তাই টেস্টে অমন কোনো উন্নতি নেই। তবে সময়ের সঙ্গে ওয়ানডে খেলাটা খানিকটা বুঝেছে বাংলাদেশ। ততদিনে ক্রিকেট বিশ্ব চলে গেছে টি-টোয়েন্টি যুগে। তাতে ২০ ওভারেই ৩০০ হয়ে যাচ্ছে! আর বাংলাদেশ ওয়ানডেতেই ৩০০ রান করতে পারছে না নিয়মিত। 

হালের টি-টোয়েন্টিতে কোন কোনো ব্যাকরণই দেখছেন না কোচ সরোয়ার ইমরান, “ক্রিকেটে ব্যাটিংয়ের টেকনিক এখন পুরোপুরি বদলে গেছে। এমসিসি বুকের ব্যাকরণ অনুযায়ী খেলা হলে এখন সফল হওয়া যাবে না। এখন ব্যাটারের মাথা যদি বলের লাইন থেকে সামান্য বাইরে যায় তাহলে পাওয়ার হিটিং সম্ভব না। বলের লাইনে আগে পা যেত, এখন পা গেলে ব্যাট আটকে যায়। মূল হল ব্যাট লিফট হাই থাকতে হবে।”

পাওয়ারি হিটিংয়ের বাধা হিসেবে শারিরিক শক্তিকে মানতে নারাজ এই কোচ, “শারিরিক শক্তি কম বা উচ্চতা ছোট সেটা ভূল কথা। দুনিয়ার অনেক পাওয়ার হিটাররাও ছোট গড়নের, তবুও তারা মারছে। এটা আসলে পুরোপুরি টেকনিক্যাল ব্যাপার। এটা অভ্যাসে আনতে হবে, পাওয়ার পজিশন তৈরি করা জানতে হবে, যেখান থেকে আমি সর্বোচ্চ পাওয়ার ব্যাবহার করতে পারবো সেটা বুঝতে হবে। এগুলো ঠিক না হলে পাওয়ার হিটার হওয়া সম্ভব না।”

পাওয়ার হিটিং সামর্থের জন্য জাতীয় দলে ‍সুযোগ পান জিয়াউর রহমান। কিন্তু ছিলেন পুরোপুরি ব্যর্থ। ছবি : ক্রিকইনফো

টুর্নামেন্ট সংখ্যা বাড়াতে হবে

বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা কোচ ধরা হয় মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনকে। তার চোখে পাওয়ার হিটার তৈরি করতে হলে এক বিপিএল দিয়ে কখনই সম্ভব নয়। এছাড়া ঢাকার ক্রিকেটে আছে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, এখানেও পাওয়ার হিটিং দেখা যায় না। এ দুই টুর্নামেন্টের বাইরে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ম্যাচ খেলার সুযোগ পান না। তাই অভ্যস্ততাও তৈরি হয়নি ব্যাটারদের।

সালাহউদ্দিন বলেন, ‘‘এক বিপিএল ছাড়া তো কোন টুর্নামেন্ট নেই। এক দলে সাতজন করে স্থানীয় ক্রিকেটার খেলতে পারে। সেখানে ওপেনার, মিডলঅর্ডার ও লোয়ার অর্ডারে একজন করে বিদেশী ক্রিকেটার আনা হয়। তাদের ওপরই ভরসা করা হয়। তখন স্থানীয় ক্রিকেটাররা তো সুযোগই পায় না। শুধু একটা টুর্নামেন্ট দিয়েই যদি মনে করেন ক্রিকেটাররা ম্যাক্সওয়েল, ডি ভিলিয়ার্সের মতো মারবে সেটা তো হয় না।’’

তার কথায় উঠে আসে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের সমস্যা,‘‘বিপিএলে অনেক ক্রিকেটাররা তো সুযোগই পায় না তাদের ভরসায় জায়গা ডিপিএল (ওয়ানডে ফরম্যাট)। সেখানে একজন খেলতে পারে বছরে ১১টা ম্যাচ। ভাগ্য ভাল থাকলে সুপার লিগে গেলে আরও ৫ ম্যাচ পায়। এই ১৬ ম্যাচ খেলে একটা ক্রিকেটার কিভাবে ৫০ ওভারের ক্রিকেট শিখবে বা নিজেকে জাতীয় দলের জন্য প্রস্তুত করবে? জেলা পর্যায়ে কোন টুর্নামেন্ট ধারাবাহিক ভাবে হয় না। আলাদা ফরম্যাটের কথা তো বাদই দিলাম। এটা ঠিক করার জন্য সদিচ্ছার দরকার ও চেষ্টারও দরকার। এখন এটা পুরোটাই বিসিবির উপর নির্ভর করছে।’’

মোহাম্মদ রফিককে ওপেনিংয়ে পাঠিয়ে বাংলাদেশ প্রথম পাওয়ার হিটার তৈরির চেষ্টা করে। ছবি : ক্রিকইনফো

প্রয়োজন উইকেটের চরিত্র বদল

বাংলাদেশের সেরা মাঠ ‘হোম অব ক্রিকেট মিরপুর’ পাওয়ার হিটার তৈরি হওয়ার বড় বাধা। মিরপুরের পিচে স্বচ্ছন্দে বড় শট খেলতে পারেন না কোন ব্যাটারই। ধীর ও নিচু এই উইকেট বদলে ব্যাটিং নির্ভর না করা হলে কখনই পাওয়ার হিটার তৈরি করা সম্ভব না বলে জানালেন দুই কোচ।

লোকাল ক্রিকেটে রান হলেও মিরপুরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বড় রান না হওয়াকে অদ্ভুত বললেন সারোয়ার ইমরান, ‘‘আমরা যখন লিগ খেলি তখন কিন্তু রান হয়। কিন্তু যখনই আন্তর্জাতিক খেলা হয় কোচ ও অন্যান্য সবাই মিলে উইকেট টা একদম অদ্ভুত বানিয়ে ফেলে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একটা টেস্ট জিতেছি সেটা কিন্তু অপ্রস্তুত উইকেটে খেলে। সেটাকে স্পিন উইকেটও বলা যাবে না। নিজের মাঠে এনে এভাবে প্রতিপক্ষকে ফাঁদে ফেললে আমাদের মান নিচের দিকেই যেতে থাকবো।’’

তিনি আফগানিস্তানের উদাহরণ টেনে বলেছেন, “আফগানিস্তানের কথা ভাবুন, ওদের তো নিজেদের মাঠ নেই। হোম সুবিধাও নেই। তবুও তারা ওয়ানডে বিশ্বকাপে চারটি ম্যাচ জিতেছে। সেখানে বাংলাদেশ জিতেছে মাত্র দুটি। আফগানিস্তানকে দেখেও বিসিবি শিখতে পারে। তাদের পাওয়ার হিটারের অভাব নেই। আসলে উন্নতি করতে হলে অনেক জায়গা জুড়েই ভাবতে হবে।”

বিশ্বকাপ ভরাডুবির পর কিছুটা পরিবর্তন দেখা গেছে। বিপিএলে ভালো উইকেট দিয়েছে। মিরপুরে রান হয়েছে, হৃদয়ের সেঞ্চুরিও এসেছে। চট্টগ্রামে সেঞ্চুরি করেছেন তামিম। টুর্নামেন্টের শেষদিকে মিরপুরেও রান হওয়ায় জমে উঠেছিল ব্যাট-বলের লড়াই।

এটাকে যখনই ইতিবাচক মনে করা হচ্ছিল তখনই শ্রীলঙ্কার কাছে দেশের মাঠে হেরেছে টি-টোয়েন্টি সিরিজ হেরেছে শান্ত-হৃদয়রা। আবারও প্রমাণ হলো, বাংলাদেশের পাওয়ার হিটিংয়ে ‘পাওয়ার’ নেই।  

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত