ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস গত ৭ অক্টোবর গাজা থেকে ইসরায়েলের ওপর ব্যাপক হামলা চালায়। এতে ১ হাজার ৩০০ জনের বেশি নিহত হয়, যাদের মধ্যে ইসরায়েলি ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক রয়েছে।
হামাসের নজিরবিহীন এই হামলায় হতভম্ব হয়ে পড়লেও প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেরি করেনি ইসরায়েল। হামাসের হামলার পরপরই গাজায় প্রতিশোধমূলক বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েলের বাহিনী। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় স্থল অভিযানও, যা আগে থেকেই দু্র্বিসহ পরিস্থিতিতে থাকা গাজার ফিলিস্তিনিদের জন্য বড় বিপর্যয় হয়ে দেখা দেয়।
গাজায় ইসরায়েলের হামলা রবিবার গড়িয়েছে ১০০ দিনে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০০ দিনে ইসরায়েলের হামলায় গাজায় ২৩ হাজার ৭০৮ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যার মধ্যে শিশুর সংখ্যাই ১০ হাজারের বেশি। আহত হয়েছে ৬০ হাজারের বেশি মানুষ। এছাড়া ৭ অক্টোবরের পর থেকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সেনাদের হাতে প্রাণ গেছে ৩৪৭ জনের, আহত হয়েছে চার হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। সবমিলিয়ে হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ২৪ হাজার ছাড়িয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ১৮ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে শুরু হওয়া সংঘাত নিজ ভূখণ্ডের জন্য লড়তে থাকা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে দখলদার ইসরায়েলের দ্বন্দ্বের বিষয়টি নতুন করে সামনে এনেছে, যার সূচনা হয়েছিল একশ’ বছরেরও বেশি আগে– ‘বেলফোর ঘোষণা’র মধ্য দিয়ে। ফিলিস্তিনিদের জন্য দুর্ভাগ্যের সূচনা করা সেই বেলফোর ঘোষণা জারি হয়েছিল ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর।
এই ঘোষণা ছিল ফিলিস্তিনে ‘ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য একটি জাতীয় আবাসস্থল’ প্রতিষ্ঠায় কার্যত যুক্তরাজ্যের একটি প্রতিশ্রুতি, যা ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জায়নবাদী লক্ষ্যকে বাস্তবে রূপ দেয়। যু্ক্তরাজ্যের এই প্রতিশ্রুতিকেই ‘নাকবা’ বা মহাবিপর্যয় হিসেবে পরিচিত ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে নিধনযজ্ঞ এবং জায়নবাদী দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের সংঘাতের পেছনে অন্যতম অনুঘটক হিসেবে দেখা হয়।
বেলফোর ঘোষণাকে আরব বিশ্বের আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা কয়েক দশক ধরে ইতিহাসবিদদের বিভ্রান্ত করেছে।
বেলফোর ঘোষণা কী
বেলফোর ঘোষণা হচ্ছে ১৯১৭ সালে প্রকাশ্যে যুক্তরাজ্যের দেওয়া এক প্রতিশ্রুতি, যেখানে ফিলিস্তিনে ‘ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য একটি জাতীয় আবাসস্থল’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করা হয়। ব্রিটিশ ইহুদি কমিউনিটির নেতা হিসেবে পরিচিত লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডকে উদ্দেশ্য করে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোরের লেখা একটি চিঠি আকারে এসেছিল এই ঘোষণা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) তৈরি হওয়া এই ঘোষণা অটোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির পর ফিলিস্তিনের জন্য ‘ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের’ শর্তাবলীতে অন্তর্ভুক্ত হয়। বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির প্রতিষ্ঠা করা তথাকথিত ‘ম্যান্ডেট’ ব্যবস্থা ছিল ঔপনিবেশিকতা ও দখলদারিত্বের আরেক রূপ। এই ব্যবস্থার আওতায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত শক্তি– জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান সাম্রাজ্য ও বুলগেরিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলগুলোর শাসনভার বিজয়ী দেশগুলোর হাতে চলে আসে।
‘ম্যান্ডেট’ ব্যবস্থার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল নতুন উদীয়মান রাষ্ট্রগুলো স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের শাসনভার সামলানোর সুযোগ বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী দেশগুলোকে দেওয়া। এই ব্যবস্থার আওতায় ফিলিস্তিনের শাসনভার ব্রিটিশদের ওপর ন্যস্ত হয়, যা ‘ব্রিটিশ ম্যান্ডেট’ হিসেবে পরিচিত। আর এই ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের প্রধান লক্ষ্যই ছিল সেখানে ইহুদিদের জন্য একটি ‘জাতীয় আবাসস্থল’ প্রতিষ্ঠার পরিস্থিতি তৈরি করা, যদিও সে সময় ফিলিস্তিনি অঞ্চলে জনসংখ্যার ১০ শতাংশেরও কম ছিল ইহুদি।
ফিলিস্তিনের শাসনভার পাওয়ার পর থেকেই ব্রিটিশরা ইউরোপে থাকা ইহুদিদের ফিলিস্তিনে অভিবাসনে সহায়তা দিতে শুরু করে। ১৯২২ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে ফিলিস্তিনি অঞ্চলে ইহুদিদের সংখ্যা ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৭ শতাংশে উন্নীত হয়।
বেলফোর ঘোষণায় একটি সতর্কতা অন্তর্ভুক্ত ছিল, যেখানে বলা হয়, “এমন কিছু করা যাবে না, যা ফিলিস্তিনে বিদ্যমান অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের বেসামরিক ও ধর্মীয় অধিকার ক্ষুণ্ণ করে”। তবে ‘ব্রিটিশ ম্যান্ডেট’ এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল, যাতে ফিলিস্তিনি আরবদের হটিয়ে সেখানে স্ব-শাসন প্রতিষ্ঠায় ইহুদিদের যথাযথভাবে প্রস্তুত করা যায়।
বেলফোর ঘোষণা কেন বিতর্কিত
বেশ কিছু কারণে বেলফোর ঘোষণা বিতর্কিত হয়ে পড়ে। প্রথমত, প্রয়াত ফিলিস্তিনি-আমেরিকান শিক্ষাবিদ এডওয়ার্ড সাঈদের মতে, “ইউরোপীয় শক্তির হাত ধরে নন-ইউরোপীয় অঞ্চলে এটি তৈরি হয়, যেখানে ওই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীর উপস্থিতি ও ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করা হয়।”
কার্যত, বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ইহুদিদের একটি ভূখণ্ডের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যেখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশেরও বেশি।
দ্বিতীয়ত, ঘোষণাটি ছিল ব্রিটিশদের দেওয়া যুদ্ধকালীন তিনটি সাংঘর্ষিক প্রতিশ্রুতির একটি। যখন এই ঘোষণা প্রকাশ করা হয়, তার আগেই যুক্তরাজ্য ১৯১৫ সালে আরবদের অটোমান সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এ ছাড়া ১৯১৬ সালে ফ্রান্সের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের একটি চুক্তি হয়েছিল, যা সাইকস-পিকো চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তিতে বলা হয়েছিল, বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের বেশিরভাগ অংশ আন্তর্জাতিক প্রশাসনের অধীনে থাকবে এবং ফিলিস্তিনের বাকি অংশ ঔপনিবেশিক দেশ দুটি (যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স) নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে।
তবে বেলফোর ঘোষণার অর্থ ছিল, ফিলিস্তিন ব্রিটিশ দখলদারিত্বের আওতায় থাকবে এবং সেখানে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি আরবরা কার্যত স্বাধীনতা পাবে না।
তৃতীয়ত, বেলফোর ঘোষণায় ‘জাতীয় আবাসস্থল’ বলে নতুন একটি ধারণার প্রবর্তন করা হয়, যার নজির আন্তর্জাতিক আইনে ছিল না। ‘রাষ্ট্র’ শব্দটির পরিবর্তে ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য ‘জাতীয় আবাসস্থল’-এর মতো অস্পষ্ট শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করার কারণে একেক জনের কাছে এর অর্থের ব্যাখ্যা দাঁড়ায় একেক রকম। এ ঘোষণার খসড়ায় ‘ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের পুনর্গঠন’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হলেও পরে বদলে ফেলা হয়েছিল।
১৯২২ সালে জায়নবাদী নেতা চাইম ওয়াইজমানের সঙ্গে এক বৈঠকে অবশ্য আর্থার বেলফোর ও তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ বলেছিলেন, বেলফোর ঘোষণা ‘সর্বদা চূড়ান্তভাবে একটি ইহুদি রাষ্ট্রকেই বোঝায়’।
বেলফোর ঘোষণা ফিলিস্তিনিদের ওপর কী প্রভাব ফেলে
বেলফোর ঘোষণাকে ব্যাপকভাবে ১৯৪৮ সালের ফিলিস্তিনি ‘নাকবা’ বা মহাবিপর্যয়ের পূর্বসূচক হিসেবে দেখা হয়, যখন ব্রিটিশদের প্রশিক্ষিত জায়নবাদী সশস্ত্র যোদ্ধারা সাড়ে ৭ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে তাদের আবাসস্থল থেকে উৎখাত করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাজ্যের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার একটি অংশ এ ধরনের সম্ভাব্য পরিণতির আভাস দিয়ে বেলফোর ঘোষণার বিরোধিতা করা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার শেষ পর্যন্ত ঘোষণাটি জারির পথেই এগোয়।
ফিলিস্তিনের বর্তমান অবস্থার কারণ বেলফোর ঘোষণায় নিহিত কি না তা সরাসরি বলা না গেলেও, ফিলিস্তিনে সংখ্যালঘু ইহুদিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন এবং ফিলিস্তিনি আরবদের উৎখাত করে তাদের (ইহুদি) জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের পরিস্থিতি যে ‘ব্রিটিশ ম্যান্ডেট’ই তৈরি করে দিয়েছিল তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা যখন তাদের ‘ম্যান্ডেট’ বাতিল করার এবং ফিলিস্তিনের ভবিষ্যতের প্রশ্নটি জাতিসংঘের কাছে ন্যস্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়, ততদিনে ইহুদিদের একটি সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা একটি আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের এই সেনাবাহিনী।
আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ফিলিস্তিনিদের জন্য নিষিদ্ধ করা হলেও ব্রিটিশরা ইহুদিদের ‘ইহুদি এজেন্সি’র মতো স্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুযোগ দিয়েছিল, যাতে তারা নিজেদের একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রস্তুত করে তুলতে পারে, যা ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে নিধনের পথ সুগম করে।
সূত্র: আল জাজিরা