ভারতে ২০১৬ সালের নভেম্বরে হঠাৎ করেই ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিল করা হয়। সেসময় ভারতীয়দের হাতে থাকা নগদ অর্থের ৮০ শতাংশই ছিল এই দুটি নোট। ক্ষমতাসীন মোদি সরকার দাবি করে, দুর্নীতি দমন ও অঘোষিত সম্পদ রোধে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
নোট বাতিলের এই ঘোষণায় দেশটির ব্যাংক ও এটিএম বুথগুলোর সামনে উন্মাদনার দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। সমালোচকদের মতে, এতে দেশটির নিম্ন আয়ের মানুষদের এবং অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়। কারণ, অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে সাধারণত নগদ অর্থে লেনদেন হয়।
তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ধারাবাহিকভাবে তার এই সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। মোদি বলেন, “নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত কালো টাকা কমাতে এবং কর সম্মতি ও আনুষ্ঠানিকতা বাড়াতে সহায়ক হয়েছে। আর্থিক স্বচ্ছতাও বেড়েছে।”
কিন্তু ৭ বছর পরে এসেও ভারতে নগদ অর্থের রাজত্ব অটুট রয়েছে। এতে নোট বাতিলের সেই বিতর্কিত সিদ্ধান্তের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নতুন করে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশটির অর্থনীতিতে নগদ অর্থ বেড়েছে ১৬.৬ শতাংশেরও বেশি। তার আগের দশ বছরে এই বৃদ্ধির হার ছিল বছরে গড়ে ১২.৭ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে নগদ অর্থের ব্যবহার জিডিপির হিসাবে ১৪ শতাংশের উপরে ওঠে। সেখান থেকে কমে ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ১৩ শতাংশে নামে।
কোনও দেশে নগদ অর্থ ব্যবহারের হিসাব বের করার একটি সাধারণ উপায় হলো—জিডিপিতে তার প্রবাহ কত।
স্মার্টফোন, ডেবিট কার্ডের ব্যবহার ও নাগরিকদের জন্য সরকারি সেবা বাড়ায় ডিজিটাল লেনদেনও বাড়ছে। আর এই ডিজিটাল লেনদেন বাড়ার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখছে ইউনিফাইড পেমেন্টস ইন্টারফেস (ইউপিআই)। এই প্ল্যাটফর্ম ফিনটেক অ্যাপের মাধ্যমে বাধাহীন ও প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে অ্যাকাউন্ট-টু-অ্যাকাউন্ট অর্থ স্থানান্তরকে সহজ করেছে।
ভারতে ইউপিআই লেনদেন গত বছর এক ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, যা দেশটির জিডিপির এক তৃতীয়াংশ। এসিআই ওয়ার্ল্ডওয়াইড ও গ্লোবাল ডেটা ২০২৩ এর হিসাব মতে, এ বছর ভারতে ডিজিটাল লেনদেন হয়েছে ৮ কোটি ৯০ লাখ বার। তার মানে বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল পেমেন্ট বা মূল্য পরিশোধের ৪৬ শতাংশই করেছে ভারতের নাগরিকরা।
নগদ ও ডিজিটাল মূল্য পরিশোধ একসঙ্গে বেড়ে চলার ঘটনাকে সাধারণত ‘কারেন্সি ডিমান্ড প্যারাডক্স’ বলা হয়। আরবিআইয়ের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সাধারণত ক্যাশ ও ডিজিটাল পেমেন্টকে একে অন্যের বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ডিজিটাল পেমেন্ট বাড়লে নগদ অর্থের ব্যবহার কমবে বলেই মনে করা হয়। তাই দুটোরই একসঙ্গে বাড়াটা অস্বাভাবিক মনে হয়।”
ভারতে ক্যাশ মেশিন থেকে অর্থ তোলার হার কমেছে এবং ক্যাশ ভেলোসিটি বা যে হারে ভোক্তারা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনীতিতে অর্থ বিনিময় করে তার গতিও ধীর হয়ে গেছে।
তবে বেশিরভাগ ভারতীয় এখনও নগদ অর্থ ঘরে রাখছে। বিপদ-আপদের জন্য ছাড়াও সঞ্চয় হিসেবেও এটি করে তারা। আরবিআইয়ের তথ্যমতে, গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত চালু থাকা মোট ব্যাংকনোটের মূল্যের ৮৭ শতাংশের বেশি দখল ছিল ৫০০ ও ২০০০ রুপির নোটের। তবে এ বছর ২০০০ রুপির নোটও তুলে নেওয়া হয়েছে।
কোভিড-১৯ মহামারীর আগের এক জরিপে দেখা গেছে, ছোটখাটো কেনাকাটায় নগদ অর্থের ব্যবহারই বেশি। আর বড় লেনদেনের ক্ষেত্রে ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যবহার হয়। কমিউনিটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম লোকালসার্কেলসের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, বেশিরভাগ মানুষ এখনও মুদিপণ্য, বাইরে গিয়ে খাবার খাওয়া, খাবার কেনা, কর্মীভাড়া, ব্যক্তিগত পরিষেবা ও বাড়ি মেরামতের জন্য নগদ অর্থের ব্যবহারই বেশি পছন্দ করেন।
আরবিআইয়ের এক প্রতিবেদন মতে, ব্যাংক আমানতে সুদের হার কমা, বড় আকারের অনানুষ্ঠানিক ও গ্রামীণ অর্থনীতি এবং মহামারীর সময় নগদে অর্থ সহায়তার পরিমাণ বাড়ার ফলেই হয়তো নগদ অর্থের ব্যবহার বেড়েছে।
রাজনীতি ও আবাসন খাতও নগদ অর্থের ব্যবহার বাড়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী তহবিলে প্রচুর নগদ অর্থ আসে। এই অর্থের বিশাল অংশই অঘোষিত বা কালো টাকা। (ভারতের আয়কর কর্মকর্তারা সম্প্রতি এমন ৩৫০ কোটি রুপির সন্ধান পেয়েছেন। বিরোধী দলের এক জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে এসেছে ওই অর্থ।) ২০১৮ সালে মোদি সরকার নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সুদমুক্ত নির্বাচনী বন্ড চালু করে। এর উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়, কালো টাকা বের করে আনা এবং রাজনৈতিক অর্থায়নকে আরও স্বচ্ছ করা। কিন্তু সমালোচকদের বিশ্বাস, এতে হিতে বিপরীত হয়েছে। স্বচ্ছতা আনার পরিবর্তে নির্বাচনী বন্ডগুলোও গোপনে লেনদেন হয়।
আবাসন ব্যবসায়ও ব্যাপক হারে কালো টাকার বিনিয়োগ চলছে। গত নভেম্বরে লোকালসার্কেলসের এক জরিপে দেখা গেছে, গত সাত বছরে যারা ভারতে আবাসন কিনেছেন তাদের ৭৬ শতাংশ নগদ অর্থ ব্যবহার করেছেন। আর ১৫ শতাংশ ক্রেতা অর্ধেকেরও বেশি মূল্য নগদ অর্থে পরিশোধ করেছেন। অথচ দুই বছর আগের জরিপে ৩০ শতাংশ উত্তরদাতার মধ্যে ২৪ শতাংশ বলেন, তাদের নগদ অর্থে মূল্য পরিশোধ করতে হয়নি। দেবেশ কাপুর ও মিলন বৈষ্ণবের গবেষণায় দেখা গেছে, আবাসন খাতে নগদ অর্থে লেনদেনের বড় কারণ রাজনীতিবিদদের সমর্থন ও অনুগ্রহের উপর আবাসন ব্যবসায়ীদের নির্ভরশীলতা।
ডিজিটাল পেমেন্ট ও নগদ অর্থে লেনদেন একসঙ্গে বাড়ার মতো এমন অস্বাভাবিক ঘটনা ভারতেই প্রথম ঘটেনি।
ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকও ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে ব্যাংকনোট নিয়ে এমন অস্বাভাবিক ঘটনার বিষয়টি উল্লেখ করে। তারা এর নাম দেয় ‘প্যারাডক্স অব ব্যাংকনোটস’ বা ব্যাংকনোটের ‘দ্বিমুখীতা’। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরো নোটের চাহিদা ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। অথচ খুচরা লেনদেনে নোটের ব্যবহার কমেছে। ব্যাপকভাবে ডিজিটাল পেমেন্ট চালুর ফলে খুচরা মুল্য পরিশোধে নগদ অর্থের ব্যবহার কমে।
কিন্তু ওই প্রতিবেদনে একটি অপ্রত্যাশিত প্রবণতারও উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, সার্বিকভাবে নগদ অর্থের চাহিদা কমেনি। এমনটি প্রকৃতপক্ষে ২০০৭ সাল থেকে প্রচলিত ইউরো নোটের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নগদহীন সুইডেন— এ ক্ষেত্রে অবশ্য একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম।
তবে ভারতে বেশিরভাগ মানুষ দৈনন্দিন লেনদেনের ক্ষেত্রে আরও বহুকাল নগদের ওপর নির্ভর করবে বলে মনে করছেন বিবিসির প্রতিনিধি সৌতিক বিশ্বাস। এ নিয়ে তিনি দিল্লির অটোরিকশা চালক অতুল শর্মার সঙ্গে কথা বলেছেন। অতুল বলেন, “আমার বেশিরভাগ গ্রাহক এখনও নগদে ভাড়া দেন। নগদ অর্থের প্রয়োজনীয়তা কখনোই ফুরাবে না।”