প্রবল বৃষ্টি, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মাধ্যমে মাইলের পর মাইল সড়ক আর ঘরবাড়ি ডুবিয়ে, মাছের ঘের ভাসিয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঘুর্ণিঝড় রেমাল।
ঝড়ের তাণ্ডবে এরই মধ্যে অন্তত ১০ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে মন্ত্রণালয়। দেয়াল ধসে, আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথেসহ নানা কারণে এদের মৃত্যু হয়েছে।
রবিবার রাতে যখন পটুয়াখালীর খেপুপাড়া অতিক্রম করছিল রেমাল তখন সেখানে ঘূর্ণিবায়ুর গতি রেকর্ড করা হয়েছিল ঘণ্টায় ১১১ কিলোমিটার, যা সর্বোচ্চ।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রেমালের অগ্রভাগ রবিবার দুপুরেই উপকূলে আসে। মধ্যরাতে কেন্দ্র উপরে উঠে আসে। এরপর ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা ধরে পুরো ঝড়টিই উপরে উঠে আসে। রাতভর চলে তাণ্ডব।
সোমবার ঘূর্ণিঝড় থেকে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে রেমাল। রেমালের প্রভাবে মঙ্গলবারও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝরবে বৃষ্টি, থাকবে ঝড়ো হাওয়াও।
১০ জনের মৃত্যু
সোমবার দুপুর ১টা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে রেমালের তাণ্ডবে ১০ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
এরা হলেন, খুলনার লাল চাঁদ মোড়ল, বরিশালের জালাল সিকদার, মোকলেছ ও লোকমান হোসেন, সাতক্ষীরার শওকত মোড়ল, পটুয়াখালীর শহীদ, ভোলার জাহাঙ্গীর, মাইশা ও মনেজা খাতুন এবং চট্টগ্রামের ছাইফুল ইসলাম হৃদয়।
দেয়াল ধসে, আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে ও নানা কারণে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
৩৫ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত
ঘূর্ণিঝড়ে দেশের ১৯ জেলায় সাড়ে ৩৫ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এক লাখ ১৫ হাজার ঘরবাড়ি।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রেমালে দেশের ১০৭টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, দুর্গত পৌরসভা ও ইউনিয়নের সংখ্যা ৯১৭।
উপকূলীয় এলাকাগুলোর প্রায় সব এলাকার ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। গ্রাম থেকে শুরু করে শহরাঞ্চলেও ঘরের ভেতর প্রবেশ করেছে পানি।
বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় ক্ষয়ক্ষতি
দেশের প্রায় ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ভৌগলিক এলাকায় ঝড়-বৃষ্টির খবর পাওয়ার কথা জানিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
যার মধ্যে ৬৫টি সমিতিতে গ্রাহক সংযোগ আংশিক বা সম্পুর্ণ বন্ধ রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকার ৩০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ২ হাজার ৩৯২টি খুঁটি নষ্ট হয়েছে, ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়েছে ১ হাজার ৯৮২টি, মিটার নষ্ট হয়েছে ৪৬ হাজার ৩১৮টি।
বেলা ২টা পর্যন্ত এসব এলাকায় বিদ্যুৎবিহীন ছিলেন এক কোটি ২৬ লাখ ৭৮ হাজার গ্রাহক।
ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) এলাকায় খুঁটি নষ্ট হয়েছে ২০টি, হেলে পড়েছে ১৩৫টি, ছিঁড়ে যাওয়া গেছে ২৪ কিলোমিটার তার, ১২টি ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়েছে।
বিকাল ৫টা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট এলাকার চার লাখ ৫১ হাজার ৮১ জন গ্রাহক ছিলেন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন।
সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করার জন্য পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ও ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) জনবলসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। ঝড় বা বাতাস কমে গেলেই সংযোগ স্বাভাবিকের কাজ শুরু হবে।
বন্ধ ১৫ হাজার মোবাইল টাওয়ার
বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নের প্রভাব পড়েছে মোবাইল পরিষেবায়। উপকূলীয় অঞ্চলের মোবাইল নেটওয়ার্কের টাওয়ারগুলোয় বিদ্যুৎ নেই। জেনারেটর ব্যবহার করে সেবা সচল রাখার চেষ্টা করা হলেও সব জায়গায় তা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
সব মিলিয়ে রেমালের কারণে উপকূলের প্রায় ১৫ হাজার মোবাইল টাওয়ার বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল অপারেটরস অব বাংলাদেশ (এমটব)।
সন্ধ্যায় এক বিজ্ঞপ্তিতে এমটব জানিয়েছে, দ্রুত নেটওয়ার্ক সচল করতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ও বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করা হচ্ছে।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিটিআরসি জানিয়েছে, সোমবার সকাল ১০টা পর্যন্ত দেশের ৪৫টি জেলায় ৮ হাজার ৪১০টি সাইট বা মোবাইল টাওয়ার অকার্যকর ছিল। ২১ জেলায় বিটিসিএলের ৬৫টি সাইট অকার্যকর ছিল।
এ ছাড়া ১৫টি জেলায় এনটিটিএনের ১৬৮টি পপ বা পয়েন্ট অব প্রেজেন্স (গ্রাহকদের ইন্টারনেট সংযোগের কেন্দ্র) বন্ধ রয়েছে।
উপকূলীয় এলাকায় ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়া, বিদ্যুৎ না থাকা এবং ইন্টারনেটের তারে ক্ষতির কারণে শতাধিক আইএসপি অপারেটরের নেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েঠে বিটিআরসি। সব মিলিয়ে উপকূলের প্রায় তিন লাখ ব্রডব্যান্ড গ্রাহক ইন্টারনেট সেবা থেকে বঞ্চিত আছেন।
১৯ উপজেলায় ভোট স্থগিত
রেমালের প্রভাবে নির্বাচনী এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দেশের ১৯ উপজেলায় ভোট স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাগেরহাট, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা, ঝালকাঠি, বরগুনাসহ উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় বুধবার তৃতীয় ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম এবং ভোটের মালামাল কেন্দ্রে পৌঁছতে সমস্যা হতে পারে বলে মনে করছে মাঠ প্রশাসন।
মাঠ প্রশাসের এই সুপারিশের ভিত্তিতেই ১৮টি উপকূলীয় উপজেলা ও একটি পার্বত্য উপজেলা বাদ দিয়ে বাকি ৯০টি উপজেলায় তৃতীয় ধাপের ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।
তলিয়েছে মাছের ঘের
বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ উপকূলের অসংখ্য মাছের ঘের ও ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
এর মধ্যে বাগেরহাটের ২২-২৫ হাজার মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মোংলা, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা ও রামপাল উপজেলার ঘেরগুলো।
তবে পানি পুরোপুরি নেমে না যাওয়া পর্যন্ত এই সঠিক তথ্য পাওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে জেলার মৎস্য দপ্তর।
খুলনার কয়রা উপজেলার অন্তত তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙে ২০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্লাবনে ভেসে গেছে শতাধিক চিংড়ির ঘের। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শত শত কাঁচা ঘরবাড়ি।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলায় জোয়ারের পানি বেঁড়িবাধ উপচে প্রবেশ করে বেশ কিছু মাছের ঘের প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন নানা এলাকা
দেশের খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বরিশালের বিস্তীর্ণ এলাকা এখন পানির নিচে। এসব জেলার অনেক স্থানের সঙ্গেই সড়কপথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। আর জলপথে যোগাযোগ তো রেমাল সতর্কতা জারির সঙ্গেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
ভোলার জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামানের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, ভোলা থেকে চরফ্যাশনসহ দ্বীপ এলাকাগুলোয় যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। সড়কে গাছ পড়েও বন্ধ আছে অনেক স্থানের সঙ্গে যোগাযোগ।
একই অবস্থা পটুয়াখালী, পিরোজপুর, সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় এলাকার।
এমনকি খোদ ঢাকা শহরেই বৃষ্টির কারণে তৈরি হয়েছে জলাবদ্ধতা, যা সড়ক পথে যোগাযোগে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চলও ডুবে আছে পানিতে, ফলে খুব জরুরি কাজ ছাড়া বাড়ির বাইরে যেতে পারছেন না নগরবাসী।