নিজের নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ঢাকার রামপুরার একটি স্টুডিও থেকে নিজ খরচে গান তৈরি করিয়ে নেন আওয়ামী লীগের এক প্রার্থী। এরপরই সেই প্রার্থী লক্ষ্য করলেন, তার নিবার্চনী আসনে বিভিন্ন ব্যক্তি ও তরুণ তাঁর নামে নির্বাচনী প্রচারণার গান তৈরি করে সেটি উপহার হিসেবে নিয়ে আসছেন। এতে একটি বাড়তি বিড়ম্বনাও হলো। যে বা যারাই গান তৈরি করছেন, তাদেরকে অনেকটা ‘চক্ষুলজ্জা’র কারণে হলেও কিছু টাকা দিতে হচ্ছে ।
ঢাকার বাইরের আরেক প্রার্থীর অভিজ্ঞতা ঠিক এর বিপরীত। ঈগল প্রতীকে নির্বাচনে দাঁড়ানো ওই প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণার জন্য তাঁর বন্ধুরাই চাঁদা তুলে একটি অ্যালবাম করেছেন। ওই অ্যালবামে রয়েছে ৭টি গান। ওই অ্যালবামের উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, “নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করা ৯০ শতাংশ গানের সুর নকল হলেও আমাদের সব গানই মৌলিক।”
পাড়ায় পাড়ায় মাইকিং করে ভোট চাওয়ার চল পুরনো। এর সাথে ছিল হিন্দি ও বাংলা সিনেমার গানের সুরে বিভিন্ন মার্কায় ভোট দেওয়ার প্যারোডি গান। নির্বাচনী প্রচারণায় রাজনৈতিক দলগুলোর মৌলিক গানের চর্চা শুরু হয়েছে প্রায় এক দশক। শুরুটা হয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দিয়েই। এখন বাকি দলগুলোও ভোটের পক্ষে-বিপক্ষে এবং প্রতিপক্ষকে এক হাত দেখে নিতে গান দিয়ে পৌঁছাতে চাইছে ভোটারের কাছে।
ঐতিহাসিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় গান ব্যবহারের ঐতিহ্য দুইশো বছরেরও বেশি পুরনো।
১৮০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘অ্যাডামস অ্যান্ড লিবার্টি’ গানটি ছিল জন অ্যাডামসের পক্ষে; এটিকেই বিশ্বের প্রথম নির্বাচনী প্রচারণার গানের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
‘দ্য হান্টার্স অব কেন্টাকি’ গানটি নাকি আমেরিকার নির্বাচনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ‘দ্য ব্যাটল অব নিউ অর্লিয়েন্স’ অথবা ‘হাফ হর্স অ্যান্ড হাফ অ্যালিগেটর’ নামেও এই গান পরিচিত।
১৮১২ সালের যুদ্ধে নিউ অরলিয়েন্স শহরে ব্রিটিশদের পরাজিত করে জাতীয় বীর হয়ে ওঠেন মেজর জেনারেল অ্যান্ড্রু জ্যাকসন। এর কয়েক বছর পর সেই যুদ্ধে জ্যাকসনের বাহিনীর বীরত্বের গল্প বলা হয়েছে এই গানে। যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই গান আবারও সাড়া জাগায়। ১৮২৯ সালে অ্যান্ড্রু জ্যাকসন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেষ মুহূর্তের গানে গানে প্রচারণা পৌষের শীত প্রায় তাড়িয়ে দিয়েছে। গ্রাম থেকে শহরে মাইকে বাজছে নির্বাচনকে সামনে রেখে তৈরি বিশেষ গান। ফেইসবুক-ইউটিউবে ভাইরাল হচ্ছে মিউজিক ভিডিও।
এই জোয়ারের পথ দেখিয়েছিল ২০১৩ সালে ‘জয় বাংলা বলে আগে বাড়ো’ মিউজিক ভিডিওটি।
মূলত দলের ‘থিম সং’ হলেও, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই গান আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোটের প্রচারণায় সাড়া ফেলে।
আওয়ামী লীগের মঞ্চে ও প্রচারণায় গানটি থিম সং-এর মর্যাদা ধরে রেখেছে এখনও।
তবে সরাসরি ‘ভোট চাওয়ার গান ছিল না’ বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন গানটির গীতিকার এবং বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডটবার্থ- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ গাউসুল আলম শাওন।
তিনি বলেন, “তখন আসলে মাথায় ছিল বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশ ৩৫ বছরের নিচে। তারমানে আমাদের দেশে তরুণ জনগোষ্ঠী বেশি। আমরা এমন একটা মিউজিক ভিডিও করতে চেয়েছিলাম যা এই তরুণদের উদ্বুদ্ধ করবে স্বাধীনতার ডাক জয় বাংলা দিয়ে। … আজকের বাচ্চাকাচ্চারা যেন ইন্সপায়ার হয়।”
১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর দেশের ক্ষমতার রদবদলে দীর্ঘসময় অবরুদ্ধ ছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। সেই স্লোগান তরুণদের মুখে তুলে দিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) সাথে এই প্রকল্পে কাজ করেছিলেন শাওন।
এই মিউজিক ভিডিও দিয়ে ‘আরবান ইয়ুথ’ মানে শহরে বেড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্মকে নতুন করে বাংলাদেশ দেখাতে চেয়েছিলেন এই নির্মাতা। ভিডিওতে দেখা যায় একদল তরুণ-তরুণী সাইকেলে চেপে বেড়িয়ে পড়ে।
সৈয়দ গাউসুল আলম শাওন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “…তরুণরা দেশটাকে নতুন করে আবিষ্কার করে। টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিসৌধে যায়, ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরেও যায়। অর্থাৎ নতুন করে বাংলাদেশকে ভালোবেসে জয় বাংলা বলে আগে বাড়ো এরকম একটা বিষয় ছিল।”
গানটিকে ‘আওয়ামী লীগে’র নয় বরং ‘বাংলাদেশের গান’ বলে মনে করেন তিনি। নির্বাচনী প্রচারণার অন্য যেকোনও গানের থেকে এটিকে ‘আলাদা’ করেই রাখতে চান শাওন।
“আসলে আওয়ামী ভোট বেশি পাবে সেভাবে গানটি ছিল না। যে কারণে গানটি অনেক অথেনটিক হয়েছে। মনে হচ্ছিল এই গানটি বাংলাদেশের তরুণদের একটা গান”, বলেন তিনি।
এরপর ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘জয় বাংলা/ জিতবে আবার নৌকা…’ গানটি ভাইরাল হয়।
সরাসরি ভোট চাওয়ার গান হলেও নির্বাচনের পরও শিশু থেকে বয়স্কদের মুখে মুখে ফেরে গানটি। পরের কয়েক বছরে নির্বাচন তো বটেই, যে কোনও কর্মসূচিতে গানটি বাজানো দলীয় রেওয়াজ হয়ে উঠেছে।
আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি, দেশের রাজনীতিতে বড় দল বলে পরিচিত বিএনপিও নামে গানে গানে বিরোধিতায়।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘ধানের শীষে ডাক দিয়েছে’ শিরোনামে নির্বাচনী ভিডিও এবং অডিও সিডি প্রকাশ করে জিয়া শিশু একাডেমি।
‘ধানের শীষে ডাক দিয়েছে, আয়রে ছুটে আয়’, ‘দে দে সিল মেরে দে, তোরা দেরি করিস না’, ‘ভোট দাও, ভোট দাও, জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টকে ভোট দাও, ভোট দাও, ভোট দাও, ধানের শীষে ভোট দাও’ সহ মোট ছয়টি গান ছিল অ্যালবামে।
নৌকার গানের মতো সুপার-ডুপার হিট না হলেও চায়ের আড্ডায় আলোচিত হয় বিএনপির ‘দে দে সিল মেরে দে’ গানটি। গানে গানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চাওয়া ছিল ‘ধানের শীষে ছাড়া তোরা সিল মারিস না।’
গানটির সুর অবশ্য মৌলিক নয়; আব্দুর রাহমান বয়াতির লেখা ও সুরে মারফতি ধারার ‘ছেড়ে দে নৌকা মাঝি যাব মদিনা’ গানটি থেকে কপি করা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেই বলে এ বছর তাদের কোনো গান নেই।
ভোটের মাঠে ‘জিতবে আবার নৌকা’ বাজছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে। গানটির সঙ্গীত আয়োজন, গায়কী এবং জনরা বা ধরন আলোচনার দাবি রাখে। গানটি নির্মাণের সময় লাইভ ইন্সট্রুমেন্ট রেকর্ড করা হয়নি। বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার সরাসরি না করে সফটওয়ার দিয়ে কাজ করা হয়েছে।
এই গানের প্রযোজক ও গীতিকার তৌহিদ হোসেন; শিল্পী ও সুরকার সরোয়ার ও জি এম আশরাফ এবং সংগীত পরিচালক ডিজে তনু ও এলএমজি বিটস।
সাউথ ইন্ডিয়ান পপ এবং ওয়েস্টার্ন ইডিএম ধারার সাথে ‘জিতবে এবার নৌকা’ গানে রয়েছে মাইজভান্ডারি বিটের ব্যবহার।
অন্যতম সুরকার ও গায়ক সরোয়ার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গান বানানোর সময় মাথায় রাখতে হয় কেন বা কার জন্য বানাচ্ছি। চেষ্টা করেছি জয়বাংলা গানটির কথা যাতে সরল হয়, সকলে সহজে গাইতে পারে এমন সুর এবং সংগীত আয়োজন রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। পাশাপাশি এর আবহে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে।”
অ্যাক্টিভিজম নয় বরং এ ধরনের গান পেশাদারিত্বের সাথে করলেই ভালো হয় বলে মনে করেন সরোয়ার।
“আমি মনে করি দেশের অগ্রগতির কথা বলতে আপনাকে কোনো দলের সমর্থন করার প্রয়োজন নেই। একজন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানানো এটা আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।”
এরমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে গানটির দ্বিতীয় সংস্করণও। গানের কথায় কয়েক ছত্র সংযোজন হলেও সুর এবং সঙ্গীতায়োজন রয়েছে আগের মতোই। মূলত ভোটের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছরের উন্নয়নের কথা এসেছে গানে।
ভোটারদের মন জয় করতে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে গান ।
টানা এক যুগেরও বেশি সময় সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের উন্নয়ন তুলে ধরতে এই ডিসেম্বরে আরও একটি ভোটের গান আনে দলটি।
মীর মাসুমের সুর ও সংগীতায়োজনে ‘নৌকার পালে জয়ের বাতাস’ গানে আশির দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের গানের সুরের ছাপ রয়েছে। এই গানেও বাদ্যযন্ত্র নয়, সঙ্গীতায়োজনের কাজ হয়েছে সফটওয়ার দিয়ে।
গানটির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘সেরা বাংলা’। জুলফিকার রাসেলের লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন মিলন মাহমুদ, মিজান রাজিব, অবন্তী সিঁথী, মীর মাসুম, নাশা ও মিরাজ।
‘দিস ইলেকশন ইজ ভেরি ইমপরট্যান্ট ইলেকশন, সো গাইস, বি কেয়ারফুল’ গানটিতে ইংরেজি কথা থাকলেও আসলে এটি বাংলা গানই। ‘বি কেয়ারফুল’ শিরোনামের এই গানটি সাথে করে ঢাকা-৭ আসনে নৌকার মাঝি হতে চেয়েছিলেন হাসিবুর রহমান মানিক। গানটির কথা ‘টাকাপয়সা এক দিন আর ভালোবাসা চিরদিন/ তাই মানিক ভাইয়ের সালাম নিন/ হাতে লাগালে কালি আর চোখে লাগালে কাজল/ আমি মানিক ভাইয়ের পাগল’ ২০১৮ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলেও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের টিকেট পাননি হাসিবুর রহমান মানিক।
হিপহপ, বলিউড পপ এবং ইডিএমের ফিউশনে বাঁধা এই গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক নাদিফ সানি। গানের সুরে বলিউডের মিউজিক পরিচালক বাপ্পী লাহিরীর প্রভাব আছে।
ইউটিউবে জাতীয় পার্টির ভোটের গানও রয়েছে। রয়েছে এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ঈগল, কাঁচি, ট্রাক মার্কা নিয়ে গানও।
২০১৮ সালের পর গানে গানে নির্বাচনী প্রচারনণার ঝোঁক দেখা দেয় প্রতিবেশী দেশ ভারতেও। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়’ গানটি সেখানে জনপ্রিয়তা পায়। বলিউড পপ এবং ইলেকট্রনিক ডান্স মিউজিক বা ইডিএম ঘরানার এই গান বাজিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস বুঝিয়েছিল মমতা কেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অপরিহার্য।
মমতার গানের প্রত্যুত্তরে পশ্চিমবঙ্গের প্রচারণায় বিজেপিও গান বাঁধে- ‘ও পিসি যাও যাও যাও পিসি যাও।’
সামনে লোকসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে এরইমধ্যে গান বেঁধে ফেলেছে বিজেপি। গানে গানে দলটি বলছে ‘ফির আয়েগা মোদী’।