মহাকাশে বিশাল এক বলয়ের সন্ধান পেয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। এতে ফের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে প্রচলিত তত্ত্বগুলো, ফলে প্রশ্নবিদ্ধ মানুষের দীর্ঘদিনের জানা-বোঝাও।
যুক্তরাজ্যের সেন্ট্রাল ল্যাঙ্কাশায়ার ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন বিশাল এই গ্যালাক্সি বলয়। এর ব্যাস প্রায় ১.৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। একে পৃথিবী থেকে দেখতে রাতের আকাশের চাঁদের আকারের প্রায় ১৫ গুণ বড় মনে হয়।
তবে পৃথিবী থেকে প্রায় ৯০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে হওয়ায় বলয়টিকে খালি চোখে দেখা যায় না। বলয়টির সবগুলো গ্যালাক্সি ও গ্যালাক্সি গুচ্ছগুলোর অবস্থান শনাক্ত করতে লম্বা সময় ও কম্পিউটিং শক্তি লেগেছে।
বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘বিগ রিং’। বলয়টি মূলত অসংখ্য গ্যালাক্সি ও গ্যালাক্সি গুচ্ছ দিয়ে গঠিত। মহাকাশে দেখা এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় কাঠামোগুলোর একটি এটি।
বিজ্ঞানীদের নতুন এই পর্যবেক্ষণ গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্সে আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির ২৪৩তম সভায় উপস্থাপন করা হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্যালাক্সি বলয়টি আকারে এত বড় যে, তা মহাবিশ্ব সম্পর্কে বর্তমান বোঝাপড়াকে চ্যালেঞ্জ করছে।
এটি মহাবিশ্বতত্ত্বের মৌলিক অনুমান ‘মহাজাগতিক নীতি’র প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। মহাজাগতিক নীতির তত্ত্বে বলা হয়, একটি নির্দিষ্ট স্থানিক স্কেলের উপরে মহাবিশ্ব সবদিকে একইরকম ও অভিন্ন দেখায়। অর্থাৎ, মহাকাশের যে কোনও জায়গা থেকে মহাবিশ্বকে সবদিকে একইরকম দেখা যাবে।
মহাজাগতিক নীতি সম্পর্কিত বর্তমান তত্ত্ব অনুযায়ী এই ধরনের বিশাল কাঠামোর অস্তিত্ব থাকার কথা না। বিদ্যমান তত্ত্ব বলে যে, বিগ ব্যাং বা মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ শুরুর পর পদার্থ বা বস্তুরাজি মহাবিশ্বজুড়ে সুষমভাবে বণ্টিত হয়েছে।
তবে মহাবিশ্ব সম্পর্কিত বিদ্যমান তত্ত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া আবিষ্কার এটিই প্রথম নয়। এর আগে ২০২১ সালে মহাকাশের এই একই জায়গায় আরেকটি বিশাল আকৃতির কাঠামো আবিষ্কৃত হয়, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘জায়ান্ট আর্চ’। সেটিও মূলত অসংখ্য গ্যালাক্সির সমাহার।
বিজ্ঞানীদের মতে, এসব আবিষ্কার বলছে, মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও তা কীভাবে চলে সে সম্পর্কে নতুন বড় কোনও বিষয় আবিষ্কারের অপেক্ষায় রয়েছে।
বিগ রিং ও জায়ান্ট আর্চ, এই দুটি কাঠামো আবিষ্কারেই নেতৃত্ব দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের সেন্ট্রাল ল্যাঙ্কাশায়ার ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আলেক্সিয়া লোপেজ। তিনি বলেন, “বিদ্যমান মহাজাগতিক নীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, মহাবিশ্বের যে অংশটি আমরা দেখতে পাচ্ছি সেটিকে আমরা বাকি মহাবিশ্বের একটি ‘ভালো নমুনা’ হিসেবে গণ্য করতে পারি। বাকি মহাবিশ্বও দেখতে এমনই হওয়ার কথা। মহাবিশ্বকে বড় স্কেলে দেখার সময় আমরা মহাশূন্যের সর্বত্র সমভাবেই বস্তুরাজির উপস্থিতি দেখার আশা করি। তাই সর্বোচ্চ একটি নির্দিষ্ট আকৃতির চেয়ে বড় কোনও আকৃতির কাঠামো দেখা যাওয়া উচিৎ নয়।
“মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমান তত্ত্ব অনুযায়ী, মহাকাশে ১.২ বিলিয়ন আলোকবর্ষব্যাপী বিস্তৃত কাঠামোর চেয়ে বড় কোনো কাঠামো থাকা উচিৎ নয়। কিন্তু এই দুটি কাঠামোই তার চেয়ে অনেক বড়। জায়ান্ট আর্চ এর চেয়ে প্রায় তিন গুণ বড়। আর বিগ রিংয়ের পরিধিও লম্বায় প্রায় জায়ান্ট আর্কের দৈর্ঘ্যের সমান হবে।”
“মহাবিশ্ব সম্পর্কিত বর্তমান তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা মনে করি না, মহাকাশে এত বড় কাঠামো থাকা সম্ভব। আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকা পুরো মহাবিশ্বে সবমিলিয়ে একটি অতি বড় কাঠামো আশা করতে পারি। তথাপি, বিগ রিং ও জায়ান্ট আর্ক দুটি বিশাল কাঠামো এবং এমনকি পরস্পরের মহাজাগতিক প্রতিবেশিও; যা অসাধারণভাবে এক আকর্ষণীয় ব্যাপার।”
আশ্চর্যজনকভাবে, দুটি কাঠামোই পৃথিবী থেকে একই দূরত্বে এবং বুয়টেস দ্য হার্ডসম্যান নক্ষত্রপুঞ্জের কাছে অবস্থিত। তাদের অবস্থান এই সম্ভাবনাও উত্থাপন করে যে, তারা হয়ত একটি পরস্পর সংযুক্ত মহাজাগতিক সিস্টেম বা কাঠামোর অংশ।
লোপেজ বলেন, “এই অদ্ভুত ব্যাপারগুলোকে এখন হয়ত অত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু আমরা যত বেশি এমন সব অদ্ভুত বিষয় খুঁজে পাব, তত আমাদের এই সত্যটির মুখোমুখি হতে হবে যে, হয়তো মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বর্তমান তত্ত্বটি পুনর্বিবেচনা করে দেখতে হবে। আমাদের এই তত্ত্বটি হয়তো অসম্পূর্ণ। অথবা হয়ত মহাবিশ্ব কীভাবে সৃষ্টি হলো ও কীভাবে চলে সে সম্পর্কে আমাদেরকে সম্পূর্ণ নতুন একটি তত্ত্ব গড়ে তুলতে হবে।”
লোপেজের মতে, “বিগ রিং ও জায়ান্ট আর্চ, উভয়ই পৃথকভাবে ও একসঙ্গে, মহাবিশ্বকে ও এর বিকাশ বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য একটি বড় মহাজাগতিক রহস্য তৈরি করেছে।”
যুক্তরাজ্যের রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির উপ পরিচালক ড. রবার্ট ম্যাসির মতে, জ্যোতির্বিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় ধারণাগুলোর পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তার প্রমাণ বাড়ছে। তিনি বলেন, “বিগ রিং মহাবিশ্বে আবিষ্কৃত সপ্তম বড় কাঠামো যা এই ধারণার বিরোধিতা করে যে, মহাবিশ্ব সবদিকে দেখতে একই রকম এবং পদার্থ বা বস্তুরাজি মহাকাশের সবদিকে সমভাবে বণ্টিত হয়েছে। যদি এই কাঠামোগুলো বাস্তব হয়, তাহলে তা অবশ্যই মহাবিশ্ববিদদের জন্য নতুন চিন্তার খোরাক যোগাবে এবং মহাবিশ্বের বিবর্তন সম্পর্কে বর্তমানে গৃহীত চিন্তাভাবনাগুলোর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে।”
ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডন পোলাকো বলেন, এই দুটি কাঠামো পরস্পর সম্পর্কিত হতে পারে এবং দুটি মিলে আরও বড় কোনও কাঠামোও তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ, দুটি কাঠামো হয়ত আরও বড় কোনো কাঠামোর অংশ। যদিও এর সম্ভাবনা খুবই কম।
“কিন্তু কীভাবে এত বড় কাঠামো তৈরি হলো?” এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তিনি বলেন, “এমন কাঠামো তৈরি করতে পারে এমন কোনও প্রক্রিয়ার ধারণা করাও অবিশ্বাস্যভাবে কঠিন। তাই এর পরিবর্তে গবেষকদের অনুমান, আমরা হয়ত মহাবিশ্বের প্রথম দিককার কোনো ভগ্নাবশেষ দেখতে পাচ্ছি, যেখানে উচ্চ এবং নিম্ন ঘনত্বের উপাদানের তরঙ্গ এক্সট্রা গ্যালাক্টিক মাধ্যমে হিমায়িত হয়ে আছে।”
দ্য গার্ডিয়ান বলছে, মহাবিশ্ববিদরা অনিশ্চিত যে, ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় এমন কাঠামোর জন্ম হয়েছে। একটি সম্ভাবনা হলো আদি মহাবিশ্বের এক ধরনের শব্দ তরঙ্গ, যা ব্যারিওনিক অ্যাকোস্টিক অসিলেশন নামে পরিচিত। তা আজও অসংখ্য গ্যালাক্সির সমাহারে গোলাকার শেলের জন্ম দিতে পারে। আরেকটি ব্যাখ্যা হতে পারে, মহাজাগতিক স্ট্রিংগুলোর অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা। এটি হলো, মহাবিশ্বের বুননে এমন একটি অনুমানমূলক ‘ত্রুটি’ যা পদার্থকে বড় আকারের ফল্টলাইনগুলোর সঙ্গে জমাট বাঁধাতে পারে।
একাধিক মহাবিশ্ববিদ এমন আরও অনেক বড় কাঠামো আবিষ্কার করেছেন। যেমন, স্লোয়ান গ্রেট ওয়াল, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ১.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। দক্ষিণ মেরু প্রাচীর, যা ১.৪ বিলিয়ন আলোকবর্ষ জুড়ে বিস্তৃত।
তবে মহাকাশে বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় একক কাঠামো হলো ‘হারকিউলিস-করোনা বোরিয়ালিস গ্রেট ওয়াল’ নামের একটি বিশাল গ্যালাক্সি গুচ্ছ। এটি প্রায় ১০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ চওড়া।
সূত্র: বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য ইনডিপেনডেন্ট