নড়াইল শহরের চৌরাস্তার মোড় থেকে মাশরাফি বিন মর্তুজার বাড়ি যাওয়ার অটো ভাড়া ২০ টাকা। যাওয়ার মূল রাস্তা চেনা ছিল আগে থেকেই। কিন্তু এক অটোচালক দেখিয়ে দিলেন আরও সহজ রাস্তা। তিনি বলে উঠেন, “মাশরাফির বাড়ি যেতে অত প্যাঁচালো রাস্তা লাগে নাকি? উনি সোজা মানুষ, উনার রাড়ির রাস্তাও সোজা।”
আসলেই সোজা রাস্তা। বড় রাস্তা থেকে মাত্র এক মোড় ঘুরে ৩-৪ মিনিটেই মাশরাফির বাড়ির সামনে এসে হাজির অটো। ভাড়ার অটোতে অন্য যাত্রী থাকলেও চালক আগে এই ক্রিকেট তারকার বাড়ির মেহমানকেই পৌঁছে দেবেন। পরে ছোটেন অন্য যাত্রীর গন্তব্যে।
বাড়ির খোলা গেইট ধরে ঢুকতেই গ্যারেজ। সেখানে তার বাবা গোলাম মর্তুজা বসে ছেলের নির্বাচনী প্রচার নিয়ে আলাপ করছিলেন কয়েকজনের সঙ্গে। ঢাকা থেকে যাওয়া সাংবাদিক পরিচয় শুনেই পাশের লোকদের সরিয়ে বসার জায়গা করে দেন। জানতে চান কুশলাদি।
ততক্ষণে মাশরাফি বেরিয়ে পড়েছেন, লাহোরিয়া ইউনিয়নে জনসভায় যোগ দেবেন তিনি। নড়াইলে তার বাসা থেকে ওই জায়গাটা ৩০ কিলোমিটারের কম নয়। সেখানে সাংবাদিকদের নির্বিঘ্নে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাছের লোকদের বলে দিলেন গোলাম মর্তুজা। তার কথামতোই দুই সাংবাদিকের জন্য চারটি বাইক নিয়ে হাজির হলেন চারজন।
সেই বাইকে আমরা জনসভাস্থলে পৌঁছে গেলেও প্রার্থী পৌঁছাননি। এদিকে মাঠে তিল ধারণের জায়গা নেই। তারা কথা শুনতে যেন সবাই উন্মুখ হয়ে আছেন। তার দেরির কারণ, গাড়ি থেকে নেমে তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে, কথা বলতে বলতেই পায়ে হেঁটে আসছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে এসব চেনা দৃশ্য। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সঙ্গে তার সম্পর্ক। ছোটরা ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আবদার করে, অন্যরা বলে রাস্তাঘাটের সমস্যার কথা আর বুড়োরা মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেন তাকে। কেউ কেউ নাছোড়বান্দা হয়ে ভাত খেয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন তাদের সংসদ সদস্যকে। গত চার বছরে নড়াইলে মাশরাফি-প্রীতির এসব ঘটনা দেখেছে পুরো বাংলাদেশ। মাশরাফি আর এলাকাবাসীর পারস্পরিক ভালবাসার গল্পগুলো যেন কিংবদন্তিতে রূপ নিচ্ছে।
সঙ্গে ৩০-৪০টি মোটর বাইকের বহরও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। বন্ধু-বান্ধবরাই বাইকে নিয়ে তার সঙ্গী হয়। এবারও নির্বাচনী প্রচারণায় বেশিরভাগ সময় তার বাহন মোটর সাইকেল। দ্বিচক্রযানে চড়ে সংসদ সদস্য যাচ্ছেন বা প্রচারণা করছেন, এটা এই আমলে খুব দেখা যায় না। নামি ব্র্যান্ডের সুদৃশ্য গাড়ি না থাকলে কি প্রার্থীকে মানায়! কিন্তু মাশরাফি যে দিব্যি মানিয়ে নিয়েছেন মোটর বাইকে। কখনও বন্ধু সুমনের আবার কখনও ছোট ভাই সিজারের মোটর সাইকেলে চেপেই গত ২৩ ডিসেম্বর থেকে তার নির্বাচনী প্রচার এগিয়ে যাচ্ছে।
তাছাড়া ভোটের সময় নিরাপত্তাও একটা বিষয় বটে। মাগুরায় আরেক ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসানের নির্বাচনী প্রচারণায় দেখা গেছে নিরাপত্তার বেষ্টনী। সঙ্গে দুজন নিরাপত্তারক্ষী, তাছাড়া গানম্যানও আছে। পাশাপাশি কালো গেঞ্জি পরা ছয়জনকে দেখা যায় সাকিবের গাড়ির সঙ্গে। তাদের সুঠাম শরীর আর তৎপরতা দেখলে বোঝাই যায়, তারা যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য তৈরি। সেরকম কাউকে চোখে পড়েনি মাশরাফির ধারেকাছে। ওই বাইকওয়ালা বন্ধু-বান্ধবদের মাঝেই যেন তিনি বেশ নিরাপদ বোধ করেন।
তাদের সঙ্গে নিয়ে একসময় লাহোরিয়ার জনসভায় পৌঁছান মাশরাফি বিন মর্তুজা। কোনো বিপত্তি ছাড়াই মঞ্চে উঠে ৩-৪ মিনি বক্তৃতা দেন। বিপক্ষ প্রার্থী বা কোন দলকে নিয়ে কোনো বিষোদগার বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়কের মুখে। বরং নিজ দলের ভেতরকার ভেদাভেদ সরিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হয়ে নড়াইলের উন্নয়নে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
বক্তৃতায় তিনি স্থানীয় কোন্দলকে এক পাশে সরিয়ে রেখে সোজাসাপ্টা কথা বলে গেলেন। আগের মতো সাধারণ মানুষের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন, “আমার কাছে কোনো দলমত ভেদাভেদ নেই। আমি খেলার মানুষ রাজনীতি করতে আসছি মানুষের উপকার করার ইচ্ছা নিয়ে। এখানে কোনও নেতা হতে আসিনি। আমি মানুষের পাশে থাকতে চাই।
“আপনাদের স্থানীয় নেতাদের মাঝে কী সমস্যা, তা আমি জানি না, জানতেও চাই না। আমি জানি সবাই আমাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবেন এবং আমি সবার জন্য কাজ করব। আমার কাছে থেকে কেউ খালি হাতে ফিরবে না।”
গতবার নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য হয়ে তিনি এলাকার কী কী উন্নয়ন করেছেন, তা লোকজন গড়গড় করে বলে দিচ্ছেন। নড়াইল শহরে চার লেনের সড়কের কাজ চলছে। ১০০ শয্যার হাসপাতাল ২৫০ শয্যায় উন্নীত করার কাজও চলছে। এছাড়া স্থানীয় পাসপোর্ট অফিসের নতুন ভবন ও নার্সিং কলেজ তৈরি হয়েছে। রাস্তাঘাটের কিছু উন্নতি তো আছেই। তবে আড়াই বছর নষ্ট হয়েছে কোভিড মহামারীর কারণে।
এবার শেখ হাসিনার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠনের লক্ষ্যে নড়াইলে আইটিপার্ক স্থাপন করতে চান মাশরাফি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইকোনমিক জোন করার পরিকল্পনাও আছে তার। সাবেক ক্রিকেট অধিনায়কের এসব প্রতিশ্রুতিতে মানুষ বিশ্বাসও রাখতে চান। তাই ভোটের আগেই কেউ কেউ জিতিয়ে দিচ্ছেন এই ক্রিকেট তারকাকে। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে বলে বসেন, “নড়াইল-২ আসনে ভোটের দরকার নেই। আমরা ভোট দেবে মাশরাফিকেই।”
লুঙ্গি পরে নিজ শহরে ঘুরে বেড়ানো, বাইকে চড়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি যাওয়া মানুষটির প্রতি আস্থা দেখা গেল আমজনতার, যেন খেলার মাঠের ম্যাজিক ভোটের মাঠেও দেখাচ্ছেন মাশরাফি।