Beta
শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

কোন দিকে যাচ্ছে ভারত-মালদ্বীপ সম্পর্ক   

মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু। ছবি: এএফপি
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু। ছবি: এএফপি
Picture of তৃষা বড়ুয়া

তৃষা বড়ুয়া

ভারতের ‘মাথাব্যথা’ হয়ে উঠেছেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু। কেবল নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষান্ত হননি, জয়ের পর থেকে ভারতবিরোধী অবস্থান জানান দিচ্ছেন তিনি। ভারতীয় সেনাদের ফিরিয়ে নিতে বলে আসছিলেন, এবার দিলেন আল্টিমেটাম। ১৫ মার্চের মধ্যে তাদের মালদ্বীপ ছাড়তে সময় বেঁধে দিয়েছেন তিনি।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন চীনপন্থি বলে পরিচিত পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেসের (পিএনসি) নেতা মুইজ্জু। নির্বাচনে তার কাছে হেরে যান ‘ভারতঘেঁষা’ মালদিভিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির (এমডিপি) ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ। ১৭ নভেম্বর শপথ নেওয়ার একদিন পর মোদি সরকারকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান মুইজ্জু।

সে সময় বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “নির্বাচনের আগে জনগণের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মালদ্বীপের মাটিতে কোনও বিদেশি বুট থাকবে না। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিন থেকে সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষায় কাজ করব।” 

মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের পাবলিক পলিসি সেক্রেটারি আব্দুল্লাহ নাজিম ইব্রাহিম রবিবার বলেছেন, “ভারতীয় সেনারা মালদ্বীপে থাকতে পারবে না। এটা প্রেসিডেন্ট ড. মোহামেদ মুইজ্জু ও তার প্রশাসনের নীতি।”

এ বিষয়ে হিন্দুস্তান টাইমসের নির্বাহী সম্পাদক শিশির গুপ্ত বলেছেন, “এ বছরের এপ্রিলে অনুষ্ঠিতব্য সংসদীয় নির্বাচনে ভোটার টানতে প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু ভারতবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য তিনি ইন্ডিয়া আউট কার্ড খেলছেন। এটাই মালদ্বীপের বর্তমান পরিস্থিতির নেপথ্যের সত্য।’’

মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে আলোচনা করতে উচ্চ পর্যায়ের দল গঠন করেছে নয়াদিল্লি ও মালে। রবিবার সকালে মালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে প্রথম বৈঠকে বসে দলটি।

মুইজ্জু কেন বারবার মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের ওপর জোর দিচ্ছেন? ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটিতে কেনই বা ভারতীয় সেনা অবস্থান করছে? তাদের ক্ষমতা কতটা? 

মালেতে অবস্থানরত ভারতীয় সেনারা। ছবি : রয়টার্স

মালদ্বীপে ভারতীয় সেনাদের সংখ্যা কত?

ভারত সরকারের সাম্প্রতিক হিসাব বলছে, মালদ্বীপে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর ৮৮ জন সদস্য আছে। মালদ্বীপের রাজনীতিক থেকে শুরু করে জনগণের একটি অংশ তাদের মাটিতে ভারতীয় সেনা দেখতে চান না। ২০২০ সালে তারা ভারত হটাও আন্দোলন শুরু করে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলে হ্যাশট্যাগ ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা।

এ বিষয়ে দু’ দেশের বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, ‘ইন্ডিয়া আউটের’ মাধ্যমে মালদ্বীপে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাদের ভূমিকাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করা হচ্ছে। দ্বীপরাষ্ট্রটির সার্বভৌমত্ব ভারতীয় সেনাদের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে—এই বয়ান অতিরঞ্জিত।

মালদ্বীপে কেন ভারতীয় সেনাদের অবস্থান?

সামরিক ও বেসামরিক কাজে মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ভারতীয় সেনারা। একই সঙ্গে তারা চিকিৎসা, নজরদারি ও উদ্ধার কাজেও সহায়তা করছে। দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে এমনটাই বলা আছে।

মালদ্বীপের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক মুখপাত্র সাফাত আহমেদ বলেন, তাদের দেশে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাদের হাতে অস্ত্র থাকে না। নিরস্ত্র এই সেনাদের অধিকাংশই অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযানে মালদ্বীপ সরকারকে সহযোগিতা করছে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ৫০টি যৌথ অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা হয়। 

ভারতের ওপর মালদ্বীপ কতটা নির্ভরশীল?  

ভারত ও মালদ্বীপের সহযোগিতার ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৮৮ সালে ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ লুথুফির নেতৃত্বে একদল ব্যক্তি সরকার উৎখাতের লক্ষ্যে মালদ্বীপে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেন। সে সময় দেশটির ক্ষমতায় ছিলেন মামুন আবদুল গাইয়ুম। অভ্যুত্থানকারীরা প্রত্যেকেই মালদ্বীপের নাগরিক। তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে শ্রীলঙ্কার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশন অব তামিল ইলম।

ভাড়াটে সেনারা অল্প সময়ের মধ্যে প্রধান সরকারি ভবন, বিমানবন্দর, সমুদ্র বন্দর, টেলিভিশন ও রেডিও স্টেশনসহ রাজধানী মালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ভারতের দ্বারস্থ হন প্রেসিডেন্ট গাইয়ুম।

ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ‘অপারেশন ক্যাকটাস কোড’ নামে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অভ্যুত্থানকারীদের পরাজিত করে এবং প্রেসিডেন্টকে উদ্ধার করে। গাইয়ুম সরকারকে হটাতে ১৯৮৮ সালে যে অভ্যুত্থান চেষ্টা হয়, তা অবশ্য প্রথম ছিল না। এর আগে ১৯৮০ সালে অর্থাৎ গাইয়ুম ক্ষমতা গ্রহণের দুই বছর পর ও ১৯৮৩ সালে অভ্যুত্থান চেষ্টা হয়। প্রতিবারই অভ্যুত্থানকারীরা ব্যর্থ হয়। কেবল ১৯৮৮ সাল নয়, পরবর্তী সংকটকালেও মালদ্বীপের পাশে ছিল ভারত।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ভারতীয় শিক্ষক ও চিকিৎসকরা মালদ্বীপে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পে ভারত মালদ্বীপের সবচেয়ে বড় অংশীদার। চাল, গম, চিনি, আলু, পেঁয়াজ, ডিম, সবজিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ভারত থেকে আমদানি করে মালদ্বীপ। দেশটির পর্যটন শিল্প বিকাশে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া প্রধান অর্থপ্রদানকারী সংস্থা ছিল। এখনও এটি দ্বীপরাষ্ট্রটির সর্ববৃহৎ ব্যাংক।

ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের সামরিক সম্পর্কও বেশ মজবুত। বেশ কয়েকটি সামরিক চুক্তি করেছে দেশ দুটি। তাদের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক মূলত শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে। ওই বছর মধ্যপন্থি ইসলামি দেশটির সরকার আশঙ্কা করেছিল, তার একটি দ্বীপ সন্ত্রাসীরা দখল করতে পারে। সন্ত্রাসীদের ঠেকাতে যে সামরিক সম্পদ ও তদারকি সক্ষমতা দরকার, সেসব ওই সময় মালদ্বীপের ছিল না।

ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের দাবি কেন?

২০১০ ও ২০১৫ সালে মালদ্বীপকে দুটি অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার উপহার দিয়েছিল ভারত। সাগরে অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ এবং এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে অসুস্থদের নিয়ে যাওয়ার কাজে হেলিকপ্টার দুটি ব্যবহার করা হয়।  

এ বিষয়ে ভারতের গবেষণা সংস্থা মনোহর পারিকার ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের গবেষক ড. গুলবিন সুলতানা বলেন, “মানবিক সহায়তা ছাড়া অন্য কোনও কাজে হেলিকপ্টার দুটি ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু মালদ্বীপের ভারতবিরোধী অংশ মনে করে, হেলিকপ্টার উপহার দেওয়ার মধ্য দিয়ে ভারত দেশটিতে সামরিকভাবে অবস্থান করতে চাইছে। কারণ হেলিকপ্টারগুলো সশস্ত্র বাহিনী ব্যবহার করে থাকে।”

ভারতের বিষয়ে মালদ্বীপের জনগণের ক্ষোভের আরেক কারণ, মুইজ্জুর পূর্বসূরি ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ ছিলেন না। এছাড়া সামুদ্রিক নিরাপত্তার বিষয়ে ভারতের ওপর অতি নির্ভরশীলতা নিয়েও ক্ষুব্ধ মালদ্বীপের মানুষ।  

চীনের অবস্থান কী?

পাঁচ লাখ জনসংখ্যার ছোট্ট দেশ মালদ্বীপ নিয়ে চীন দীর্ঘদিন মাথা ঘামায়নি। ২০১২ সাল পর্যন্ত দ্বীপরাষ্ট্রটিতে চীনের কোনও দূতাবাসও ছিল না। কিন্তু মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ ইয়ামিনের আমলে পরিস্থিতি পালটে যায়।

২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে উদ্যোগী হন। এরই ধারাবাহিকতায় চীনের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষর করে ইয়ামিন সরকার। এর ফলে মাছসহ মালদ্বীপের অন্যান্য রপ্তানিযোগ্য পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক তুলে নেওয়া হয়। চীনা পণ্য ও সেবা দ্বীপরাষ্ট্রে সহজলভ্য হয়ে পড়ে।

রাজধানী মালে ও হুলহুলে দ্বীপের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী দুই কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু উদ্বোধন করেন ইয়ামিন। মালদ্বীপের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হুলহুলে দ্বীপেই অবস্থিত। চীন-মালদ্বীপ ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ নামে পরিচিত ওই সেতু নির্মাণে বেইজিং থেকে ২০ কোটি ডলার পায় মালদ্বীপ।

দ্বীপরাষ্ট্রটিতে যাওয়া পর্যটকদের বড় অংশই চীনা। দেশটিতে প্রতিবেশি দেশ ভারতের বিনিয়োগ যেমন আছে, তেমনি চীনেরও আছে। সেতু, বিমানবন্দরসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে ১০০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ মালদ্বীপকে দিয়েছে চীন।

২০১৮ সালে সলিহ দ্বীপরাষ্ট্রটির ক্ষমতায় যাওয়ার পর বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ ইয়ামিন দেশকে বিপুল চীনা ঋণের ফাঁদে ফেলে বিদায় নিয়েছেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত