জাবালিয়া। গাজা উপত্যকার উত্তরের এক ফিলিস্তিনি শহর। দুই লাখের কম মানুষের বসবাস এখানে। ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না শহরের সাধারণ বাসিন্দারাও।
শোক আর ট্রমা তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। কারও বুকে স্বজন হারানোর বেদনা। কেউবা বাড়িঘর হারিয়ে দিশেহারা। আজ এক জায়গায় তো কাল আরেক জায়গায়- এভাবেই চলছে তাদের জীবন।
জাবালিয়ার আশ্রয়কেন্দ্রের সন্তানসম্ভবা নারীদের অবস্থা আরও করুণ। মাথার ওপর দিয়ে উড়ছে যুদ্ধবিমান। সেই মুহূর্তে যেন তাদের সন্তানরা গর্ভের অন্ধকার গহ্বরে আর থাকতে চাইছে না।
পৃথিবীর আলো দেখতে উন্মুখ। এই শিশুরা জানে না, বাইরেও নিকষ কালো অন্ধকার। কোনও আলো নেই সেখানে। জানলে হয়তো আরও কিছুদিন মায়ের গর্ভেই থেকে যেতে চাইত তারা। বলত, আগে যুদ্ধ থামুক। তারপর জন্ম দিও।
একজন মা সন্তান জন্ম দিতে পেরে যে অপার আনন্দ পান, তার সঙ্গে কোনোকিছুর তুলনা চলে না। যুদ্ধ শুরুর পর ফিলিস্তিনি মায়েরা কি সেই আনন্দ পাচ্ছেন? পারছেন কি আনন্দ উদযাপন করতে? না কি সন্তান জন্ম দেওয়ার পর তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত? উদ্বিগ্ন এই চিন্তায় কীভাবে বড় করবেন নবজাতক শিশুদের? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন তো তাদের?
জাবালিয়ায় জাতিসংঘের এক স্কুলে আশ্রয় নেওয়া এমনই তিন নারীর সঙ্গে কথা বলেছে আল জাজিরা। জানতে চাওয়া হয় তাদের গর্ভধারণের অভিজ্ঞতা। সন্তান জন্ম দেওয়ার অভিজ্ঞতা। যুদ্ধে কী হারিয়েছেন? সদ্যোজাত শিশু কি তাদের মুখে হাসি ফেরাতে পারছে?
আয়া দীব
জাতিসংঘের সংস্থা ইউএন রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস (ইউএনআরডব্লিউএ) পরিচালিত স্কুলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এক কক্ষে বসেছিলেন আয়া দীব। পাশে গোলাপি কম্বলে ঘুমিয়ে মেয়ে ইয়ারা। এ কারণে নিচু গলায় কথা বলছিলেন সাংবাদিকের সঙ্গে।
২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের দিন জন্ম হয় ইয়ারার। জন্মের আগে তাকে নিয়ে ভয়ে ছিলেন আয়া। গর্ভের শিশুটিকে হারাবেন না তো?
জাবালিয়ার পশ্চিমে বার আন-নাজা এলাকায় বাড়ি ছিল আয়ার। ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর সেই বাড়ি তাকে ছাড়তে হয়।
আয়া বলেন, “যুদ্ধের শুরুতে ছেলে মোহামেদ আর আমাকে নিয়ে গাজার আজ জাওয়াদা শহরে যান আমার স্বামী। সেখানে আমার চাচাশ্বশুরের বাড়ি।
“আমার স্বামী ভেবেছিলেন, শহরটি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ হবে। কিন্তু তারা (ইসরায়েলি বাহিনী) একদিন চাচার পাশের বাড়ি লক্ষ্য করে হামলা করে বসে। সেই হামলায় আমার স্বামী নিহত হন।”
ওই ঘটনার পর ছেলেকে নিয়ে মা-বাবার কাছে চলে যান আয়া। এরপর শুরু হয় যাযাবর জীবন।
ইসরায়েলের বোমা হামলা থেকে বাঁচতে কখনও এই এলাকায় তো কখনও আরেক এলাকায় আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়ান আয়া। সঙ্গে ছেলে আর মা-বাবা। পেটে ইয়ারা। এভাবেই কেটে যায় সপ্তাহের পর সপ্তাহ।
শেষমেশ জাবালিয়ায় জাতিসংঘের ওই স্কুলে আশ্রয় নেন। সেখানে তারা ছাড়াও আছেন হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি।
কষ্টের সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে আয়া বলেন, “গর্ভধারণের শেষ কয়েক মাস খুব বিষণ্ন থাকতাম। ওই সময় একজন নারীর কত কিছুর প্রয়োজন হয়। আমি পর্যাপ্ত খাবার পাইনি। বিশুদ্ধ পানিও অনেক সময় জোটেনি।
“তবে সবচেয়ে দুঃখের ছিল, স্বামীকে হারানো। ইয়ারার জন্মের সময় তিনি আমার পাশে থাকতে পারেননি।”
বড়দিনের আগের দিন আয়ার প্রসব বেদনা শুরু হয়। ধীরে ধীরে যন্ত্রণা বাড়তে থাকে। রাত ২টার দিকে তার মা-বাবা তাকে আশ্রয়কেন্দ্রটির ক্লিনিকে নিয়ে যান। মেয়েকে সেখানে রেখে তারা পাগলের মতো ধাত্রী খুঁজতে থাকেন।
পরদিন ভোর ৫টার দিকে ক্লিনিকটির মেঝেতে জন্ম হয় ইয়ারার। ক্লিনিক বলতে আমরা যা বুঝি, সেটি তা না। স্কুলটির একটি শ্রেণিকক্ষকে ক্লিনিক বানানো হয়েছে। কক্ষের এক কোণায় পর্দা টাঙ্গিয়ে প্রসবকালের গোপনীয়তা রাখার চেষ্টা করেছে ক্লিনিকের কর্মীরা।
সন্তান প্রসবের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আয়া বলেন, “আমাকে সে সময় খুব পরিশ্রম করতে হচ্ছিল। আমি কেবল যুদ্ধবিমানের শব্দ পাচ্ছিলাম। বোমাবর্ষণের শব্দ পাচ্ছিলাম। আর কোনোকিছুই কানে ঢুকছিল না। বোমার শব্দে ক্লিনিকের সবাই আতঙ্কিত ছিল।”
ইয়ারা কোনও জন্মসনদ পায়নি। কোনও টিকা তাকে দেওয়া হয়নি। তার মায়েরও আর স্বাস্থ্যপরীক্ষা হয়নি।
মেয়ের জন্য কী কামনা করেন, এই প্রশ্নে আয়া বলেন, “বেশি কিছু না। যুদ্ধবিহীন দীর্ঘ, শান্তিময় জীবন। এত অল্প বয়সে তাদের কত কিছুই না দেখতে হচ্ছে।”
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান বলছে, যুদ্ধের মধ্যে গাজায় প্রতিদিন ১৮০ শিশু জন্মগ্রহণ করছে।
রায়েদা আল-মাসরি
জাতিসংঘের স্কুলটির আরেক আশ্রিতা রায়েদা আল-মাসরি। গাজার বেইত হানুন শহরে তার বাড়ি। আয়া দীবের মতো তিনিও যুদ্ধের শুরুতে বাস্তুচ্যুত হয়ে জাবালিয়ায় ঠাঁই নেন।
রায়েদা বলেন, “দুই মাস আগে এই শ্রেণিকক্ষেই জন্ম হয় আমার ছেলে মোথের। সন্তান প্রসবের সময় দরকারি কিছুই হাতের কাছে ছিল না। এমনকি আমার সদ্য ভূমিষ্ঠ ছেলেকে মোড়ানোর মতো কাপড়ও ছিল না। এক টুকরো কাপড় লোকজন হন্যে হয়ে খুঁজেছিল।”
মোথের জন্মের পর টিকা দিতে তাকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পাশের কামাল আদওয়ান হাসপাতালে গিয়েছিলেন রায়েদা। কিন্তু সেখানে টিকা ছিল না।
রায়েদা বলেন, “এই আশ্রয়কেন্দ্রে আমার দুই মাস বয়সী ছেলে থাকছে। রোগজীবাণু চারদিকে গিজগিজ করছে। মোথের বুকে কিছু একটা হয়েছে। শ্বাস নিতে তার সমস্যা হচ্ছে। মা হয়ে আমি কিছুই করতে পারছি না।
“ছেলেকে বড় করতে যে খাবার-দাবার দরকার, সেসব আমি পাচ্ছি না। আমি চাই আমার ছেলে নিরাপদে বেঁচে থাকুক। খাবার পাক। ডায়পার পাক। আমি চাই না, সে অভাবের মধ্যে বড় হোক।”
উম রায়েদ
ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন উম রায়েদ। ছেলের ঘুম যেন গাঢ় হয়, এজন্য মাঝেমধ্যে তাকে দোল দিচ্ছিলেন। ছেলেকে নিয়ে উম চিন্তিত। জন্মের পর থেকে প্রায়ই অসুস্থ থাকে সে। এ কারণে মন খারাপ উমের। ছেলের জন্য অসহায় বোধ করেন। তার চোখে-মুখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট।
উম বলেন, “আমার ছেলে এই বয়সে জানে, বোমার শব্দ কেমন। আশপাশে যখনই বোমা ফেলা হয়, সে কেঁপে কেঁপে ওঠে। ভয়ে কুকড়ে যায়। আমি মনে করি, এত অল্প বয়সে শিশুদের বিপদ সম্পর্কে ধারণা হওয়া উচিত না।”
ছেলের জন্য কী কামনা করেন- জানতে চাইলে উম বলেন, “এ মুহূর্তে টিকাই। আর দীর্ঘমেয়াদে চাই সে যেন স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে ওঠে। শান্তিতে থাকে। এত কম বয়সে যুদ্ধ কী, তা না জানুক। অবশ্য এসব আমার একার নয়। সব ফিলিস্তিনি মা-ই তাদের সন্তানদের জন্য এসব কামনা করছেন।”