২০০৬ সালে প্রথমবার কোনও দল ওয়ানডেতে ৪০০ রান টপকেছিল। অস্ট্রেলিয়ার ৪৩৪ টপকে সেদিন জোহানেসবার্গে ইতিহাসের ওপর ইতিহাস গড়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তারা করে ৪৩৮। একই বছর শ্রীলঙ্কা নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে ৪৪৩ ও প্রোটিয়ারা জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ৪১৮ রান করে। ৩০০ রানেই জয়ের ছক আঁকা ওয়ানডে সে বছর থেকে পাল্টে যায়।
ওয়ানডেতে দলের সবাই মিলে ৪০০ করবেন, নতুন যুগের ক্রিকেটে তা মানা যায়। কিন্তু একজন ব্যাটারই ২০০ করে ফেলবেন তা ভাবা যেত না। ক্রিকেটদেবতা অবশ্য অনেক কিছুই ভেবে রেখেছিলেন। ততদিনে সনাথ জয়াসুরিয়া, ক্রিস গেইল হয়ে ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, এবি ডি ভিলিয়ার্সরা ক্রিকেটের বিধ্বংসী ব্যাটার হয়ে উঠেছেন। ২০০ হলে তাদের ব্যাটেই হবে এমন একটা ব্যাপার। কিন্তু ওই যে ক্রিকেট দেবতার ইচ্ছে!
তিনি এমন একজনের ব্যাটে ২০০ এনে দিলেন যা একমাত্র তাকেই মানায়। মারকুটে ব্যাটার নন তবে ব্যাটিংয়ের শিল্পী – লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকার।
২০০৬ সালে দলীয় ৪০০’র যুগে পা রাখার চার বছর পর ২০১০-এ একক ২০০ দেখতে পায় ক্রিকেট। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ভারতের মধ্য প্রদেশের শহর গোয়ালিয়রে ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন চেন্ডুলকার। ১৪৭ বলে ২০০ রানের অপরাজিত ইনিংস। এরপর আরও ৯ ক্রিকেটার এ তালিকায় নাম লেখান। রোহিত শর্মারই তিনটি। একটি করে মার্টিন গাপটিল, বীরেন্দর শেবাগ, ক্রিস গেইল, ফখর জামান, পাথুম নিশাঙ্কা, ইশান কিশান, শুবমান গিল ও গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের।
টেন্ডুলকারের সেই দুইশোর স্মৃতির স্টেডিয়ামটির এখন বেহাল দশা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি তার কীর্তির ওই ম্যাচের পর এই গোয়ালিয়রে আর কোনও আন্তর্জাতিক খেলা হয়নি। সেই শহরে আরেকটি নতুন মাঠে ১৪ বছর পর ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরছে। ৬ অক্টোবর টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচের ৩০ হাজার টিকিট ইতিমধ্যে বিক্রি শেষ।
গোয়ালিয়র ট্রেন স্টেশনের খুব কাছেই পুরোনো মাঠটির নাম ক্যাপ্টেন রূপ সিং ক্রিকেট স্টেডিয়াম। হকি স্টেডিয়াম হলেও মাঠটিকে ১৯৮০ সালে ক্রিকেট স্টেডিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়। এই রূপ সিং আবার হকিতে ভারতের দুবারের অলিম্পিক স্বর্ণজয়ী খেলোয়াড়। হকি থেকে ক্রিকেটে পরিবর্তন করা হলেও স্টেডিয়ামের নাম বদল করা হয়নি।
সরু সড়ক লাগোয়া স্টেডিয়ামে ঢুকতে মূল গেটের দুপাশে আলপনা চিত্র চোখে পড়বে। সেখানে টেন্ডুলকারের হাসিমাখা মুখটাই চেনা যায়, বাকিগুলো ক্রিকেটারদের অবয়ব। ভেতরে ছোট পরিসরের মূল প্রবেশ অংশ। সেখান থেকে মাঠে ঢোকার দরজার দুপাশে দোতলার ড্রেসিংরুমে ওঠার সিঁড়ি। প্রবেশের ওই অংশে স্টেডিয়ামের নতুন নকশার ডামি এখনও কাঁচঘেরা দিয়ে সাজানো আছে। পাশের দেয়ালে এই স্টেডিয়ামে হওয়া ১২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচের তালিকা ঝুলানো। আর মাঠটির জন্য সবচেয়ে গৌরবের টেন্ডুলকারের দুইশো রানের স্কোরকার্ডও ঝোলানো আছে বল ও রান উল্লেখ করে।
স্টেডিয়ামটির মাঠ এখনও ঠিক আছে। রঞ্জি ট্রফি, বয়সভিত্তিক ও বিভিন্ন ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা হয় এখানে। কিন্তু ড্রেসিংরুমে একেবারে সুনশান। কিছু টেবিল, কয়েকটি চেয়ার ও ডাম্বেল ছাড়া আর কিছুই নেই। গ্যালারির চেয়ারগুলো থাকলেও ভিআইপি গ্যালারির ছাউনি ভেঙে পড়ছে আলগা হয়ে। দূরে খণ্ড খণ্ড হয়ে ভাগ করা ১৮ হাজার ধারণক্ষমতার গ্যালারিগুলো মাঠটির কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টেন্ডুলকারের দুইশোর স্মৃতি নিয়েই এই স্টেডিয়ামটি দাঁড়িয়ে আছে।
সেই স্মৃতিচারণ করলেন ২০১০ সালে ম্যাচের দিনের মাঠকর্মী সঞ্জয় খান। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ওই ম্যাচটি হওয়ার কথা ছিল কানপুরে। তা সরিয়ে গোয়ালিয়রে আনা হয়। সঞ্জয়রা মাত্র ১৯ দিন সময় পেয়েছিলেন পিচ ও মাঠ তৈরি করার।
সকাল সন্ধ্যাকে এই মাঠকর্মী বলেছেন, “আমরা ভেবেছিলাম সেদিন ভারত ২৫০ বা ৩০০ রান করবে। কিন্তু শচীনের ব্যাটিং যখন দেখলাম তখনই মনে হয়েছে আজ সব রেকর্ড ভেঙে যাবে। তিনি যখন ১৯৯-তে ছিলেন তখন সবাই একটা উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিল যে ২০০ হবে তো! তিনি যখন দুইশো পূরণ করলেন পুরো গ্যালারিজুড়ে অন্যরকম একটা আবহ তৈরি হয়। সবাই শচীন, শচীন বলে আওয়াজ তুলেছিল।”
ম্যাচ শেষে টেন্ডুলকার নিজে মাঠকর্মীদের ধন্যবাদ দেন। সঞ্জয়ের পিঠও চাপড়ে দেন। সেই স্মৃতি এই মাঠকর্মীর মনে এখনও টাটকা, “ম্যাচ শেষে আমরা ওনার (টেন্ডুলকার) সঙ্গে দেখা করেছিলাম। উনি খুব খুশি ছিলেন, আমাদের বলেছিলেন, ‘ভালো উইকেট বানিয়েছো। ব্যাটিং করে খুব মজা পেয়েছি।’ আর আমার কাঁধ চাপড়ে দিয়েছিলেন। পরে উনি বলেন, ‘আজ আমার একটা স্বপ্নপূরণ হলো যে, দুইশো রান করার রেকর্ড করতে পেরেছি।”
টেন্ডুলকারের স্বপ্ন পূরণ হলেও গোয়ালিয়রের এই মাঠটির আন্তর্জাতিক খেলা আয়োজনের স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। এই মাঠটি এখন রাজ্যের বিভাগীয় স্টেডিয়াম হিসেবে ব্যবহার হয়। তবে শ্রী হারানোর মাঝেও একটু গৌরব অবশিষ্ট আছে।। এখনও যে স্টেডিয়ামের দালানে ঝুলছে টেন্ডুলকারের দুইশোর স্কোর ও সেদিনের একটি ছবি।